ইডি হানা দেয়নি কখনই! বন্ডের বিনিময়ে বিজেপির থেকে কী কী সুবিধে নিয়েছেন লক্ষ্মী মিত্তল?
Lakshmi Mittal Electoral Bond: বিজেপি সরকার এত বছর ধরে লক্ষ্মী মিত্তলকে চোখের মণির মতো রক্ষা করে গেছে। এর জন্যই হয়তো মিত্তল গোষ্ঠীতে কখনও ইডির তল্লাশি হয়নি।
শীর্ষ আদালত ১২ মার্চের মধ্যে এসবিআইয়ের থেকে বন্ডের আলফা- নিউমারিক নম্বর সহ বাকি তথ্য চেয়েছিল। এবার কোনও রকম টালবাহানা ছাড়াই, সময়ের মধ্যে সেই তথ্য দিয়েছিল এসবিআই। কিন্তু সেদিন প্রায় সব মূল ধারার সংবাদমাধ্যমই সন্ধের পর থেকে প্রচার করেছে কেজরিওয়ালের গ্রেফতারি নিয়ে। সেদিন সন্ধের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ ছিল ইলেক্টোরাল বন্ডের ইউনিক নম্বরের প্রকাশ, তা তারা গুরুত্বই দেয়নি। আগেই জানা গিয়েছিল, ব্যক্তিগত অনুদানের তালিকা অনুযায়ী শীর্ষে রয়েছে লক্ষ্মী মিত্তলের নাম। সর্বোচ্চ অর্থের বন্ড কিনেছেন তিনি। নির্বাচনী বন্ডে প্রায় ৩৫ কোটি টাকা দিয়েছেন মিত্তল। এসবিআইয়ের আলফা-নিউমারিক নম্বর প্রকাশের পর, তা মিলিয়ে দেখা গেছে, লক্ষ্মী মিত্তল পুরো চাঁদাই দিয়েছেন বিজেপি সরকারকে। লক্ষ্মী মিত্তল বিশ্বের বৃহত্তম ইস্পাত প্রস্তুতকারী সংস্থা 'আর্সেলরমিত্তল'- এর মালিক। অপরদিকে আবার দেখা গেছে, বিজেপির আনা ইলেক্টোরাল বন্ডের কৌশলে বিজেপিই পেয়েছে ৫০.০৩ শতাংশ বন্ড। কিছু তথ্য তলিয়ে দেখলে মিত্তলের সঙ্গে গেরুয়া শিবিরের দেনাপাওনার হিসাব সামনে আসছে। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে, এত টাকার চাঁদা শুধুমাত্র একটি রাজনৈতিক দলকেই কেন দিলেন মিত্তল? অনুদানের বিনিময়ে কী কী বাড়তি সুবিধে নিয়েছেন লক্ষ্মী মিত্তল?
গৌরী লঙ্কেশের লেখা একটি প্রতিবেদনে অভিযোগ ছিল, আদিবাসীদের উচ্ছেদ করে ঝাড়খণ্ড রাজ্য সরকার মিত্তল গোষ্ঠীকে জমি পাইয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। ২০১২ সালের ২৯ নভেম্বর, কন্নড় ভাষায় প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনের শিরোনামটির বাংলা অনুবাদ হলো 'দয়ামণি বার্লার মর্মবেদনা'। ওই প্রতিবেদনে লঙ্কেশ উল্লেখ করেছিলেন, আদিবাসী দিনমজুর পরিবারের মেয়ে দয়ামণির কথা। মহাজন তাঁদের একমাত্র সম্বল এক টুকরো জমিও ছিনিয়ে নিয়েছিল। বাবাও হিসেবনিকেশে খুব একটা সড়গড় ছিলেন না। ক্লাস সেভেনের পর ঝাড়খণ্ডের গ্রাম ছেড়ে রাঁচিতে গিয়ে উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন দয়ামণি। কোনওভাবে নিজের খরচ নিজে চালিয়েই স্নাতকও হয়েছেন তিনি। একটা সময় অন্যের বাড়িতে কাজ করে, এঁটোকাঁটা খেয়েও জীবন কাটিয়েছেন। তার মধ্যেই 'কোয়েল-কারো' প্রকল্পের বিরুদ্ধে আন্দোলন জোরদার হয়। তখনই দয়ামণি উপলব্ধি করেন, সম্প্রদায়কে বাঁচাতে হলে জঙ্গল, জমি, নদী রক্ষা করতে হবে। আদিবাসীদের কথা প্রচার করার জন্য ব্যাঙ্ক থেকে ২৫,০০০ টাকা ঋণ নিয়ে 'জন হক' পত্রিকা চালু করেন দয়ামণি। 'আদিবাসী মূলবাসী অস্তিত্ব রক্ষা সমিতি' নামের সংগঠনও তৈরি করেন। জনসাধারণের তীব্র প্রতিবাদে 'কোয়েল-কারো' প্রকল্প বাতিল করলেও কিছু বছরেই সুযোগ সন্ধানী লক্ষ্মী মিত্তল নতুন সমস্যা তৈরি করেন। তাঁর কোম্পানির ইস্পাত কারখানা তৈরির জন্য ঝাড়খণ্ড সরকারের কাছে ১২,০০০ একর জমি দান করার জন্য আবেদন করেন মিত্তল। সরকার আবেদন মেনে নিয়ে ৪৫ টি গ্রাম রীতিমতো ধূলিসাৎ করে এবং ৭০,০০০ আদিবাসীকে উচ্ছেদের প্রস্তুতিও শুরু করে দেয়।
আরও পড়ুন- ইলেক্টোরাল বন্ডে সবচেয়ে বেশি টাকা অনুদান! কে এই লক্ষ্মী মিত্তল?
