বাবার কাছে হাতেখড়ি! ৯০ বছর ধরে মাটির পুতুল গড়ছে কালো সূত্রধররা
Bishnupur: এখানকার ৭ থেকে ৮ ইঞ্চি উচ্চতার বর-বউ পুতুলের মধ্যে অনিন্দ্য সৌন্দর্য দেখতে পাওয়া যায়। পশ্চিমবাংলার বিভিন্ন জায়গায় বর-বউ পুতুল তৈরি হয়ে থাকে। কিন্তু বিষ্ণুপুরের এই পুতুলের মধ্যে স্নিগ্ধতা রয়েছে।
এ শহরে আজও দলমাদল কামানের দম্ভ সগর্ব বিরাজ করে। এ শহরের রাসমঞ্চ, জোড়বাংলা, পঞ্চরত্ন শ্যামরাই মন্দির-সহ অন্যান্য স্থাপত্য আজও বাঙালির আধ্যাত্মিক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অন্যতম প্রধান প্রতীক। এ শহরের নাম বিষ্ণুপুর। এ শুধু নিছক জনপদ নয়। প্রাচীন বাংলার সঙ্গে আজকের আধুনিক বঙ্গ জীবনের মধ্যে সেতুর কাজ করে থাকে এ শহর। বিষ্ণুপুরের এই চেনা পরিচিতির বাইরে তার আরও একটি পরিচয় রয়েছে। সেটা হলো তার নিজস্ব শৈলীর মাটির পুতুল। শিশুদের চিত্তকে বিনোদিত করার জন্য আজও এ শহরের বুকে মাটির পুতুল তৈরি হয়ে থাকে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এই সময় দাঁড়িয়ে আজও বিষ্ণুপুরে বারো মাস পাওয়া যায় মাটির পুতুল। বিষ্ণুপুরের পুতুল নির্মাণের মধ্যে রয়েছে শিশুসুলভ সরলতা ও মরমী মনোভাব। নদীয়ার কৃষ্ণনগরের বাস্তবধর্মিতা থেকে স্বতন্ত্র এখানকার মাটির পুতুল। শিল্পীদের আঙুলের ছোঁয়ায় সহজ অভিব্যক্তি নিয়ে গড়ে ওঠে বিষ্ণুপুরের মাটির পুতুল।

নদীয়ার কৃষ্ণনগরের বাস্তবধর্মিতা থেকে স্বতন্ত্র এখানকার মাটির পুতুল
বিষ্ণুপুরের পোকা বাঁধের চকবাজার বাহাদুরদুগঞ্জ সূত্রধর পাড়ায় মাটির পুতুল গড়েন কালো সূত্রধর, বন্দনা পাল, সৌমেন পালেরা। বর্তমানে বাংলার অন্যান্য প্রান্তে মূলত রথ, চড়ক, ঝুলন ও জন্মাষ্টমীর সময় মাটির পুতুল তৈরি হয়ে থাকে। কিন্তু এখানে কৃষ্ণনগরের মতোই বারো মাস পুতুল তৈরি হয়। শিল্পীরা নিজেরাই সেই পুতুল বিক্রি করে থাকেন। শিল্পী কালো সূত্রধর জানিয়েছেন, তাঁর পরিবার প্রায় ৯০ বছর ধরে এই শহরে মাটির পুতুল তৈরি করে চলেছেন। পিতা ভৈরব সূত্রধরের কাছ থেকে পরম্পরাগত এই শিল্পশৈলীটি শিখেছিলেন তিনি। কিন্তু শুধুমাত্র পুতুল বিক্রি করে সংসার চলে না। তাই জীবন নির্বাহের প্রয়োজনে পুতুল তৈরি করার পাশাপাশি সিমেন্টের মূর্তিও নির্মাণ করে থাকেন কালো সু
ত্রধর। শিল্পীর কথায় এ পাড়ায় প্রায় ছয় ঘর শিল্পী রয়েছেন যাঁরা মাটির পুতুল তৈরি করে থাকেন।

শিল্পী বন্দনা পাল
