আমরা বনাম ল্যাম্পপোস্টের নীচে দাঁড়ানো ওরা
ভদ্রবিত্ত তাকে কী ভাবল তাতে তার ভারী বয়ে গেল৷ সে জানে ভদ্রবিত্ত তার কাছে আসে -যায়। আবার আসে। সে একটি কেন্দ্রে স্থিত, ভদ্রলোক ঘূর্ণায়মান।
একজন যৌনকর্মী সম্পর্কে আমাদের সমাজে একটা তীব্র গা ঘিনঘিন আছে। যতই শিক্ষার আলো আসুক, যতই প্রগতির পতাকা বহন করি না কেন, যৌনকর্মীকে আমরা খাটো চোখে দেখবই। একজন সাধারণ পেশাজীবী তাকে ভাবতে পারব না কখনও। অসহায় মুহূর্তে, কাউকে আক্রমণ করতে হলে, তাকে যৌনকর্মীর সন্তান দাগিয়ে দিতে পারলেই হলো। কারও পোশাক পছন্দ না হলেই বলব, ওদের মতো। ডাক্তার থেকে কামার কোনো পেশাই সে অর্থে সর্বমান্য সামাজিক গালাগাল হয়ে ওঠেনি। একমাত্র যৌনকর্মী (প্রয়োগ: খানকি শব্দটি) আর মুচি (প্রয়োগ: চামার শব্দটি) সমাজে গাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়। চুরি অর্থাৎ একটি সামাজিক অপরাধের সঙ্গেই জুড়ে দেওয়া হয় চামারি। বাড়িতে যারা কাজ করেন তাদের ব্যাপারে ভয় থাকে, চুরি-চামারি করবে না তো? আর ঘৃণার সর্বোচ্চ পর্যায়ে আস্তিন থেকে বের হয় শেষ তাস, ঘৃণ্যকে বেশ্যার সন্তান ঘোষণা৷ প্রশ্ন হলো, এই আমরা-ওরার আমরাটা কারা? আমরা কী ভাবে এই মন অর্জন করলাম?
স্পষ্ট ভাবে বললে এই 'আমরা'-টা ভদ্রলোক সম্প্রদায়। যার জন্ম রাজশক্তির ভজনায়। রাজশক্তির সঙ্গে অত্যাচারী-অত্যাচারিত সম্পর্কের ভিয়েনে সে যায়নি৷ বরং প্রথম থেকেই আর্থিক নিরাপত্তা, অপেক্ষাকৃত কম শ্রমনির্ভর, অনেক বেশি অবকাশমুখর জীবন যাপনের সুযোগ পেয়েছে। কিছুকাল সে মুঘল রাজশক্তির জমিদার, মনসবদার, জমিদারের নায়েব হয়ে কাটিয়েছে। কিন্তু দানা বেঁধেছে ব্রিটিশ পুঁজির আনুকুল্যে। ব্রিটিশ আনুগত্যের মধ্যে দিয়ে আর্থিক এবং সাংস্কৃতিক পুঁজি অর্জন করেছে। প্রথমে লেখাপড়ার তারপর গাড়ি চড়ার অধিকার পেয়েছে। কেরানি, পোস্টমাস্টার, আমলা হয়েছে। ক্রমে তাদের নানা সংঘ তৈরি করেছে। সংঘগুলির সমষ্টিতে তৈরি হয়েছে সমাজ। গড়ে উঠেছে সমাজশর্ত। নির্মিত হয়েছে সেই কাঙ্খিত সমাজের অপর। যে অপর ভদ্রবিত্তের কৃষ্টি, যাপন এবং সমাজশর্তের থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছে। ব্রিটিশের সঙ্গে প্রথম থেকে যে অপর কোনো বোঝাপড়ায় যায়নি। বরং শাসক -শাসিতের সম্পর্ক তৈরি হয়েছে রাখঢাক না রেখে। বেত খেয়েছে, আঙুল গিয়েছে, জমি গিয়েছে, বেগার দিতে হয়েছে, নানা শ্রমনিবিড়, কায়িকশ্রম নির্ভর পেশা আঁকরে পড়ে থাকতে হয়েছে। এর মধ্যে আবার স্তরবিন্যাস আছে। যেমন কামার-কুমোর এরা 'ছোটলোক' কিন্তু অপাঙ্ক্তেয় নয়। কিন্তু নম:শূদ্র, আদিবাসী এবং মুসলমান সমাজ একেবারেই মার্জিনের বাইরে। তাদের সঙ্গে হিন্দু ভদ্রবিত্তের সম্পর্কে দীর্ঘ বোঝাপড়ার অভাব রয়েছে। সমানুভূতির অভাব রয়েছে। ঘৃণা আর বিশ্বাসঘাতকতা রয়েছে।
