'মঞ্চে আসলে তিন জন!' অন্তঃসত্ত্বা নাদার তরোয়ালের লড়াইয়ে মুগ্ধ অলিম্পিকের আসর

Paris Olympics 2024: মিশরের কন্যা ছাব্বিশ বছরের নাদা হাফেজ ফেন্সার হিসেবে অংশ নিয়েছিলেন অলিম্পিকে। তবে এবার তিনি একা লড়েননি। এবার তাঁকে তাঁর লড়াইয়ে সঙ্গ দিয়েছে তাঁর গর্ভে থাকা সন্তান।

অন্তঃসত্ত্বা শুনলেই মেয়েদের 'দুর্বলতর'দের সারিতে ঢুকিয়ে দেওয়ার একটা প্রবণতা রয়ে গিয়েছে সমাজের অন্দরে। কখনও কখনও তা তাঁর নিরাপত্তার খাতিরে হলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এ ব্যাপারে পুরোপুরি কাজ করে সামাজিক ট্যাবু। সেই কারণেই হয়তো বেবি বাম্প নিয়ে একগুচ্ছ প্রশ্নের মুখে পড়তে হয় দীপিকা পাডুকোনকে। তবে সমাজের সেই সমস্ত প্রশ্নের মুখে একদমকায় জবাব লিখে দেন নাদা হাফেজের মতো মেয়েরা। প্যারিস অলিম্পিকের মঞ্চ যাঁকে মনে রাখবে আজীবন।

মিশরের কন্যা ছাব্বিশ বছরের নাদা হাফেজ ফেন্সার হিসেবে অংশ নিয়েছিলেন অলিম্পিকে। তবে এবার তিনি একা লড়েননি। এবার তাঁকে তাঁর লড়াইয়ে সঙ্গ দিয়েছে তাঁর গর্ভে থাকা সন্তান। আর মাত্র তিন মাসের মধ্যেই পৃথিবীর আলো দেখার কথা যার। গর্ভাবস্থায় মেয়েদের শরীরে নানা ধরনের অসুবিধা, ব্যথাবেদনা লেগেই থাকে। কিন্তু নাদার মনের জোরের কাছে পিছু হঠতে বাধ্য হয়েছে সেসব। নাদা লড়েছেন, জান-প্রাণ দিয়ে লড়েছেন।

আরও পড়ুন:শুটিংয়ের সবচেয়ে কঠিন ইভেন্টে জয়! যে ভাবে ভারতকে পদক এনে দিলেন স্বপ্নিল 

পেশায় প্যাথোলজিস্ট নাদা এ নিয়ে তৃতীয়বার অলিম্পিকে। এর আগে রিয়ো ও টোকিয়োর অলিম্পিকে অংশ নিয়েছেন ২৬ বছরের এই কন্যা। প্যারিসে প্রথম ম্যাচে নাদার প্রতিপক্ষ ছিলেন মহিলাদের ফেন্সিংয়ে বিশ্বক্রমতালিকায় ১০ নম্বরে থাকা আমেরিকার এলিজাবেথ তার্তাকোভস্কি। তাঁকে হারিয়ে অলিম্পিকের যাত্রা শুরু করেন নাদা। ১৫-১৩ ব্যবধানে জিতে নজর কেড়েছিলেন তিনি। তবে শেষ ১৬-র লড়াইয়ে নেমে দক্ষিণ কোরিয়ার হা ইয়াং জিয়ানের কাছে পরাজিত হল তাঁকে। সেই সময় তিনি তলোয়ার হাতে হাতে তুলে নিয়েছিলেন, যে সময় তাঁর গর্ভে বেড়ে উঠছে সন্তান। ফলত হারজিতকে ভেদ করে তাঁর এই লড়াই-ই যে আসলে জিতে যাওয়া, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

জিয়ানের কাছে ৭-১৫ ব্যবধানে ম্যাচ হারের পর নাদা প্রকাশ্য়ে আনেন তাঁর অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার কথা। গর্বিত নাদা জানান, "মঞ্চে দু' জন খেলোয়াড়কে দেখতে পাচ্ছেন আপনারা। কিন্তু আদতে সেখানে তিনজন ছিল। আমি, আমার প্রতিযোগীর পাশাপাশি আমার সঙ্গেই রয়েছে আমার সন্তান, যে এখনও পৃথিবীর আলো দেখেনি। এই চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি শুধু আমি হইনি, হয়েছে আমার অনাগত সন্তানও। আমরা সমান অংশিদার ছিলাম এই লড়াইয়ের, তা শারীরিক বা মানসিক, যা-ই হোক না কেন।" নাদা আরও জানান, ‘‘আমি এবং আমার সন্তান প্রতিপক্ষকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলতে পেরেছি। শারীরিক এবং মানসিক ভাবে আমরা লড়াই করতে পেরেছি। এটা গর্বের। এই লড়াই আমার সত্তাকে পূর্ণতা দিয়েছে।’’ তাঁর এই ঘোষণা কার্যত চমকে দিয়েছে অলিম্পিকের মঞ্চকে।