দয়ামণির নেতৃত্বে সরকারের বিরুদ্ধে আবারও আন্দোলনে নামে গ্রামবাসী। আন্দোলন এতটাই জোরদার হয়েছিল যে, সরকারের পক্ষে কোম্পানিটিকে ১ একর জমি দেওয়ারও সাধ্য হয়নি। পরবর্তীতে আদিবাসী যোগ্য প্রার্থীদের 'জব কার্ড' দেওয়ার দাবিতে সবর হওয়ার কারণে জেলে পাঠানো হয় দয়ামণি বার্লাকে। গৌরী লঙ্কেশ বলেছিলেন, "মিত্তলের মতো খলনায়ককে রুখে দেওয়া দয়ামণির, জামিন হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে জেলবন্দি করেই রাখা হয়েছিল।" অন্যদিকে, একই সময় কর্নাটকের ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকার মিত্তল সংস্থাকে জমি পাইয়ে দিয়েছিল। উল্লেখিত ঘটনাটি 'ইলেক্টোরাল বন্ড' চালু হওয়ার আগের হলেও, একথা বলতেই হয় গৌরী লঙ্কেশ এই প্রতিবেদন না লিখলে জানাই হতো না, বিজেপি সরকার এত বছর ধরে লক্ষ্মী মিত্তলকে চোখের মণির মতো রক্ষা করে গেছে। এর জন্যই হয়তো মিত্তল গোষ্ঠীতে কখনও ইডির তল্লাশি হয়নি।
প্রসঙ্গত, ২০২৩ সালে মিত্তলের সংস্থার অফিস খোলা হয়েছে সল্টলেকের সেক্টর ফাইভে। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়, ইউনিসেফ, ব্রিটেনের গ্রেট অরমন্ড স্ট্রিট হাসপাতালে অনুদান দিয়ে থাকেন মিত্তল। ২০১৯ সালে লোকসভা ভোটের দোরগোড়ায় ৩৫ কোটি টাকার ইলেক্টোরাল বন্ড কিনেছিলেন তিনি। তারপরই ২০২২ সালে, গুজরাতে মিত্তল গোষ্ঠীর ইস্পাত কারখানার সম্প্রসারণে দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি উপস্থিত হন। রাজনৈতিক মহলের অনেকের আশঙ্কা ছিল, দাঁড়িপাল্লার ওজন সমান করতে একাধিক দলের জন্যও বন্ড কিনতেই পারেন মিত্তল। বিশ্বের ধনী ব্যাক্তিদের মধ্যে ৯৩ তম এবং ভারতের নিরিখে ১৫ তম স্থানে রয়েছে তাঁর নাম। একদিকে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়, ইউনিসেফ, ব্রিটেনের গ্রেট অরমন্ড স্ট্রিট হাসপাতাল সহ ইলেক্টোরাল বন্ডে অনুদান দেওয়া ১৬.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার কোম্পানির মালিক আদিবাসী জমি অধিগ্রহণ করে কারখানা বানাতে চান! অন্য দিকে, আদিবাসী মহিলা ভিটে-মাটির লড়াই প্রচারের জন্য ২৫,০০০ টাকা ঋণ করেন। পরবর্তীতে ২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনে আপ-এর প্রার্থী হয়েছিলেন দয়ামণি।
আরও পড়ুন- কেজরিওয়ালের গ্রেফতারির নেপথ্যেও নির্বাচনী বন্ড! কীভাবে?
ইন্ডিয়া টুডে কনক্লেভের মঞ্চ থেকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ দাবি করেছেন, নির্বাচনী বন্ড মারফত ২০টি রাজনৈতিক দল মোট ২০,০০০ কোটি টাকা চাঁদা পেয়েছে। তার মধ্যে বিজেপি নাকি শুধু মাত্র ৬,০০০ কোটি টাকাই পেয়েছে। কিন্তু এসবিআইয়ের দেওয়া তথ্য বলছে, ইলেক্টোরাল বন্ডে ২০টি রাজনৈতিক দল মোট ১৬,৪৯২ কোটি টাকা পেয়েছে। যার মধ্যে বিজেপি একাই পেয়েছে ৮,২৫২ কোটি টাকা, যা পুরো অনুদানের ৫০.০৩ শতাংশ। প্রশ্ন উঠছে, জাতীয় স্তরের সংবাদমাধ্যমের মঞ্চ থেকে দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এত বড় মিথ্যে কথা কেনই বা বললেন, আর অনুষ্ঠানের পরিচালক রাহুল কানওয়ালও কেন আসল তথ্য জানিয়ে দিলেন না? পরিচালক কি জানতেন না, নাকি জানাতে চান না?
বিজেপির ৪০০ আসনের স্বপ্নের কি পথের কাঁটা হয়ে গেল ইলেক্টোরাল বন্ড? নাকি মূল ধারার সংবাদমাধ্যমগুলি আসল তথ্য প্রচার না করে সহজেই বিজেপির আশা পূরণ করে দেবে?