ঔপনিবেশিক কৃষ্টি-সংস্কৃতির বাহক এই শ্রেণি নারীকেও অপরের তালিকাভুক্ত রেখেছে। কখনও সমাজপ্রতিনিধি হিসেবে দেখতে চায়নি। সমর্পিত হিসেবেই দেখেছে। ক্ষেত্র বিশেষে কিছু ছাড়পত্র মিলেছে। যেমন সহমরণ রদ হয়েছে, বিধবা-বিবাহ আইন এসেছে, শিক্ষায় অংশীদারিত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু কৌমের মাথায় সে বসবে, তার হাতে সুলতানা রাজিয়ার মতো রাষ্ট্র পরিচালনার ভার থাকবে, এ জিনিস সে চায়নি। নারীকে সে দু'ভাগে ভেঙেছে, গৃহবধূ-বারবধূ। গৃহবধূ তার দেওয়া সমাজশর্তে খাপে খাপে এঁটে যায়। আর বারবধূ? অন্য অভদ্রজনের মতোই হীন, কেননা সে শর্তছুট, বেয়াড়া, সমর্পিত নয় স্বাধীন। নিজেদের তৈরি করা সমাজশর্ত থেকে বংশোদ্ভুত মেয়েরা যাতে পিছলে না যায় তার জন্যেই কড়া ভাবে বলবৎ হয়েছে বিধবার জীবনযাপনের যাবতীয় নিয়মকানুন। সে পেঁয়াজ -রসুন খেতে পারবে না কারণ তা কামোদ্দীপক। তাকে একাদশী করতে হবে। শুচিবায়ু মন সে যেন বাঁচিয়ে রাখে এবং পরের প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়। অর্থাৎ সমাজে সে থাকবে সমর্পিত (প্যাসিভ) পতির পুণ্য সতীর পুণ্য, অথবা ইচ্ছের ভারমুক্ত হয়ে।
এই যে নারীকে সেকেন্ড ক্লাস সিটিজেন হিসেবে রাখা, এই নৈতিক আদর্শও কিন্তু গৃহীত হয়েছে ইওরোপ থেকে। চ্যাস্টিটি বেল্টের গল্প আধুনিক ইওরোপে মুখে মুখে ফিরত। চ্যাস্টিটি বেল্ট একধরনের বর্ম যা দিয়ে যোনি আটকে রাখা যায়। প্রচলিত ছিল, মধ্যযুগে ইওরোপে গৃহিনীকে এই চ্যাস্টিটি বেল্ট পড়িয়ে যোদ্ধা যুদ্ধে যেত। নিজের অনুপস্থিতিতে যোনি অক্ষত রাখার ব্যবস্থা। ইওরোপীয় প্রভুর থেকে মধ্যস্বত্বভোগী, বেতনভুক, বুরোক্র্যাট সমাজ বিজ্ঞান, যুক্তির পাশাপাশি নৈতিকতার আদর্শেও দীক্ষা নিয়েছিল। সেই নৈতিকতার নিগড়েই তৈরি হয়েছিল সমাজের ভালো-খারাপের সংজ্ঞা। যা কিছু সমাজের বাঁধুনিটাকে প্রশ্ন করবে তাই খারাপ। সমকামিতা খারাপ। মদ্যপান খারাপ। বেশ্যাবৃত্তি খারাপ। অক্ষতযোনি অসূর্যম্পশ্যা রমণী ভালো, দিনে একবার খাবার পাওয়া বালিকা বিধবা ভালো। আমার ঘরে ভালোর ঠাঁই। ভালোকে আরও কষে বাঁধার জন্য ধর্মীয় অনুশাসন এসেছে।
মজার দিকটা হলো, এই ভালোর সঙ্গে সহবাসে তারা ক্লান্তও হতো। কাজেই কেউ কেউ বিদ্রোহ ঘোষণা করত। কেউ কেউ বারবাড়ি গমন করত। কিন্তু বারবাড়ি বা রাঁড়বাড়ির সঙ্গে গৃহস্থবাড়ি কখনও মিলত না। চর্যাপদে দেখা যায় অন্তজ্যজনের (ডোম জাতীয় স্ত্রীলোক) ঘর সমাজের বাইরে। ব্রাহ্মণ সেখানে লুকিয়ে যায়।
নগর বাহিরেরেঁ ডোম্বি তোহারি কুড়িআ
ছোই ছোই যাইসো ব্রাহ্ম নাড়িআ।।
