বোমা ফাটালেন মাস্ক! যৌন বিতর্কে জড়িত ট্রাম্প? কী আছে এপস্টাইন ফাইলে?

Trump Epstein Files: মাস্ক বলছেন, ট্রাম্পের নাম আছে 'এপস্টাইন ফাইলে', ট্রাম্পের বিরুদ্ধে বিশাল যৌন অপরাধের অভিযোগ আছে।

দু'জনই বিশাল ক্ষমতাধর। দু'জনই দু'জনের পিঠ চাপড়ে এগিয়ে এসেছেন অনেকটা পথ, একজন অন্যজনের ক্ষমতায়নের নেপথ্যে ছিলেন। তারপর হঠাৎ একদিন টেসলা কোম্পানির মালিক এলন মাস্ক, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের উপদেষ্টা পদ থেকে সরে গেলেন, বিরোধিতার কারণে। অনুমেয়ই ছিল যে হাত গুটিয়ে বসে থাকার পাত্র হবেন না মাস্ক। অনুমান সত্য করে দিয়ে, ট্রাম্পের বিরুদ্ধে এক চাঞ্চল্যকর অভিযোগের বোমাটি অবশেষে ফাটিয়েই দিলেন ট্রাম্প। ট্রাম্পের বিলের বিরোধিতা করার পরেই উপদেষ্টার পদ থেকে সরে যেতে হয়েছিল মাস্ককে। সাম্প্রতিক এই ঘটনা এলন মাস্ক এবং ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যে প্রকাশ্য বিরোধকে আরও তীব্র করে তুলল। কোন বোমা ফাটিয়েছেন মাস্ক? মাস্ক বলছেন, ট্রাম্পের নাম আছে 'এপস্টাইন ফাইলে', ট্রাম্পের বিরুদ্ধে বিশাল যৌন অপরাধের অভিযোগ আছে।

তাঁর নিজস্ব প্ল্যাটফর্ম এক্স-এ একটি পোস্টে, মাস্ক লিখেছেন, "সত্যিই বড় বোমাটা ফাটানোর সময় এসেছে: এপস্টাইন ফাইলে আছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। এটাই আসল কারণ যে এই ফাইল প্রকাশ করা হয়নি। দিন শুভ দিন হোক ডোনাল্ড জে ট্রাম্প!” ওই পোস্টেই তিনি লিখেছেন, "ভবিষ্যতের জন্য এই পোস্টটি মনে রাখবেন। সত্য বেরিয়ে আসবেই।" এবার যাওয়া যাক এই 'কেচ্ছা রহস্যের' গভীরে। কী এই এপস্টাইন ফাইল? ট্রাম্পের নাম কেন সেখানে? কী অভিযোগ তাঁর নামে?

 

জেফ্রি এপস্টাইন ছিলেন একজন বিনিয়োগকারী। বহু পুঁজিপতির ব্যবসায় অর্থ বিনিয়োগ করেই নিজের সম্পত্তি আড়-বহরে বাড়িয়েছিলেন তিনি, যদিও তাঁর আর্থিক লেনদেন সম্পর্কে অনেক কিছুই গোপন রাখা হয়েছিল। বছরের পর বছর ধরে, এপস্টাইন প্রাক্তন মার্কিন রাষ্ট্রপতি, ব্রিটিশ রাজপরিবার এবং হলিউডের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব-সহ বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তির সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলেন। ২০০৮ সালে পতনের মুখ দেখতে শুরু করেন জেফ্রি এপস্টাইন। মারাত্মক অভিযোগ ওঠে তাঁর বিরুদ্ধে যে, ফ্লোরিডায় জেফ্রি নাকি একজন নাবালককে যৌনকর্মীর কাজ করিয়েছেন। বিতর্কিত ওয়ার্ক-রিলিজ প্রোগ্রামের অধীনে মাত্র ১৩ মাস জেল খাটেন জেফ্রি।

এপস্টাইন ও ট্রাম্প

মার্কিন ভার্জিন দ্বীপপুঞ্জে আছে জেফ্রি এপস্টাইনের ব্যক্তিগত দ্বীপ। এই দ্বীপটিকে 'পিডোফাইল আইল্যান্ড'-ও বলা হতে থাকে। অভিযোগ, জেফ্রি নাকি শিশুদের উপর যৌন নির্যাতন চালাতেন মূলত এখানেই। ২০১৯ সালের অগাস্টে নিউ ইয়র্কের একটি জেলে জেফ্রি এপস্টাইনের মৃত্যু হয়, জানা যায় আত্মহত্যা করেছেন তিনি। তবে, তাঁর মৃত্যুর পরেই সাংঘাতিক সব অভিযোগ সামনে আসতে থাকে। অভিযোগ ওঠে, এপস্টাইনের এই কীর্তিতে যুক্ত ছিলেন বহু হাই-প্রোফাইল ব্যক্তিরা। সেই ব্যক্তিদের বাঁচানোর জন্যই এপস্টাইনকে চিরতরে চুপ করিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

আরও পড়ুন-নিরাপত্তাই কারণ? কেন এই ১২টি দেশ থেকে আমেরিকায় আসা নিষিদ্ধ করলেন ট্রাম্প?

