মানুষের মন বুঝতে ব্যর্থ হয়েছেন মমতা
RG Kar Protest: মানুষ কতটা মরিয়া হলে রাস্তার দু'ধারে একটানা ১৬ কিলোমিটার মানববন্ধন তৈরি করা সম্ভব হয়? এই জনতাকে ঘুম পাড়ানো অলীক স্বপ্ন। এই জনতাকে ঘুম পাড়ানো অলীক স্বপ্ন।
'ব্রিগেড চলো', কুশপুত্তলিকা দাহ— এ শহরের চেনা ছবি। মিছিলনগরী শব্দটা যথাযথই প্রয়োগ করেছিলেন জওহরলাল নেহরু। কিন্তু তারপরেও গত একমাস, আরজি কর হাসপাতালে নির্মম খুন ও ধর্ষণের ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরে কলকতা এবং সংলগ্ন শহরতলিতে ক্রোধের যে বিস্ফোরণ ঘটে গিয়েছে, শহরের সবচেয়ে প্রবীণতম মানুষগুলোও বলছেন, এমনটা আগে কখনও দেখিনি। যাঁরা খাদ্য আন্দোলন দেখেছেন, নকশাল আন্দোলনের রক্তাক্ত-ঋতু পার করেছেন, তাঁরাও বলছেন, এ দৃশ্য অকল্পনীয়।
অথচ এই সত্যটাই বুঝতে চাইছে না শাসক। কেউ কুমন্তব্য করছে, কেউ এখনও ভাবছে লাগামটা তার হাতেই আছে। ফলে ভাবতে হচ্ছে, সদ্য লোকসভা ভোটে বড় ব্যবধানে জয়ের স্বাদ এখনও তৃণমূলে কংগ্রেসের প্রতিটি স্বাদকোরকে স্থায়ী বলেই কি গণক্রোধের তল পেতে অসুবিধে হচ্ছে? কয়েক লাখ মানুষ যখন সমস্বরে বলছে— ন্যায়বিচার চাই, তখন 'ন্যায়বিচার' শব্দটি কি স্রেফ আরজি কর কাণ্ডে সুপ্রিম কোর্ট কী রায় দেয়, সেটুকুতেই আটকে আছে, নাকি তার আরও গভীর অর্থ আছে? আরজি কর ঘটনার পরেও এ রাজ্যে খুন-ধর্ষণ থামেনি, কিন্তু এই ঘটনাটিকেই কেন পাখির চোখ করল নাগরিক সমাজ?
আমলা হিসেবে কেন্দ্র-রাজ্যের সরকারের অন্দরমহল কয়েক দশক ধরে গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন জহর সরকার। পদত্যাগপত্রে তিনি যখন লিখছেন, আমার এত বছরের জীবনে এমন ক্ষোভ ও সরকারের প্রতি সম্পূর্ণ অনাস্থা কখনও দেখিনি, তখন কথাটার গুরুত্ব অনুধাবন করা জরুরি।
২০১১ সালে 'বদলা নয় বদল চাই' স্লোগান হাতিয়ার করে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় আসে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল। সেবারেও রেগে গিয়েছিলেন মানুষ। বাম অপশাসনের বিরুদ্ধে মানুষের মনে ক্ষোভ জমছিল বছরের পর বছর ধরে। সেই ক্ষোভের স্রোতেই নৌকো ভাসিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। একের পর এক ঘটনায়, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৎপরতা দেখে ক্রমে সব স্তরের মানুষ তাঁকেই একমাত্র বিকল্প ভাবতে শুরু করে।
আরও পড়ুন: মুখ্যমন্ত্রীর ডাকে মিলল না সাড়া! মাথা উঁচু করে আন্দোলনেই অনড় জুনিয়র ডাক্তারেরা
২০০০ সালে কলকাতা পৌরসভার দখল নিল তৃণমূল। বোঝা গেল শহর কলকাতা তথা নাগরিক সমাজ তৃণমূলকে মান্যতা দিচ্ছে। আবার ২০০৬ সালে, সিঙ্গুরে কৃষিজমি অধিগ্রহণ বিরোধী আন্দোলন শুরু হওয়ার পরে, কৃষক সমাজের মধ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলের ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হল। এই ২০০৬ সালেই, ১৮ ডিসেম্বর ভোরে বাজেমেলিয়ায় তাপসী মালিকের অর্ধদগ্ধ দেহ উদ্ধার হল। যখন গ্রামবাসীরা সেই দেহ উদ্ধার করেন, তখনও সেখানে ধোঁয়া বেরোচ্ছিল। শিউরে ওঠে গোটা দেশ। তাপসীর মৃত্যু আন্দোলনে নতুন মাত্রা সঞ্চার করে। মমতার নেতৃত্বে মানুষের আস্থা বাড়ছিল। টাটারা সিঙ্গুর ছাড়তে বাধ্য হল। ক্রমে নন্দীগ্রাম অভ্যুত্থান দেখেছে রাজ্যবাসী, ২০১১ সালে সিপিএম-কে ক্ষমতা থেকে সরিয়েছে।