একই ছবি দেখা গিয়েছে উনিশ-কুড়ি দশকের গার্হস্থ্য সমাজে। সমাজের পরিধির বাইরে সে রেখেছে যা কিছু অভদ্রজনোচিত। বেশ্যালয়, শ্রমিক মহল্লা, গ্রাম, নম:শূদ্র, আদিবাসী, মুসলমানের বসতি। নিজেকে একটা কৌটোর মধ্যে ভরে সে অবদমনের যন্ত্রনাভোগ করেছে। নিজের তৈরি করা শৃঙ্খল ভেঙেছে। ফের খাঁচায় ফিরে এসেছে। কখনও বাড়ি আর বেশ্যালয় মেলেনি, ছোটলোক -ভদ্রলোক মেলেনি।
মনে রাখব, এই ভদ্রজন কিন্তু চিরকাল সংখ্যার বিচারে কম৷ কিন্তু সমাজের সমস্ত বড় জায়গায় তার ষোলোআনা প্রতিনিধিত্ব রয়েছে প্রথম থেকে, সেইটেই তার অহংকার, অলংকার, শক্তি। এই শক্তির গৌরবে তারা আচ্ছন্ন থাকে, এই শক্তিবিচ্যুতি তারা পছন্দ করে না, সমাজ ভাঙার যে কোনো অনুঘটককে তারা মূল্য ধরে দিয়ে বিদেয় দিতে চায়। ব্যক্তিগত চাওয়াপাওয়ার থেকে এগিয়ে রাখে সমাজের শর্তগুলিতে। মেয়ে সুখে নেই, তবু তাকে শ্বশুরবাড়িতে পড়ে থাকতে হবে, কারণ না হলে সমাজে মুখ দেখানো যাবে না। সমাজের মুখ হিসেবে নিজেকে রাখতেই হবে, যে কোনো শর্তে। এই জাঁতাকল তার মধ্যে বিষাদবোধ সঞ্চার করে। ছোটলোককে দাবিয়ে রাখার ক্ষমতাময় আনন্দে আর সমাজশর্তে ফিট করার বিষাদে তার জীবন কাটে।
আর এই যে অপরের একজন, এক যৌনশ্রমকর্মী ভদ্রবিত্তের এই অপরায়নে সঙ্গে তার বোঝাপড়া কেমন?প্রাচীন ভারত যৌনকর্মীদের বিষয়ে অনেক উদার ছিল। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে আছে, বার্ধক্য ভাতা পেতেন যৌনকর্মীরা। আম্রপালীর প্রেমে পড়েছিলেন বিম্বিসার। কাশ্মীরি কবি দামোদর গুপ্তর প্রধান পরামর্শদাতা একজন যৌনকর্মী। দেখা যাচ্ছে সমাজে যৌনকর্মীরা ছিলেন কেন্দ্রস্থিত। রাজসম্মান, স্বীকৃতি সবই পেতেন তাঁরা। ক্রমে তাঁরা চলে গেলেন প্রান্তে। পেশায় স্বাচ্ছন্দ্যের চেয়ে অস্বাচ্ছন্দ্যের পাল্লা ভারী হলো। যে সমাজে তারা ব্রাত্য সেই সমাজকে কিন্তু তারা দিয়েছেন। সন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অক্ষরমালায় বারবণিতা গ্রন্থে পড়েছি, ১৯২২ সালে উত্তরবঙ্গে ভয়াবহ বন্যা হলে রাস্তায় ভিক্ষে করে রিলিফ ফান্ডে টাকা দিয়েছেন যৌনকর্মীরা। যৌনকর্মীরা যোগ দিয়েছেন অসহযোগ আন্দোলনে। সমাজ পরিত্যক্ত মেয়েরাই প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেছেন বাংলা থিয়েটার, গান, সিনেমার। কিন্তু ক্রমে শহর, ভদ্রবিত্তের সভ্যতা তাদের কোনঠাসা করেছে, যৌনপল্লিগুলির সীমানা সংকুচিত হয়েছে।