এখানে আরেকটি ঘটনার উল্লেখ আবশ্যিক। জেফ্রি এপস্টাইন আর তাঁরই সঙ্গে প্রিন্স অ্যান্ড্রুর বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ এনেছিলেন ভার্জিনিয়া গিফ্রে। গত ২৬ এপ্রিল, ৪১ বছর বয়সে তিনি আত্মহত্যা করেছেন বলে জানা গেছে। দোষী সাব্যস্ত যৌন অপরাধী এপস্টাইন এবং তাঁর প্রাক্তন বান্ধবী ঘিসলাইন ম্যাক্সওয়েলের বিরুদ্ধে অন্যতম স্পষ্টবাদী অভিযোগকারী ছিলেন ভার্জিনিয়া। তিনি অভিযোগ করেছিলেন, এপস্টাইন ও তাঁর বান্ধবী মিলে তাঁকে ১৭ বছর বয়সে ইয়র্কের ডিউক প্রিন্স অ্যান্ড্রুর কাছে পাচার করে দিয়েছিলেন। অবশ্য প্রিন্স অ্যান্ড্রু তা অস্বীকার করেন। ভার্জিনিয়া বলেছিলেন, ২০০০ সালে ব্রিটিশ সমাজসেবী ঘিসলাইন ম্যাক্সওয়েলের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়। সেখান থেকেই এপস্টাইনের সঙ্গেও পরিচয় ঘটে। অভিযোগ, তারপর এপস্টাইন এবং তাঁর সহযোগীরা বছরের পর বছর ধরে যৌন নির্যাতন চালিয়েছিলেন ভার্জিনিয়ার উপর।

ভার্জিনিয়া গিফ্রে ইদানীং অস্ট্রেলিয়ায় উত্তর পার্থের শহরতলিতে তিন সন্তান এবং স্বামী রবার্টের সঙ্গে থাকতেন। তবে সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে জানা গেছে, ২২ বছরের বিবাহিত জীবনের পর এই দম্পতির পথ আলাদা হয়ে গেছিল।

এপস্টাইন ফাইলগুলিতে বিভিন্ন নথি, মূলত জেফ্রি এপস্টাইন সম্পর্কিত আদালতের কাগজপত্র আছে। এই নথিগুলি ভার্জিনিয়া গিফ্রের মামলা থেকেই নেওয়া হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে বিমানের তথ্য, বিভিন্ন সাক্ষীর সাক্ষ্য, যোগাযোগের তালিকা এবং এপস্টাইনের কার্যকলাপ সম্পর্কিত অন্যান্য প্রমাণ। এগুলিতে সামাজিক, পেশাগত বা এপস্টাইনের সঙ্গে যুক্ত অসংখ্য হাই-প্রোফাইল ব্যক্তির নাম রয়েছে।

এই নথিগুলিতে নাম থাকলেই কি সকলে দোষী হয়ে গেলেন? অনেকেরই তো নানা সামাজিক অনুষ্ঠানে এপস্টাইনের সঙ্গে হঠাৎ দেখাও হয়েছে। তাহলে ট্রাম্পের নাম থাকা নিয়ে কীসের এত বিতর্ক? জানা গেছে, ডোনাল্ড ট্রাম্প এপস্টাইনের লোলিটা এক্সপ্রেসে সফর করেছিলেন। এপস্টাইনের ব্যক্তিগত জেটটির নাম হচ্ছে 'লোলিটা এক্সপ্রেস'। ১৯৯৩ থেকে ১৯৯৭ সালের মধ্যে ট্রাম্প সাতবার এই বিশেষ জেটে ভ্রমণ করেছিলেন বলে তথ্য আছে। মূলত পাম বিচ, ফ্লোরিডা এবং নিউ ইয়র্ক সিটির মধ্যে এই জেট চলাচল করেছে। এই সফরের মধ্যে কয়েকটিতে তাঁর তৎকালীন স্ত্রী মার্লা ম্যাপলস, তাঁদের কন্যা টিফানি এবং একজন আয়া ছিলেন এবং জেফ্রি এপস্টাইন নিজেও এই ভ্রমণগুলির কয়েকটিতে সঙ্গী ছিলেন।

