কেন দেশজুড়ে আলোড়ন বাংলা ছবি 'দোস্তজী' ঘিরে? কোন জাদুতে মাত অমিতাভ থেকে প্রসেনজিৎ
Dostojee: একাধিক বিদেশি পুরস্কারের ভেলায় চড়ে 'দোস্তজী'-কে নিয়ে এই উন্মাদনা 'হাওয়া' গরমের যুগেও গুরুত্বের বলেই মনে করছেন অনেকেই।
দোস্ত! বন্ধু! না কি সম্পর্কের মায়াজালে এক বিস্তীর্ণ অনুভবের কথা বলবে 'দোস্তজী'? মুক্তির আগেই বঙ্গের 'দোস্তজী'-দের নিয়ে শোরগোল শুরু হয়েছে সিনমা-মহলে। শুধু বঙ্গই নয়, এই ছবির বন্ধুত্বের রেশ ছড়িয়েছে বিশ্বের কোনায় কোনায়। দোস্তজী-কে প্রশংসায় ভরিয়ে দিয়েছেন বলিউডের শাহেনশাহ অমিতাভ বচ্চনও। তিনি সম্প্রতি ট্যুইটারে লিখেছেন, 'পরিচালক প্রসূন চট্টোপাধ্যায়ের ছবি দোস্তজী চারিদিকে সাড়া ফেলেছে। অনেক শুভেচ্ছা।' এই ছবি নিয়ে আশাবাদী বাংলার বুম্বাদা প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় নিজেও। এর প্রচার-কাজ এবং নিবেদনের ক্ষেত্রে বড় দায়িত্বও নিয়েছেন তিনি। কিন্তু কী রয়েছে এই ছবিতে। কেন, বিদেশের একাধিক চলচ্চিত্র উৎসবে সমাদৃত হচ্ছে প্রসূনের ছবি 'দোস্তজী'?
এর গল্পের বুননে মূলত বিরচিত হয়েছে এক গ্রাম আর দুই বালকের বন্ধুত্বের কথা। যেখানে মুর্শিদাবাদের প্রত্যন্ত গ্রামের দুই বালক। যাঁরা একে অন্যের বিপরীত ধর্মের। তাঁদের বন্ধুত্ব এখানে মুখ্য। কিন্তু সেই বন্ধুত্বের মায়াজালে জড়িয়ে গিয়েছে ধর্ম। যার ফলে বিচ্ছেদ আর এর সঙ্গেই এক বন্ধুত্বপূর্ণ ভালবাসার অকাল পতনের কথা বলবে এই গল্প। ভারতীয় সিনেমা-ইতিহাসে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সাধারণ পটভূমিকে ব্যবহার করলেও এই ছবির উপস্থাপন যে মৌলিক, একথা বলছেন অনেকেই।
কিন্তু কী বলছেন এই ছবির স্রষ্টা-পরিচালক প্রসূন চট্টোপাধ্যায়। ইনস্ক্রিপ্টকে তিনি বলেন, ''এই ছবি একটি নির্দিষ্ট ভাবনা থেকে নয়, এক বন্ধুত্বের বেড়াজালে অনেক কিছুর বিচ্ছুরণ। শৈশব, বন্ধুত্ব এবং চিরদিনের জন্য বন্ধুকে হারিয়ে ফেলা। গোটা ছবি জুড়ে রয়েছে এটাই।'' দর্শক কেন হলে গিয়ে দেখবেন 'দোস্তজী'। এর উত্তরে নবীন পরিচালক প্রসূন চট্টোপাধ্যায় জানান, "যাঁরা সিনেমা হলে যাবেন এবং এই ছবিটি দেখবেন, তাঁদের বুকের ভিতর মোচড় দিয়ে উঠবে এটি দেখার পর। এইটুকুই বলতে পারি শুধু।'' অমিতাভ বচ্চনের ট্যুইট নিয়ে তাঁর মন্তব্য, ''সবেমাত্র জেনেছি অভিনেতা অমিতাভ বচ্চন টুইট করছেন। খুব ভালো লাগছে। তারপর যা হয় সেটাই।''
আরও পড়ুন: ‘হাওয়া’-জ্বরে কাবু কলকাতা! এখানেও আড়ালে ঘাপটি মেরে ‘সিন্ডিকেট’?