মনে রাখতে হবে তাপসী মালিকের ধর্ষণ কিন্তু কোনও রাষ্ট্রীয় ঘেরাটোপে হয়নি, বিষাক্ত গ্রাম্য দলীয় রাজনীতির শিকার হয় মেয়েটি। তার ১৮ বছর পর, সোদপুরের বাসিন্দা, আর জি করের নির্যাতিতার মৃত্যু হয়েছে সরকারি হাসপাতালের ভেতর। তার নিজের চেনা কাজের পরিসরে। অন্যের প্রাণ বাঁচাতে ৩৬ ঘণ্টা ডিউটির ফাঁকে সামান্য জিরিয়ে নিচ্ছিলেন তিনি। এই আবহে যখন এত নৃশংস খুন-ধর্ষণ ঘটে গেল, পুলিশের স্বাভাবিক পদক্ষেপ হওয়ার কথা ছিল, অধ্যক্ষকে ডেকে রুটিন জিজ্ঞাসাবাদ। অথচ পাঁচ দিন কেটে গেলেও আরজি করের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষকে পুলিশ ডাকেনি দেখে অবাক হয়েছিলেন হাইকোর্টের বিচারপতিরা। একই সঙ্গে তাঁরা উদ্বেগ প্রকাশ করেন, ইনকোয়েস্ট রিপোর্ট হাতে এসে যাওয়ার পরেও এই মৃত্যুকে পুলিশের খাতায় অস্বাভাবিক মৃত্যু দেখানো হয়েছে দেখে। এই পরিস্থিতিতে মানুষ তাকিয়েছিল মমতা কী বলেন, সে দিকে। এখানে আরও একটি ধর্ষণ প্রসঙ্গ ফিরে আসবে, ফিরে যেতে হবে ৩১ বছর আগের জুলাই মাসে।
মূক-বধির মেয়ের ধর্ষণের বিচার চাইতে ফেলানি বসাক মেয়েকে মমতার কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। তারপর ২১ জুলাই। সচিত্র ভোটার পরিচয়পত্রের দাবির পাশাপাশি ফেলানির মেয়ের ধর্ষণের অভিযোগে অভিযুক্তের শাস্তির দাবি নিয়ে সেই দিন মহাকরণে হাজির হয়েছিলেন মমতা। তৃণমূল কংগ্রেসের সেই আন্দোলন প্রতিহত করতে গিয়ে মারমুখী হয়ে উঠেছিল পুলিশ। প্রাণ যায় বহু তৃণমূল কর্মীর। যদিও মেয়ের প্রতি অন্যায়ের সুবিচার পাননি ফেলানি। সাপের কামড়ে নির্যাতিতার মৃত্যুর পর থেমে গিয়েছে বিচারপ্রক্রিয়াও। কিন্তু সেদিন থেকেই ন্যায়ের প্রতীক হিসেবে মানুষের মনে জায়গা করে নিয়েছিলেন বিরোধীনেত্রী মমতা।
সেই মমতায় ক্ষমতায় আসার কয়েক মাসের মধ্যে পার্ক স্ট্রিট গণধর্ষণ কাণ্ডে বলে বসলেন 'সাজানো ঘটনা'। কিন্তু আরজি কর কাণ্ডের শুরুতে শাসক হিসেবে পরিণতির পরিচয় দিয়ে মমতা এবার শুরুতে তেমন অসংবেদনশীল মন্তব্য করেননি। কিন্তু গোল বাঁধল যখন তিনি সন্দীপ ঘোষকে অন্যত্র সরানোর সিদ্ধান্ত সর্বসমক্ষে জানালেন। ছাত্র-ছাত্রীরা যখন সাধারণ মানুষের সামনে সন্দীপ ঘোষের বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ এনে ফেলছে, তখন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তার বিরুদ্ধে কেন কোনও ব্যবস্থা নিলেন না? কেন পুলিশ তাঁকে জেরা করল না? আগুনের ফুলকি দাবানল হয়ে গেল। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠল, প্রশাসক মমতা কি মানুষের মন বোঝার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলছেন?
পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষাব্যবস্থায় যে চূড়ান্ত দুর্নীতির বাস্তুতন্ত্র গজিয়েছে, তৃণমূল সমর্থকরাও অস্বীকার করতে পারবে না। কিন্তু স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় পচন যে এই মাত্রার, তা নাগরিক সমাজ ঠাহর করতে পারেনি। কেঁচো খুঁড়তে বেরিয়ে এল কেউটে। জানা গেল উত্তরবঙ্গ লবির কথা। যে লবির বিরুদ্ধে অভিযোগের তালিকা দীর্ঘ। কোথায় বদলি হবে, কোন ছাত্রের অনার্স থাকবে, টাকা দিয়ে প্রশ্ন কেনা— সব অনাচারেই জড়িয়ে এই উত্তরবঙ্গ লবির নাম। আর এই লবিরই এক সক্রিয় সদস্য সন্দীপ ঘোষ। তাঁর বিরুদ্ধে হাসপাতালের বর্জ্য পাচার, মর্গের লাশ পাচার, টেন্ডার পাইয়ে দেওয়া, অভিযোগের তালিকা অতিদীর্ঘ। জানা গেল থ্রেট সংস্কৃতি গড়ে তুলেছেন লবিবাজেরা, ভয়ের পরিসর গড়ে উঠেছে স্বাস্থ্য-শিক্ষার অন্দরে। এসব জানতেন না স্বাস্থ্যমন্ত্রী?
প্রশ্নের অভিঘাতে মানুষের রাগের পারদ চড়তে লাগল। এই মানুষ এক দশক মুখ বুজে সব সহ্য করেছেন। এবার দেওয়াল ভাঙার পালা। ফলে মানুষ স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে রাস্তায় নেমে যখন স্লোগান তুললেন 'we want justice', তা কিন্তু শুধু ধর্ষিতার ন্যায়বিচার, নারী সুরক্ষায় আটকে রইল না, একটা বিরাট সংগঠিত অপরাধতন্ত্রের অবসান হয়ে উঠল গণদাবি। প্রত্যেকের নিজস্ব দাবি মান্যতা পেতে শুরু করল। চিকিৎসক সমাজের দাবি, স্বাস্থ্যকর্মীদের দাবি, মেয়েদের দাবি, প্রতিটি বর্গের জোরালো দাবি সামনে এল, যা উড়িয়ে দেওয়া যায় না কিছুতেই।
কয়েক দশক গণদাবিকে সামনে রেখে গলা ফাটিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রাগের চালিকাশক্তি হয়ে উঠেছেন তিনি। রেগে যাওয়া মানুষকে আশ্বস্ত করেছেন তিনি। কিন্তু এমত অবস্থায় মানুষের কাছে তাঁর ন্যায়পতাকা বহনের জন্য কোনও 'মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়' রইল না। পুলিশি নিষ্ক্রিয়তা হোক অথবা স্বাস্থ্য ব্যবস্থার এই হাল, প্রতিটি প্রশ্নের শেষ বিন্দুতে তো তিনিই দাঁড়িয়ে। সারদা-নারদা, প্রাইমারি টেট দুর্নীতি, রেশন দুর্নীতি, তৃণমূল নেতাদের ঘনঘন জেলে যাওয়া, যেসব প্রশ্ন ধামাচাপা দেওয়া গিয়েছিল দীর্ঘদিন, সব ঝুলি থেকে বেরিয়ে এল। প্রত্যেক শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ ভাবতে শুরু করল, পথে নামার সময় এসেছে। বিরোধী মমতা শাসক মমতায় পর্যবসিত হয়েছেন, এবার মানুষের বিকল্প কে?
