যুগের সমাপ্তি: প্রয়াত তরুণ মজুমদার, প্রচারবিমুখ পরিচালক ছিলেন বাংলা সিনেমার অভিভাবক
অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সঙ্গে এমন সম্পর্কই প্রমাণ করে বাংলা সিনেমার অন্যতম অভিভাবক ছিলেন তরুণ মজুমদার। একের পর এক সাহিত্যের পাতা থেকে চরিত্রদের নিয়েছেন সিনেমার পর্দায়।
চলে গেলেন বাংলা সিনেমাজগতের আরেক মহারথী, তরুণ মজুমদার। তাঁর প্রয়াণে শোকস্তব্ধ টলিপাড়া। কিডনির সমস্যা ও অন্যান্য বার্ধক্যজনিত রোগে বেশ কয়েকদিন ধরেই এসএসকেএম হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। মাঝে শারীরিক অবস্থার কিছুটা উন্নতিও হয়েছিল। কিন্তু দ্রুত ফের শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে শুরু করে। অক্সিজেনের মাত্রা কমে যায়, বেড়েছিল আচ্ছন্ন ভাব। টিউব দিয়ে খাওয়ানো হচ্ছিল তাঁকে। স্বাস্থ্যের উন্নতি হওয়ার পরেও আচমকা অবনতি হয় তাঁর শারীরিক অবস্থার, ভেন্টিলেশনে দিতে হয় প্রবীণ পরিচালককে। ভেন্টিলেশন থেকেই আর ফেরা হল না।
গত বাইশ বছর ধরেই কিডনির সমস্যায় ভুগছিলেন পরিচালক। জুনের মাঝামাঝি তা বাড়াবাড়ি পর্যায়ে যাওয়ায় এসএসকেএম-এর উডবার্ন ওয়ার্ডে ভর্তি হয়েছিলেন। ফুসফুসেও সংক্রমণ ছিল তাঁর। চিকিৎসক সোমনাথ কুণ্ডু, মেডিসিনের চিকিৎসক সৌমিত্র ঘোষ, নেফ্রোলজিস্ট অর্পিতা রায়চৌধুরী, কার্ডিওলজিস্ট সরোজ মন্ডল, নিউরো মেডিসিনের চিকিৎসক বিমান রায়– পাঁচ জনের একটি দলের পর্যবেক্ষণে ছিলেন। অবশেষে সেই লড়াই থামল।
“প্রচারের পিছনে না ছুটেও দর্শকের মনে বেঁচে থাকতে পারি কি না, আমি এই পরীক্ষাটা করে যেতে চাই। টিভিতে বাইট দিই না। অল ইন্ডিয়া রেডিও ডেকেছিল, আমি যাইনি। ফিল্মি পার্টিতে আমাকে দেখতে পাবেন না। এতে আমার কোনও ক্ষতি হয়নি। আমি নিজের বিবেকের কাছে পরিষ্কার। বড় বড় দাবি আমি করি না। খুব সাধারণভাবে ছবি তৈরির চেষ্টা করেছি,” বলেছিলেন তরুণ মজুমদার। সত্যি বলেছিলেন। সারাজীবন প্রচারের আড়ালেই থেকে গেলেন তিনি। তাপস পাল, মৌসুমী চট্টোপাধ্যায়, মহুয়া রায়চৌধুরী, দেবশ্রী রায়— কতশত তারকা ওঁর হাত ধরে এসছেন ইন্ডাস্ট্রিতে। এঁরাই পরবর্তীতে সিনেজগৎ কাঁপিয়ে বেড়াবেন। হিরে শনাক্ত করেছিলেন তরুণ মজুমদার।
তরুণ মজুমদারের জীবনের শুরুটা আর চার-পাঁচটা সাধারণ মানুষের মতোই। ১৯৩১-এ অধুনা বাংলাদেশের বগুড়ায় জন্ম। উচ্চশিক্ষার প্রায় পুরোটাই এপার বাংলায়। প্রথমে কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজ, পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। এরপরেই সিনেমার জগতে পা রাখা তাঁর। অর্ধশতাব্দীরও বেশি সিনেমার জগতে কাজ করে গিয়েছেন তরুণ। এবং নিঃশব্দে। তাঁর কাজ নিয়ে মাতামাতি হয়েছে, হই হই হয়েছে– কিন্তু পরিচালক যেমন নিভৃতে এই জগতে এসেছিলেন, তেমনই নিভৃতে সরে গেলেন।
প্রথম দিকে শচীন মুখোপাধ্যায় আর দিলীপ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে দল বেঁধে গড়ে তুলেছিলেন 'যাত্রিক' নামে একটি পরিচালক দল। সেসময় এমন উদাহরণ আরও ছিল, যেমন, 'অগ্রদূত'। যাত্রিক গোষ্ঠীর সিনেমা এতটাই জনপ্রিয় হয়েছিল যে, আজও সেসব সিনেমার নামোচ্চারণমাত্রই পাঠক হয়তো চিনতে পারবেন। উত্তম-সুচিত্রা জুটি তখন জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। তাঁদের নিয়ে যাত্রিক গোষ্ঠী সবার প্রথমে করল ‘চাওয়া পাওয়া’। ১৯৫৯ সালে হলে মুক্তি পেল ছবিটি। সুচিত্রার লিপে সন্ধ্যার কণ্ঠে 'খেলা