এখানকার পুতুল নির্মাণশৈলীতে আলপনার প্রয়োগ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বর-বউ পুতুলের বরের রঙিন পাঞ্জাবির মধ্যে অনিন্দ্য সুন্দর আলপনার প্রয়োগ মনকে আকৃষ্ট করে থাকে। মাত্র সাড়ে সাত ইঞ্চির পুতুলের শরীরের মধ্যে আলপনার সূক্ষ্ম কাজ শিল্পীদের শিল্প সত্তার মুন্সিয়ানার পরিচয় বহন করে চলেছে। অন্যদিকে, আলাদা করে ছোট জরির কাপড় দিয়ে পুতুলকে শাড়ি পরানোর পরম্পরাগত রীতির দেখা পাওয়া যায় এখানকার পুতুল নির্মাণের মধ্যে দিয়ে। বন্দনা পালের তৈরি নাচুনী পুতুলের মধ্যে ঘাগড়ার মতো শৈলীতে আলাদা করে জরির কাপড় পরানো হয়েছে। এমনকি তাঁর তৈরি মেয়ে পুতুলের সর্বাঙ্গ জরির শাড়ী দিয়ে অলংকৃত করা হয়েছে। চুলের খোঁপার দিকটা আলাদা ভাবে রঙ করে আকর্ষণীয় করা হয়েছে। এক্ষেত্রে গ্রামীণ বাংলার প্রথাগত শাড়ি পরা শৈলীর প্রয়োগ এই পুতুলের মধ্যে দেখা যায়। এখানকার প্রতিটা পুতুলই কাঁচা মাটির তৈরি। এখানে দুই ধরনের উচ্চতার পুতুলের দেখা পাওয়া যায়। বর-বউ, নাচুনি, মেয়ে, ছোটা ভীম ও সস্ত্রীক গোপাল ভাঁড় পুতুলের উচ্চতা সাত থেকে আট ইঞ্চির মধ্যে। এই পুতুলগুলো ছাঁচের তৈরি। পুতুলগুলির হাতের গঠনের মধ্যে বাস্তবধর্মীতার প্রয়োগের চেষ্টা লক্ষ্য করা যায়। এখানকার শিল্পীরা আরেক ধরনের পুতুল তৈরি করে থাকেন যার উচ্চতা তিন থেকে চার ইঞ্চির মধ্যে। এই পুতুলগুলি মূলত হাতে টিপে তৈরি করা হয়। এই পুতুলশৈলীতে ছাঁচ ব্যবহার করা হয় না। পুতুলগুলির হাত অসম্পূর্ণ। শিল্পের ভাষায় এগুলোকে বিমূর্ত শৈলী বলা হয়। কোমর পর্যন্ত নেমে গেছে পশ্চিমা শৈলীর পোশাকের মতো গাউন। আশ্চর্যের বিষয় এটুকুই পুতুলের মধ্যেও শিল্পীরা আলপনার প্রয়োগ করে দেখিয়েছেন। এই পুতুলগুলোকে মূলত বর-বউ বলা হয়ে থাকে। এই পুতুলের বরের মাথায় ত্রিকোণাকৃতি মাটির টোপর বসানো রয়েছে। অন্যদিকে, বউ পুতুলের কপালে রয়েছে লাল টিপ। এই টেপা শ্রেণীর বর-বউ পুতুলের দেখা হাওড়া এবং উত্তর চব্বিশ পরগনার হাড়োয়ার নজরনগরে দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু নির্মাণশৈলীতে স্বতন্ত্রসত্ত্বা বহন করে চলে বিষ্ণুপুরের চকবাজারের বাহাদুরগঞ্জের শিল্পীরা।
আরও পড়ুন- এক বৃদ্ধের হাতে জীবিত নাড়াজোলের কাঠের পুতুল শিল্প