এই প্রথমবার বিকল্প হয়ে উঠতে হল মানুষকে নিজেকেই। শেষ লোকসভাতেও এ রাজ্যে ৩৮ শতাংশের কিছু বেশি ভোট পেয়েছে বিজেপি। কিন্তু ধর্মতলার মেট্রো চ্যানেলে বিজেপির ধর্না মঞ্চে বিজেপির তাঁবুর নেতা থাকলেও দু'শোটিও লোকও নেই। সিঙ্গুর নন্দীগ্রামের সময় এমন ধর্না মঞ্চে চুম্বক হয়ে বসেছিলেন মমতা, সামনে জমায়েত করেছিল লক্ষ লক্ষ মানুষ। কেন বিজেপিকে ভরসা করা গেল না? কারণ, মণিপুর, হাথরস, উন্নাও, বৃজভূষণ, ধর্মীয় মেরুকরণ ইত্যাদি। মোদ্দা কথা, নাগরিক সমাজ এবার নিজের কথাটুকু নিজেই বলতে চায়।
অতীতে বাংলায় মিছিলে ডাক দিয়েছে, পেশাদার মিছিল-করিয়েরা। এবার মিছিলের ডাক দিলেন এমন মানুষ, যাঁদের কোন পূর্ব অভিজ্ঞতাই নেই। যাঁদের কেউ চেনে না। তাঁরা যে স্ট্র্যাটেজি নিতে লাগলেন, তার শাসক বিরোধী পুলিশ সব পক্ষের অচেনা। রাতদখল, মানববন্ধন, ৯ মিনিটের স্তব্ধতার মতো স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ কীভাবে থামবে, ঠাহর করতে পারেনি পুলিশ। এরই পাশাপাশি আরজি কর হাসপাতালের জুনিয়র ডাক্তারেরা লাগাতার প্রতিবাদ করে গিয়েছেন। পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে দেখা করে তারই পদত্যাগ দাবি করেছেন। এখন, এই লেখার সময়ে ছ'টি দাবি নিয়ে স্বাস্থ্যভবনের সামনে বসে আছেন তাঁরা, যে দাবিগুলি আসলে ব্যবস্থার পূর্ণ সংস্কারের কথা বলে।
আরও পড়ুন: ‘মিথ্যা বলছেন মুখ্যমন্ত্রী’! টাকা দিয়ে চুপ করানো প্রসঙ্গে কী বললেন তিলোত্তমার মা?
শুধু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কেন, এই নাগরিক স্বতঃস্ফূর্ততার ব্যপ্তির আঁচ পাওয়া, তা মোকাবিলা করা দেশের যে কোনও নেতার পক্ষেই কঠিন। শাহিনবাগ থেকে কৃষক আন্দোলন, নাস্তানাবুদ করে তুলেছিল কেন্দ্রীয় সরকারকে। অনিশ্চয়তার বোধ থেকে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসের জন্ম হয়। সেই কারণেই আজ মমতার লব্জ 'উৎসবে ফিরুন'।
৩৪ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা একটা দলকে টেনে নামিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এক দশক দেশ জুড়ে বিজেপি রাজত্ব চালালেও বাংলা মমতার হাত থেকে যায়নি। সিপিএম বা বিজেপি মমতার কাছে অনেক সহজ প্রতিপক্ষ। তাদের কীভাবে ঠেকাতে হয় মমতা জানেন। কিন্তু নাগরিক-রোষের কোনও ওষুধ তার কাছে নেই। সেই কারণেই প্রথম দিন থেকে তিনি প্রতিবাদীদের রাম-বাম বলে দাগিয়ে দিতেও শুরু করেন।
এতে ফল হয়েছে উল্টো। মমতা যে ভুল বলছেন, তা প্রমাণে মরিয়া হয়ে উঠেছে নাগরিক সমাজ। মানুষ কতটা মরিয়া হলে রাস্তার দু'ধারে একটানা ১৬ কিলোমিটার মানববন্ধন তৈরি করা সম্ভব হয়? এই জনতাকে ঘুম পাড়ানো অলীক স্বপ্ন। মানুষ এখন তৃণমূলের প্রতিটি কাজের উত্তর চাইবে। মমতা বন্দ্যাোপাধ্যায়ের নিশ্চয়ই মনে পড়বে ফেলানি বসাকের মূক ও বধির কন্যাকে নিয়ে মহাকরণে ঢুকে যাওয়া এক দামাল নেত্রীর কথা।