আর্তের পাশে দাঁড়ানোই ধর্ম: একান্তে মালবাজার বিপর্যয়ের 'হিরো' মহম্মদ মানিক
Mohammad Manik: আমি মুসলমান, এটাও বড় করে বলা হচ্ছে। আসলে জানেন তো, সব ধর্মেরই মূল লক্ষ্য মানুষ বিপদে পড়লে তাঁর পাশে দাঁড়ানো। আমাদের ধর্মেও সেটাই বলা।
মহম্মদ মানিক। জলপাইগুড়ির মাল শহরের কাছের পশ্চিম তেশিমলার নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। পরশু পর্যন্ত যাঁকে চিনতেন না আপনিও। কিন্তু দশমীর রাতের একটি ঘটনা বদলে দিয়েছে তাঁর জীবন। মুহূর্তেই ভাইরাল হয়েছেন 'হিরো' মানিক। তাঁর মহামানবীয় কাজে থমকে গিয়েছে দেশ। নেটমাধ্যমে ছড়িয়েছে মানিকের ভিডিও। মানুষ বাঁচানোর কারিগর হিসেবে উঠে এসেছেন গ্রামের ছেলে মহম্মদ। কিন্তু শত কুর্নিশের মধ্যেও রটছে গুজব! মুসিলম যুবকের সঙ্গে কারা ছিলেন! তিনি নাকি জেলা প্রশাসনের কর্মচারি! সেদিন মাল নদীর পাড়ে ডিউটি করছিলেন তিনি! এছাড়াও ওই যুবককে নিয়ে ছেয়ে গিয়েছে একাধিক কথকতা। একের পর এক মন্তব্য আর ব্যাখ্যায় বিপর্যস্ত হচ্ছেন দশমীর হিরো মহম্মদ মানিক। ধর্ম নিয়েও শুরু হয়েছে আলোচনা। কিন্তু আসল সত্য কী? বিস্তারিত জানতে আমরা সরাসরি যোগাযোগ করেছিলাম মালের ভাইরাল মানিকের সঙ্গে। তাঁর সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় উঠে এল একাধিক অজানা তথ্য। সেদিন কী হয়েছিল? কী অবস্থা ছিল তাঁর? কেন? কী কারণে সবটা? কী হয়েছিল আসলে? কী করেন তিনি? কেন করলেন এমন? কতটা সত্য প্রচারিত সব তথ্য? একাধিক প্রশ্নের উত্তরে মানুষ বাঁচানোর কারিগর মহম্মদ খোলসা করলেন সব।
কেমন আছেন এখন?
ভালো নেই। তৃপ্তি পাচ্ছি এতগুলো মানুষ বাঁচিয়েছি ভেবে। আবার অনেকেই মারা গিয়েছেন, সেটা দেখেও খারাপ লাগছে। এমন তো দেখিনি কোনও দিন।
হ্যাঁ, সেটা ঠিক। তবে আপনি কেমন আছেন?
ধন্যবাদ। এটা জিজ্ঞাসা করার জন্য। না, আমার শরীর বেশ খারাপ। ডান পায়ে সেদিন চোট পেয়েছি। আঙুলের তলায় ভালোই ক্ষত রয়েছে। চিকিৎসা করাচ্ছি।
আচ্ছা, মানিক সেদিন ঠিক কী দেখলেন, কী ঘটেছিল, বিস্তারিত যদি বলেন।
দেখুন। আমরা প্রত্যেক বার বন্ধুরা মিলে মাল নদীর ঘাটে ভাসান দেখতে যাই। সেদিনও গিয়েছিলাম। কিন্তু এবছর ভিড় অনেক বেশি ছিল ওখানে। রাস্তা থেকে ঘাট পর্যন্ত যেতে অনেকটা সময় লাগছিল।
তারপর?
অনেক কষ্ট করে পৌঁছই ওই ঘাটে। ওই ধরুন রাত আটটা, সাড়ে আটটা বেজেছে তখন। সবেমাত্র গিয়ে দাঁড়িয়েছি ঘাটে। অনেক লোকের সমাগম। ভিড়ে নাস্তানাবুদ অবস্থা। হঠাৎ দেখি চিৎকার হচ্ছে। তাকিয়ে দেখলাম, বিরাট জলের স্রোতের সঙ্গে দ্রুত মানুষ ভেসে আসছে!