শিল্পী বন্দনা পালের তৈরি নাচুনি পুতুলের নির্মাণশৈলী বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। পুতুলটির শরীরের মাঝখানে স্প্রিং বসানো রয়েছে। দুই হাত উন্মুক্তভাবে প্রসারিত। সিঁথিতে সিঁদুর, কপালে টিপ। গলায় লাল রঙের মালা। হাতে লাল চুড়ি। পুতুলটির হাত আলতো করে স্পর্শ করলেই তার এক খোল ছাঁচের শরীর নেচে ওঠে। পুতুলটির শরীরী ভাষা নারী স্বাধীনতার বার্তা বহন করে চলেছে। পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে মাথা উঁচু করে শান্ত দৃষ্টিতে স্পর্ধার প্রতীক হয়ে উঠেছে। এই স্পর্ধার মধ্যে কোনও উগ্রতা নেই। সাবলীল অভিব্যক্তি নিয়ে সে তাঁর অস্তিত্বকে প্রত্যয়ের সঙ্গে প্রমাণ করে চলেছে।

কালো সূত্রধরের তৈরি বর-বউ পুতুল
এখানকার ৭ থেকে ৮ ইঞ্চি উচ্চতার বর-বউ পুতুলের মধ্যে অনিন্দ্য সৌন্দর্য দেখতে পাওয়া যায়। পশ্চিমবাংলার বিভিন্ন জায়গায় বর-বউ পুতুল তৈরি হয়ে থাকে। কিন্তু বিষ্ণুপুরের এই পুতুলের মধ্যে স্নিগ্ধতা রয়েছে। কালো সূত্রধরের তৈরি বর-বউ পুতুলের মধ্যে শিশুসুলভ মিষ্টতা লক্ষ্য করা যায়। অন্যদিকে, সৌমেন পালের তৈরি পুতুলে বয়সজনিত প্রাজ্ঞতার পরিচয় পাওয়া যায়। তাঁর তৈরি বর পুতুলের মুখ গোঁফযুক্ত গোলাকৃতি। বউ পুতুলের মাটির শাড়িতে অনিন্দ্য সুন্দর কারুকার্য দেখা যায়। টোপর ও মুকুট যথাযথ ভাবে তৈরি করা হয়েছে। বউ পুতুলের শাড়ির প্রতিটি ভাঁজ শিল্পী ধৈর্য সহকারে নির্মাণ করেছেন।

বউ পুতুলের শাড়ির প্রতিটি ভাঁজ শিল্পী ধৈর্য সহকারে নির্মাণ করেন
উল্লেখ করা যেতে পারে আজও বিষ্ণুপুরের শৈশব এই পুতুলগুলির মধ্যেই নিজের মনোজগতের বিনোদনের ভাবকে খুঁজে পায়। তাই বারোমাস শিল্পীরা পুতুলের পসার নিয়ে বসে চকবাজারের বাহাদুরগঞ্জে সূত্রধর পাড়ায়। জিতাষ্টমীর সময় এখানকার শিল্পীরা হাতির পিঠে বসা দেবরাজ ইন্দ্রের মূর্তিও পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে গড়ে তোলেন। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তারা সস্ত্রীক গোপাল ভাঁড় ও ছোটা ভীম তৈরি করে থাকেন। বিষ্ণুপুরের পুতুল বললেই সকলের মনের মধ্যে শাঁখারী বাজারের ফৌজদার পরিবারের তৈরি হিঙ্গুল পুতুলের কথা মনে আসে। কিন্তু চকবাজারের বাহাদুরগঞ্জের শিল্পীদের প্রচার এবং প্রসার খুবই সীমিত। সেটা নিয়ে যদিও তাঁদের কোনো আক্ষেপ নেই। তাঁরা একাগ্র চিত্তে দিনের পর দিন মাসের পর মাস বছরের পর বছর ধরে পুতুল নির্মাণ করে বাংলার লুপ্ত হতে বসা এই লোকশিল্পকে একবিংশ শতাব্দীতেও বাঁচিয়ে রেখেছেন, আর এটাই তাদের পরম কৃতিত্ব।