সহজ নয় গর্ভে সাত মাসের সন্তানকে নিয়ে দেশের জন্য লড়াই। আর সেটাই দক্ষতার সঙ্গে করেছেন নাদা। খেলায় হার-জিত থাকেই, হয়তো অলিম্পিকে সেই কাঙ্ক্ষিত জয় ছিনিয়ে আনতে পারেননি তিনি, কিন্তু যা পেরেছেন, তা জয়ের চেয়ে কোনও অংশে কম নয়। সাত মাসের গর্ভাবস্থায় অলিম্পিক্স খেলতে আসা নাদাকে কুর্নিশ জানিয়েছেন বিভিন্ন দেশের খেলোয়াড়েরা। প্রশংসায় ভরিয়ে দিয়েছেন ক্রীড়াপ্রেমীরাও। নাদা এই লড়াইয়ে পাশে থাকার জন্য ধন্যবাদ দিয়েছেন তাঁর স্বামী ইব্রাহিম ও পরিবারকে। কায়রোর বাসিন্দা নাদা ইনস্টাগ্রামে একটি পোস্টে জানান, ‘‘গর্ভাবস্থার এই যাত্রা সহজ নয়। জীবন এবং খেলার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রেখে এই লড়াই আমার কাছেও সহজ ছিল না। তাই এই লড়াই আমার কাছে খুব মূল্যবান। স্বামী এবং পরিবারের অন্যদের পাশে না পেলে এত দূর আসতে পারতাম না।’’

 
 
 
 
 
View this post on Instagram
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 

A post shared by Nada Hafez (@nada_hafez)

২০১৪ সালে মিশরীয় জাতীয় সিনিয়র মহিলা সাবের ফেন্সিং দলে যোগ দেন নাদা। পরের বছর, তিনি মিশরীয় সিনিয়র মহিলা সাবের জাতীয় প্রজাতন্ত্র প্রতিযোগিতায় প্রথমবার জয়লাভ। এরপর আলজেরিয়ায় আফ্রিকান জোনাল জিতে পৌঁছে যান ২০১৬ রিও অলিম্পিকে। ২০২১ সালে তিনি আবার অলিম্পিকে একটি স্থান দখল করেন। বছরের পর বছর ধরে তিনি ২০১৮ আফ্রিকান জোনাল চ্যাম্পিয়নশিপে রুপোর পদক এবং ২০১৪ এবং ২০১৯ সালে ব্রোঞ্জ পদক অর্জন করেছিলেন। একাধারে বেলজিয়াম টুরনোই স্যাটেলাইটে একটি ব্রোঞ্জ পদক জিতে ছিলেন নাদা।

আরও পড়ুন:নেই স্পেশাল চশমা, পকেটে হাত ভরেই যেভাবে অলিম্পিকে রুপো জিতলেন ৫১-র যুবক

এই ফেন্সিং কিন্তু আদতেও সহজ খেলা নয়। শারীরিক ভাবে বেশ চ্যালেঞ্জিং এই স্পোর্টস। গতির পাশাপাশি তৎপরতা ও কৌশল প্রয়োজন হয় এই খেলায়। এই খেলাটিকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে ফয়েল, এপি এবং সাবার। ফেন্সিং আসলে যুদ্ধের খেলা, যেখানে দুইজন ক্রীড়াবিদ একে অপরের বিরুদ্ধে আক্রমণ ও রক্ষার জন্য তলোয়ার ব্যবহার করে। এতে তলোয়ারধারীরা প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করে পয়েন্ট অর্জন করে। সাধারণ ভাবে ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের এই খেলায় অংশগ্রহণ কম। কারণ তাঁদের সামনে তেমন কোনও রোল মডেল বা মেন্টর নেই বললেই চলে। তা সত্ত্বেও নাদাদের মতো মেয়েরা জমি শক্ত করছেন এই খেলাটির। হয়তো আগামী প্রজন্মের কাছে তাঁরাই হয়ে উঠবেন পথপ্রদর্শক। কিন্তু শুধু ফেন্সিংয়ের জন্য নয়, নাদাকে দুনিয়া মনে রাখবেন তাঁর অপরিসীম সাহস আর মনের জোরের জন্য। যা আসলে সমাজের রক্ষণশীলতাগুলোকে ভেঙে নিয়ে আসে নতুন সকাল।

 

More Articles