তারপর কী করলেন?
আমি তো অবাক! ডাইনে-বাঁয়ে না ভেবে আমার সঙ্গে থাকা বন্ধু মহসিন হককে মোবাইল ফোন রাখতে দিয়েই তাড়াতাড়ি ঝাঁপ মারি নদীতে। (একটু থেমে আবার বললেন) জলের বিরাট স্রোত। আমি সাঁতার জানি। ওই অবস্থায় দুটো বাচ্চা, মহিলা-সহ কমপক্ষে ১০ জনকে নিরাপদে সরিয়ে আনি।
ঝাঁপ দিলেন, অনেকেই দাঁড়িয়ে তখন। কেন করলেন এমন?
দেখুন, আমি যখন এই কাজ করছি, তখন তো আমার আগে কে, পিছনে কে এসব দেখিনি। আমি শুধু লক্ষ্য রেখেছি মানুষ বিপদে পড়েছে ওঁদের আমাকে বাঁচাতেই হবে।
এরকম অভিজ্ঞতা আগে হয়েছিল?
এই নদীতে এরকম হয়। হঠাৎ বান আসে মাঝে মাঝেই। নদীখাত জলে ভাসে। পাথর ভেসে আসে বড় বড়। এমন তো আমরাও জানতাম। কিন্তু উৎসবে এসব আগে দেখিনি। আচমকা এমন।
আরও পড়ুন- শুধু মাল নদীর হড়পা বান নয়, অতীতেও উৎসবের নামে হুজ্জুতি বদলে গেছে মৃত্যুর বিভীষিকায়
একটা প্রশ্ন করছি, যদি কিছু মনে না করেন..
হ্যাঁ হ্যাঁ অবশ্যই বলুন।
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অভাবের অভিযোগের সময়ে দাঁড়িয়ে এই যে আপনি মুসলিম হয়েও হিন্দুদের উৎসবে গেলেন, মানুষ বাঁচালেন। এসব নিয়েও একটা প্রচার চলছে সোশ্যাল দুনিয়ায়। কী বলবেন?
আমি জানি। এই প্রচার চলছে। আমি মুসলমান, এটাও বড় করে বলা হচ্ছে। আসলে জানেন তো, সব ধর্মেরই মূল লক্ষ্য মানুষ বিপদে পড়লে তাঁর পাশে দাঁড়ানো। আমাদের ধর্মেও সেটাই বলা। একটা পশু হলেও তাকে বাঁচাতেই হবে। আমিও মানুষ হিসেবে আমার যা করা উচিত, সেই কর্তব্যই পালন করছি শুধু।
খারাপ লাগছে, মানুষ বাঁচিয়ে ধর্ম-ধর্ম ভাবতে?
অবাক হচ্ছি। ওখানে যদি অন্য কেউ, অন্য কোনও জাত-ধর্মের কেউ থাকতেন, আমার কিছু এসে যেত না। আমি মানুষ। আমার কর্তব্য এবং দায়িত্ব, বিপদে সকলকে রক্ষা করতে চেষ্টা করা। আমিও তাই করেছি সেদিন । আর সেটাতেই আমি খুব খুশি। তবে অনেকেই বাঁচেননি। তাঁদের বাঁচাতে পারলে ভালো হত।
বলা হচ্ছে, আপনি একা নন, এই কাজে আপনার সঙ্গে অনেকেই ছিলেন, তাঁদের কথা আসছে না প্রকাশ্যে!
আমার সঙ্গে আমার আরেকটা বন্ধু ছিল। তাঁর নাম মহসিন হক। ও ঘাটে ছিল। আমি ওর হাতে আমার মোবাইল ফোন দিয়ে ঝাঁপ মারি। নিশ্চিত অনেকেই চেষ্টা করেছেন সেদিন। আমি তাঁদের কথা কীভাবে ওই মুহূর্তে বলব বা জানব! আমি তো এসব ভেবে, পরিকল্পনা করে মানুষ বাঁচাতে যাইনি!