নয় নয় গো, এই যে কাছে ডাকা, এই যে বসে থাকা’-র বিপরীতে উত্তম কুমারের লিপে হেমন্তের কণ্ঠে 'যদি ভাবো এ তো খেলা নয়, ভুল সে তো শুরুতেই'— দর্শক পাগল হয়ে উঠেছিল। বড়লোক বাড়ির মেয়ে পালিয়ে আসে বাড়ি থেকে, শেষ অবধি নায়ক তাকে বাড়িতে দিয়ে আসে। গোটা ছবিটাই মানসিক টানাপোড়েনের ছবি। সঙ্গে তুলসী চক্রবর্তীর সেই অনবদ্য অভিনয়। যাই হোক, ‘চাওয়া পাওয়া’ চূড়ান্ত হিট করার পরের বছর যাত্রিক গোষ্ঠী বের করে আরেকটি ছবি, 'স্মৃতিটুকু থাক' (১৯৬০)। এতে সুচিত্রা সেনের দ্বৈত ভূমিকা। এই ছবিও বেশ সফল হয়েছিল। এরপরে বছরদুয়েক তাঁদের আর কোনও ছবি আসেনি। আবার ১৯৬৩-তে এক বছরেই পরপর দু'টি হিট দিল যাত্রিক। ‘পলাতক’ এবং ‘কাঁচের স্বর্গ’।
এই এতদূর এসে যাত্রিকের যাত্রা শেষ হল। ১৯৬৫ নাগাদ একা সিনেমা বানাতে শুরু করলেন তরুণ মজুমদার। তারপর একে একে ‘বালিকা বধূ’ (১৯৬৭), ‘কুহেলি’ (১৯৭১), ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’ (১৯৭৩), ‘ঠগিনী’ (১৯৭৪), ‘ফুলেশ্বরী’ (১৯৭৪), 'সংসার সীমান্তে’ (১৯৭৫), ‘গণদেবতা’ (১৯৭৮), ‘দাদার কীর্তি’ (১৯৮০), ‘অরণ্য আমার’ (১৯৮৪), ‘ভালোবাসা ভালোবাসা’ (১৯৮৫), 'আলো' (২০০৩)- একের পর এক হিট ছবি দিয়েছেন তরুণ। এর মধ্যে ‘গণদেবতা’ পায় শ্রেষ্ঠ বিনোদনমূলক জনপ্রিয় চলচ্চিত্রর জন্য জাতীয় পুরস্কার, ‘নিমন্ত্রণ’ পায় শ্রেষ্ঠ বাংলা ছবি হিসেবে জাতীয় পুরস্কার আর ‘অরণ্য আমার’ পায় শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানভিত্তিক ছবির জন্য জাতীয় পুরস্কার।
‘বালিকা বধূ’-তে তরুণ মজুমদারের হাত ধরে সিনেমায় এলেন মৌসুমী চট্টোপাধ্যায়। তখন তাঁর বয়স মাত্র তেরো। খুবই চটপটে ছিলেন। পরিচালক যা বলতেন, তাই তুলে নিতেন। কিন্তু বড্ড চঞ্চল। সেটের মধ্যেই নাকি দুষ্টুমি করে বেড়াতেন। তাতে অতিষ্ঠ হয়ে এক কোণে বেঞ্চের উপর কান ধরে তাঁকে দাঁড় করিয়ে দিতেন তরুণ। যখন মৌসুমীর শট, তখন ডেকে নিয়ে ফের শুটিং হতো। শেষে ব্যাপারটা এমন দাঁড়াল যে, শুটিং শেষে মৌসুমী নিজে থেকেই গিয়ে বেঞ্চের ওপর কান ধরে দাঁড়িয়ে পড়তেন। এ যেন পরিচালক-অভিনেত্রীর সম্বন্ধ নয়, পিতা-পুত্রীর সম্পর্ক।
দেবশ্রী রায় যখন তরুণ মজুমদারের হাত ধরে সিনেমা জগতে আসেন, তখন তাঁর মাত্র দু'-তিন বছর বয়স। তরুণ এবং সৌম্যেন্দু রায়ের কোলে কোলে ঘুরতেন। সে ছিল ‘কুহেলি’-র সেট। পরে ফের ‘দাদার কীর্তি’-তে দেখা গেল তাঁকে। সেই ‘দাদার কীর্তি’-তেই দেখা গেল তাপসকে প্রথম। তাপস পালকে নায়ক হিসেবে নির্বাচিত করার আগে নাকি প্রায় তিরিশ জনের অডিশন নিয়েছিলেন। দু'দিন ওঁকে নিজের টেবিলের সামনে বসিয়ে রেখেছিলেন তরুণ মজুমদার। ওঁর হাবভাব দেখে তাঁর মনে হয়েছিল, অভিনয় না করেও অনেক সময় অনেক কথা বলে দেওয়া যায়, সেই গুণ রয়েছে তাপস পালের মধ্যে।
এইসব নানা টুকরোটাকরা গল্প রয়ে যাবে টলিপাড়ার কিংবদন্তি হয়ে। অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সঙ্গে এমন সম্পর্কই প্রমাণ করে বাংলা সিনেমার অন্যতম অভিভাবক ছিলেন তরুণ মজুমদার। একের পর এক সাহিত্যের পাতা থেকে চরিত্রদের নিয়েছেন সিনেমার পর্দায়। আজীবন সাহিত্যকেন্দ্রিক সিনেমা করাটাই তাঁর কাজের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তাঁর মৃত্যুতে শোকাচ্ছন্ন বাঙালি। শোকপ্রকাশ করেছেন মুখ্যমন্ত্রীও। বাংলা সিনেমার ইতিহাসে মাইলফলক কিছু কাজ রেখে নিঃশব্দে সরে গেলেন তরুণ। প্রচার তাঁর কোনও দিনই পছন্দ ছিল না যে!