পান থেকে চুন খসলে ইলেকট্রিক শক! বিদেশে চাকরির নামে যেভাবে নয়া দাসত্বের শিকার ভারতীয়রা
Job Rackets in Myanmar: মেয়েদের দিয়ে সেইসব কাস্টমারের সঙ্গে ফোনে কথা বলাতো। যাতে ব্যাপারটা বিশ্বাসযোগ্য হয়। প্রথম প্রথম ১০০ কি ২০০ ডলার লগ্নিতে ভালো লাভ করতেন ক্রেতারা।
“পনেরোয় অগাস্ট অবশেষে মুক্তি!” বলতে বলতে গলার স্বর কেঁপে যাচ্ছিল স্টিফেনের। স্টিফেন ওয়েসলির বয়েস ২৯। বাড়ি কোয়েম্বাটুর। পেশায় টেকনিশিয়ান। তামিলনাড়ুর যে ১৩ জনকে উদ্ধার করেছে পুলিশ তার মধ্যে স্টিফেনও ছিল। বয়ান দেওয়ার সময় আরেকবার তিনি ফিরে গেলেন সেই ভয়ঙ্কর স্মৃতিদের কাছে। সেই অফিস যেখানে ৮০০ জনেরও বেশি ভারতীয় বন্দি ছিলেন। তাঁদের দিয়ে সাইবার ক্রাইমে বাধ্য করা হত উদয়াস্ত। হঠাৎ করেই সেখানে ঢুকে পড়েছিল মায়ানমারের মিলিটারি। সবাইকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল মিলিটারি হেড কোয়ার্টারে। প্রচুর জেরা করা হয়। পরে আবার সেই অফিসেই হতভাগ্য মানুষগুলিকে নামিয়ে দিয়ে যায় মায়ানমার মিলিটারি। প্রতিটি মানুষের মনে তখন ভয়, এবার কী হবে! কী অত্যাচার নেমে আসবে তারই দিন গুনছিলেন তাঁরা।
বেঙ্গালুরুর গ্রাফিক ডিজাইনার হিসেবে কাজ করতেন স্টিফেন। ২০২০-তে মহামারীর পরে তিনি কোয়েম্বাটোর চলে আসেন। ফ্রিল্যান্স কনসালটেন্ট হিসেবে কাজ শুরু করেন। কাজ ঠিকঠাকই চলছিল। এ বছর জুলাই নাগাদ একটি তাঁর বন্ধুবান্ধব মারফত একটা নিয়োগ সংস্থার খোঁজ পান। সেই সংস্থাই থাইল্যান্ডে একটা চাকরির সন্ধান দেয়। ইন্টারভিউ দুবাইয়ে। চাকরির স্বপ্ন নিয়ে দুবাই পাড়ি দেন স্টিফেন। মোট সাতজনের ইন্টারভিউ হয়। সেই দলে একজন মহিলাও ছিলেন। সামনাসামনি ইন্টারভিউ হয়, ভিডিও কনফারেন্সেও ইন্টারভিউ হয়। একরকম সব ঠিকঠাক। জানানো হয়, সাতজনই চাকরি পেয়েছেন। তাঁদের এবার থাইল্যান্ডে যেতে হবে। দিন পনেরো দুবাইয়ে থেকে তাঁরা ব্যাঙ্ককের প্লেন ধরলেন। তবে ওয়র্ক ভিসা তাঁদের দেওয়া হয়নি। ব্যাঙ্ককের এয়ারপোর্ট থেকে কয়েকজন স্থানীয় থাই বাসিন্দা তাঁদের নিতে আসেন। তাঁরাই অ্যারাইভাল ভিসার ব্যবস্থা করেন। এয়ারপোর্ট থেকে দু’টি ট্যাক্সি তাঁদের নিয়ে রওনা দেয় মে সতের পথে। এই পর্যন্ত সবই ঠিক ছিল। কিন্তু রাস্তা আর শেষ হয় না। ক্রমে শহর ছাড়িয়ে ফাঁকা এলাকার দিকে এগোতে থাকে গাড়ি।