ট্রাম্প, মেলানিয়া, এপস্টাইন এবং তাঁর বান্ধবী ম্যাক্সওয়েল

এপস্টাইনের বিরুদ্ধে আরেক অভিযোগকারী জোহানা সজোবার্গ জানিয়েছিলেন, ২০০১ সালের একটি ঘটনার। সেবার এপস্টাইনের জেট আটলান্টিক সিটিতে ঘুরিয়ে দেওয়া হয়েছিল এবং এপস্টাইনকে ট্রাম্পের একটি ক্যাসিনোতে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। ইভানা ট্রাম্প এবং মিক জ্যাগারের মতো অন্যান্য বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বের সঙ্গে এপস্টাইনের যোগাযোগ তালিকায় ট্রাম্পের নামও পাওয়া যায়।

 

নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, ফ্লোরিডার ব্যবসায়ী জর্জ হুরানে, ট্রাম্প আর এপস্টাইন জুটির এক সাধারণ বন্ধু ছিলেন। তিনি বলেছিলেন, মার-এ-লাগোতে অনুষ্ঠিত 'ক্যালেন্ডার গার্ল' প্রতিযোগিতার আগে "ছোট মেয়েদের পিছনে লাগা" সম্পর্কে ট্রাম্প এবং এপস্টাইনকে সতর্ক করেছিলেন তিনি।

২০০৪ সালে ফ্লোরিডা রিয়েল এস্টেটের প্রতিযোগিতা নিয়ে ট্রাম্প এবং এপস্টাইনের মধ্যে চূড়ান্ত বিরোধ দেখা দেয়। ট্রাম্প পরে বলেছিলেন যে, ক্লাবে কর্মরত একজন মহিলাকে নিয়োগের চেষ্টা করার জন্য এপস্টাইনকে মার-এ-লাগো থেকে নিষিদ্ধ করেছিলেন ট্রাম্প।

আরও পড়ুন- ট্রাম্পের সরকার থেকে ছুটি! কেন সরে যাচ্ছেন এলন মাস্ক?

২০০২ সালের এক সাক্ষাৎকারে ট্রাম্প এপস্টাইনকে 'দুর্দান্ত' ব্যক্তিত্ব বলে অভিহিত করেছিলেন। অস্ট্রেলিয়ান ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশনের এক প্রতিবেদনে জানা যাচ্ছে, সেই সময়, অর্থাৎ ওই সাক্ষাৎকারে ট্রাম্প বলেছিলেন, "তাঁর (এপস্টাইন) সঙ্গে থাকতে বেশ মজা লাগে। বলা হয় যে, আমার মতো তিনিও সুন্দরী মহিলাদের পছন্দ করেন, এবং তাদের অনেকেই কমবয়সি।" তবে এপস্টাইনের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রকাশ্যে আসার পরই ট্রাম্প নিজেকে তাঁর থেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছিলেন।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং টেসলার সিইও এলন মাস্ক, গত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হাতে হাত ধরে কাজ করেছেন। মাস্ক ট্রাম্পের প্রচারে গলা ফাটিয়েছেন, আগল্ভাঙা টাকাও ঢেলেছেন। ট্রাম্পও নিজের নয়া রাজনৈতিক মিত্রকে যথেচ্ছ সুবিধা, পদ ইত্যাদি পাইয়ে দিয়েছেন। তবে কয়েক মাস গড়াতে না গড়াতেই সরকারের নতুন কর বিল নিয়ে মতবিরোধে জড়িয়ে যান এলন মাস্ক। মাস্ক নয়া আইনের তীব্র সমালোচনা করেছেন, বলেন এই আইন "একটি জঘন্যতম কাজ"। ব্যাস, জবাবে ট্রাম্পও মাস্কের প্রতি নিজের হতাশা প্রকাশ করেছেন, আর মাস্কের ডানাও ছেঁটে দিয়েছেন।

মাস্ক জানেন, গত নির্বাচনে ট্রাম্পের জয় মাস্কের সমর্থন ছাড়া সম্ভবই হতো না। বিশ্ব রাজনীতিও জানত, দুই অমিত শক্তিধর ব্যক্তি একত্রে কাজ করতে পারে না, সংঘাত আবশ্যিক! মাস্ক তাই বদলা হিসেবেই খানিক এই বোমাটি ফাটিয়েছেন বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। সবে তিনি বিতর্ক উস্কে দিয়েছেন। মাস্ক যে রূপ খামখেয়ালি, যে রূপ প্রতিহিংসাপরায়ণ, তাতে তিনি যদি এই বিতর্ক নিয়ে আরও এগোন তাতে ট্রাম্পের আসন উল্টে যাওয়ার সমূহ আশঙ্কা থাকছে।

More Articles