আপনি নাকি প্রশাসনের সঙ্গে কাজ করেন। বিপর্যয় মোকাবিলার কাজ?
না না, বাজে কথা। আমি ছাপোষা, একটা গ্রিলের কারখানায় কাজ করি। এসব গুজব আর সম্পূর্ণ মিথ্যা।
ভয় করল না, বাড়িতে সাড়ে তিন বছরের সন্তান রয়েছে। স্ত্রী, মা, বাবা, ভাইয়ের কী হবে ভেবে?
নাহ্! সেই মুহূর্তে আমার চার-পাঁচ জনের পরিবারের তুলনায় আমি বেশি গুরুত্ব ওই বিপদে পড়া অনেককে দিয়েছি। পরে একটু চাপ লেগেছিল যদিও। তবে কোনও অসুবিধা হয়নি। ওটাই আমার করা উচিত ছিল সেই মুহূর্তে।
পরিবার কী বলল?
আমার বাবা প্রশংসা করেছেন। স্ত্রী, মা-ও খুবই খুশি। আমি মানুষ হয়ে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছি তাই। এটাতেই তাঁরা সকলে আমার জন্য গর্বিত।
প্রতিবেশী, আত্মীয়দের প্রতিক্রিয়া?
অনেকই খোঁজ নিতেন না আগে। এখন আমার এই কাজ দেখে ফোন করছেন। বাড়ি ভর্তি লোক। সবাই বাহবা দিচ্ছেন। কিন্তু আমি যা করেছি, সকলেরই তো সেটাই করা উচিত, তাই না!
আরও পড়ুন- রাষ্ট্রের রক্তচক্ষু সত্ত্বেও নোবেল শান্তি পুরস্কারের দৌড়ে! যেভাবে মিথ্যে খবরের জাল ছিঁড়েছেন এই দু’জন
প্রশাসনের তরফে কোনও যোগাযোগ, পুলিশের তরফে, সাহসিকতার পুরস্কার দেওয়ার কথা?
না। কেউ কোনও যোগাযোগ করেননি এখনও। শুধুমাত্র আমার গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধান এসেছিলেন একবার। আর আমাদের বিধায়ক-মন্ত্রী বুলুচিক বরাইক বা বাকি কেউ কিছু বলেননি, আসেননি।
যদি সরকারের তরফে কোনও চাকরি, কাজের প্রস্তাব আসে, কী করবেন তখন?
আমি এরকম কোনও আশা করে এসব করিনি। যদি আসে, পরবর্তী সময়ে ভেবে দেখব। তবে আবার বলছি এসবের জন্য এমন কাজ করলে নিজের মৃত্যুর ভয় ত্যাগ করে লাফিয়ে পড়তাম না।
নিজের প্রাণের তোয়াক্কা না করে অন্যের প্রাণ বাঁচিয়েছেন, সকলেই বলছে আপনিই সমাজের আসল নায়ক। হিন্দু-মুসলিম বিভেদের বাতাবরণে মধ্যেই এক ব্যতিক্রম। আপনার অভিব্যক্তি কী?
আমি নায়ক বা আপনাদের কথা অনুযায়ী, হিরো নাও হতে পারতাম। সেদিন তো বাকি ৮ জনের সঙ্গে আমিও মরতে পারতাম। আমার সন্তান, স্ত্রী, পরিবার ভুক্তভোগী হত। এসব ভাবলে, আমি প্রচারের আলোয় আসব, এমন জানলে এই রিস্ক সামনে-পিছনে না ভেবে নিতাম কি! আমি শুধু বলব, যেটা করেছি, সকলে মিলে সেটুকুই করুন। হিরো নয়, মানুষ হিসেবে অসহায়ের পাশে এগিয়ে যান। প্রাণ বাঁচান। আর্তের পাশে দাঁড়ান। এইটুকুতেই শান্তি। বাকিটা অশান্তির।
ভালো থাকবেন। আপনার মতো মানিকের বড্ড প্রয়োজন মানুষের!
আমার মতো মানিক নয়, সকলেই প্রাণ বাঁচাতে সরব হন। গুজব আর বিভেদ ছেড়ে ঘরে ঘরে মানুষ বাঁচাক সবাই। ধন্যবাদ।

Whatsapp