আরও পড়ুন- বাজার আগুন, বুকিংয়ের চাপ! যেভাবে পুজো কাটে গাড়িচালকদের
মে সত ব্যাঙ্কক থেকে প্রায় ৪৫০ কিমি দূরে। মাঝরাস্তায় হঠাৎ ট্যাক্সি দু’টি থেমে যায়। সাতজনকেই ট্রাকে তোলা হয়। ভয় তখন জাঁকিয়ে বসেছে চাকরিপ্রার্থীদের মধ্যে। সেই ট্রাক এসে দাঁড়ায় গভীর জঙ্গলে। জঙ্গলের মাঝে সে এলাকায় প্রায় তিনশোটির মতন খাটাল। পাশেই নদী। সাতজনকে বাধ্য করা হয় একটি বোটে করে নদী ওপারে যেতে। তারপর মিলিটারির ইউনিফর্ম পরা বন্দুক হাতে কয়েকজন লোকের জিম্মায় সাতজনকেই রেখে আসে স্থানীয় লোকগুলি। স্টিফেনদের বন্দুকের সামনে মিনিট পনেরো নিল ডাউন করিয়ে রাখে তারা। পাসপোর্টের ছবি তোলে। তারপর অন্য একটি গাড়ি আসে। সেই গাড়িতেই সাতজনকে ছেড়ে আসা হয় অফিসে, কয়েক কিলোমিটারের রাস্তা।
এইটুকুনি বদ্ধ একটা অফিস। সেখানে নানা রকমের চাপ দিয়ে বছর খানেকের চুক্তিতে সই করানো হয় সবাইকে। তখনও অবধি কেউই বুঝতে পারছিলেন না যে তাঁদের দিয়ে কী ধরনের কাজ করানো হবে! ম্যানেজমেন্ট যখন পাসপোর্ট বাজেয়াপ্ত করে কাজ বুঝিয়ে বলল, তখন স্টিফেনরা আরও ভয় পেলেন। এ তো ক্রিপ্টোকারেন্সি ফ্রডের কাজ করে কোম্পানি! ডেটিং অ্যাপে যে সব ধনী ব্যবসায়ীরা অ্যাকাউন্ট খুলেছেন তাঁদের নজরে রাখত এরা। মডেলের নামে ফেক অ্যাকাউন্ট খুলে তাঁদের শিকার করত এই কোম্পানি সংগঠিত ভাবেই। ধীরে ধীরে এইসব ব্যবসায়ীদের নিজেদের মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে স্টক মার্কেটে লগ্নিতে রাজি করাতো তারা। মেয়েদের দিয়ে সেইসব কাস্টমারের সঙ্গে ফোনে কথা বলাতো। যাতে ব্যাপারটা বিশ্বাসযোগ্য হয়। প্রথম প্রথম ১০০ কি ২০০ ডলার লগ্নিতে ভালো লাভ করতেন ক্রেতারা। উৎসাহী হয়ে যেই তাঁরা ১০০০০ ডলার বা তার বেশি মুদ্রা বিনিয়োগ করতেন, অমনি কোম্পানি টাকা নিজেদের কাছে নিয়ে অ্যাকাউন্টটা ব্লক করে দিত। প্রতি কর্মচারীকে একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য দেওয়া হত। নিদেনপক্ষে পঞ্চাশজন ক্রেতার সঙ্গে কথা বলতে হত। এই লক্ষ্য পূরণ করতে না পারলে নিরাপত্তা বাহিনী ইলেকট্রিক শক দেওয়ার লাঠি ব্যবহার করত। যাঁরা কাজ করতে চাইতেন না তাঁদেরও শক দিয়ে শাস্তি দেওয়া হত।
আরও পড়ুন- শুধু মাল নদীর হড়পা বান নয়, অতীতেও উৎসবের নামে হুজ্জুতি বদলে গেছে মৃত্যুর বিভীষিকায়