যৌনকর্মীরা এ পেশায় আসেন সেতু পুড়িয়ে। বাধ্যতায়। খুব কমই স্বেছায়। দেহ একমাত্র পুঁজি। একমাত্র পণ্য। সেই পুঁজিকে যত সাজিয়ে রাখা যাবে, যত বেশি বিক্রয় করা যাবে, যত লয়াল কাস্টমার/ রিটার্নিং ইউজার পাওয়া যাবে ততই তার অস্তিত্ব রক্ষা সহজ হবে। হাতে বেশি টাকা এলে ঘরভাড়া ও আনুষঙ্গিক খরচ দিয়ে কিছু সঞ্চয় করা যাবে। অর্থ বাচ্যার্থে ক্ষমতা। এই সাধারণ তত্ত্বে তামাম যৌনকর্মী কয়েক শতক বেঁচে আছে। ভদ্রবিত্ত তাকে কী ভাবল তাতে তার ভারী বয়ে গেল। সে জানে ভদ্রবিত্ত তার কাছে আসে -যায়। আবার আসে। সে একটি কেন্দ্রে স্থিত, ভদ্রলোক ঘূর্ণায়মান। সমাজ তাকে সামাজিকতায় অংশগ্রহণ করতে দেবে না সে জানে। এতে তার অভিমান আছে, দুঃখ আছে, কিন্তু একটা সময়, কারক প্রকরণ শিখে নেওয়ার পর জ্বালা জুড়িয়ে যায়। দিনযাপনের গ্লানি এমন, রোজগারের তাড়না এমন, কায়িক শ্রম এত বেশি যে, কে কী ভাবল, কে কী চোখে দেখছে তা নিয়ে ভাবার দু'দণ্ড অবসর তার থাকে না। রোজগারের জন্য তাকে ভিক্ষে চাইতে হচ্ছে না, মোসায়েবি করতে হচ্ছে না, তার রোজগারের ষোলো আনা ঘামের নুনে ভেজা, তার পিছুটান নেই, সামাজিক ভণ্ডামিতে অংশ নেওয়ার দায় নেই-এই বোধ যৌনকর্মীর মনকে ক্রমে স্বাধীনতা দেয়। কতটা স্বাধীনতা? এ বিষয়ে একটা আন্তর্জাতিক গল্প বলেই আজ শেষ করব।
সারা বিশ্ব জানে ইজরায়েল প্যালেস্টাইনে কত বড় গণহত্যা চালিয়েছে। কিন্তু বিশ্বের নামকরা সেলিব্রিটিরা তা নিয়ে কথা বলেন না। ভদ্রলোক সমাজ চুপ করে থাকে। মেনে নেয়। কেন? কারণ যে মার খাচ্ছে সে জাতে মুসলমান। তাছাড়া পাছে কাজ যায়! পাছে শক্তিমান রাগ করে! মিয়া খলিফা প্রাক্তন পর্নস্টার, তাঁর হারানোর কিছু নেই। কাজ ছাড়ার দশবছর পরেও ভদ্রসমাজ তাঁর দিকে ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকায়। তিনি মন্তব্য করেন,
"আপনি যদি প্যালেস্তাইনের পরিস্থিতি দেখেও প্যালেস্তিনীয়দের পক্ষে নিজের সমর্থন প্রকাশ না করেন, তা হলে আপনি ভুল করছেন। ইতিহাস তা প্রমাণ করবে।"
এই মন্তব্যের মূল্য দিতে হয়েছে তাঁকে। কয়েক কোটি টাকার চুক্তি বাতিল করেছে বেশ কয়েকটি প্রাতিষ্ঠানিক মিডিয়া ও বাণিজ্যগোষ্ঠী। মিয়া নিজের মতামত থেকে সরে আসেননি। কারণ তিনি জানেন, দশ বছর পর্ন ইন্ড্রাস্ট্রিতে না থাকলেও তিনি ওরা-র দলে, সকলে তাঁকে সমাজবিচ্যুত যৌনকর্মীই ভাববে। লুকিয়ে তাঁর যৌনদৃশ্য দেখবে। আর প্রকাশ্যে তাঁকেই ছি ছি করবে। মিয়া এই ভণ্ডামির মুখোশটা টেনে ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছেন। মিয়াকে কোথাও ফিরতে হবে না। ভদ্রবিত্তকে আসতে হবে বারবার তাঁর দ্বারে।
এই সত্য মাথায় নিয়েই একজন যৌনকর্মীর বাঁচা। নিজস্ব জীবনবৃত্ত, চাওয়াপাওয়ার পৃথিবী গড়ে তোলা। শ্রমের সঞ্চয়ে ছোট ছোট স্বপ্নপূরণ। ভদ্রলোকের সঙ্গে সে আছে পারস্পরিক তাচ্ছিল্যের সম্পর্কে। ভদ্রবিত্ত বন্ধনীতে তার জায়গা নেই। ভদ্রলোক বন্ধনী বাড়াবে না কখনও। বাড়িতে খাবার টেবিলে শালীনতা, আঁচল খসা নিয়ে নীচু গলায় পরিশীলিত আলোচনা হবে।