মায়ানমার সেনা এই কোম্পানির হাত থেকে ষোলো জনকে উদ্ধার করে নিয়ে যায় হেড কোয়ার্টারে। সেখানে সাতদিনের জন্য তাঁদের কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়। ততদিনে সেনারা তাঁদের পাসপোর্ট এবং মোবাইল উদ্ধার করে কোম্পানির কাছ থেকে। সে সব ফেরত পেলে সেনারা স্টিফেনদের বলে দেয় কীভাবে জঙ্গল নদী পেরিয়ে ওপারে যেতে হবে। আর কোনও সাহায্য পাওয়া যায় না। জঙ্গলের মাঝে মোবাইল নেটওয়ার্ক অত্যন্ত দুর্বল। ভোর ছ’টার সময় তাঁরা বেরিয়ে পড়েন। জঙ্গল পেরোতে তাঁদের রীতিমতো বেগ পেতে হয়। পাঁচ কিলোমিটারেরও বেশি জঙ্গল পেরিয়ে লাগেজ টাগেজ নিয়েই নদী পেরোন তাঁরা। ওপারে একটি রাস্তার সন্ধানও মেলে। নিকটস্থ বাসস্ট্যান্ড বলতে সেই মে সত। সেটাও প্রায় কুড়ি কিমি। অগত্যা সেদিকে হাঁটতে শুরু করে দলটি। প্রায় আট কিলোমিটার হাঁটার পরে ফের পথ আটকায় থাই পুলিশ। আবার বন্দুক দেখিয়ে আটক করা হয় তাঁদের। ফের মোবাইল পাসপোর্ট কেড়ে নেওয়া হয়। ইমিগ্রেশন অফিসে পাঠানো হয়। সেখানে দু’দিন পর্যাপ্ত জল বা খাবার ছাড়াই আটকে রাখা হয় জেলে। ফের মানুষ পাচার ক্ষতিগ্রস্তদের উদ্ধারকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে দিন পনেরো কাটে। কোর্টে তাঁদের বিচার হয়। বিচারে ৪০০০ থাই বাহ্ত (৯০০০ টাকার কাছাকাছি) জরিমানাও হয়। তাঁদের কাছে জরিমানার পয়সাকড়ি কিছু নেই জানালে ফের সেই উদ্ধারকেন্দ্রে ফেরত পাঠানো হয়। আরও ছ’দিন কাটে।
আটজন আঁটে এমন একটা গাড়িতে ওই ষোলো জন সহ আরও জনা দশেক বিদেশিকে তোলা হয়। ওই অবস্থায় ন’ ঘণ্টার জর্নি করে তাঁরা পৌঁছন ব্যাঙ্ককে। সেখানে আবার একটা ডিটেনশন সেন্টারে তাঁদের রেখে অপরাধীর মতো ব্যবহার করতে থাকে পুলিশ। জেলের ভিতরে তাঁদের মোবাইল কেড়ে নেওয়া হয়। নিজেদের ফোনে কথা বলার জন্য তাঁদের নিজেদেরকেই পয়সা দিতে হত। ধীরে ধীরে দেশে ফেরার আশা হারিয়ে ফেলছিলেন স্টিফেনরা। অবশেষে ভারতীয় দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়। দূতাবাসের হস্তক্ষেপে স্টিফেনসহ আরও পনেরোজন এই অক্টোবরের চার তারিখ ভারতে পৌঁছন। প্রায় ৯৬ টি দিন এক ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্নের মধ্যে কাটিয়ে এসেছেন স্টিফেন। এক হাড়হিম করা আতঙ্ক যা ছড়িয়ে পড়েছে বহু চাকুরিপ্রার্থীর মনেই।