এই ছবিতে মুখ্য ভূমিকায় দেখা যাবে আনকোরা দুই কিশোর অভিনেতাকে। আসিফ শেখ এবং আরিফ শেখ। পলাশ এবং সফিকুল নামে দুই বন্ধুর চরিত্রে অভিনয় করেছেন ওঁরা। এছাড়াও এই ছবিতে দেখা যাবে জয়তী চক্রবর্তী, স্বাতিলেখা কুন্ডু, অনুজয় চট্টোপাধ্যায়, হাসনেহানা মণ্ডলের মতো অভিনেতাদের।প্রসূন চট্টোপাধ্যায় এই ছবির পরিচালক শুধু নন, ছবির প্রোডাকশন ডিজাইন থেকে শব্দের সজ্জা। সব ক্ষেত্রেই রয়েছেন তিনি। দোস্তজী-র অন্যতম প্রযোজক হিসেবেও রয়েছে প্রসূন চট্টোপাধ্যায়ের নাম।
৬৫তম লন্ডন বিএফআই চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কার। ব্রিটেনে এশিয়ান ফিল্ম ফেস্টিভাল। গতেবর্গ চলচ্চিত্র উৎসবের নর্ডিক প্রিমিয়ার। অলিম্পিয়া শিশু এবং যুব চলচ্চিত্র উৎসব। জলিন চলচ্চিত্র উৎসব থেকে শুরু করে শারজার চলচ্চিত্র উৎসব। দেশের বাইরের একাধিক স্থানের একের পর এক চলচ্চিত্র উৎসবে সমাদৃত হয়েছে এই ছবি। এর সঙ্গেই জুটেছে একাধিক পুরস্কারও। যার বহর চলছে এখনও। এই ছবি বঙ্গের সিনেমা হলে মুক্তির আগেই এমন উত্তেজনা, এই শোরগোল শেষ কবে বাংলা ছবিকে ঘিরে তৈরি হয়েছিল এই রাজ্যে, তা নিয়েও সন্দিহান কেউ কেউ। অনেকেই বলছেন, অমিতাভ বচ্চনের ট্যুইট তো বটেই বহু প্রতীক্ষিত প্রসূনের এই ছবি যে ভালো হবে, একথা আঁচ করা যাচ্ছিল আগে থেকেই। কারণ এই ছবিতে রয়েছে মাটির কথা। সংযোগ স্থাপনের কথা।
প্রসঙ্গত, বহুদিন আগে থেকে 'দোস্তজী'-র কাজ শুরু করেছিলেন পরিচালক। ২০১৭ সাল নাগাদ এর শুটিং শুরু হয় মুর্শিদাবাদে। তারপর বহু টালবাহানায় আটকে ছিল এর মুক্তি-পর্ব। সোশ্যাল দুনিয়ায় ক্রাউড ফান্ডিং করে এই ছবির মুক্তির ভাবনাও নেওয়া হয়। প্রযোজক পেতে সমস্যার মুখে পড়েন নির্মাতা। কিন্তু অবশেষে মুক্তি। দীর্ঘ অপেক্ষার পরে ফের আলোচনায় দোস্তজী। একে পর এক প্রশংসায় মুক্তির আগেই ট্রেন্ডিংয়ে প্রসূনের এই ছবি। নভেম্বরে বড় পর্দায় মুক্তি পাছে এই ছবি।
'দোস্তজী' মনে করাচ্ছে বাংলার মৌলিক ভাবনার ছবির কথা। যা স্বাধীন উদ্যোগে বিরচিত হতে চেয়েছে বারবার। কিন্তু সময় আর সমর্থনের অভাবে সেইসব ছবিও মিলিয়ে যাওয়ার পথ ধরেছে ক্রমশ। কিন্তু মানুষের সামনে, বড় পর্দায় প্রসূনের 'দোস্তজী'-র মতো ফিরে এসেছে সেই সৃষ্টিও।
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলা ছবির জগতে এই স্বাধীন ভাবনার উদ্যোগ চোখে পড়ার মতো। কিছুদিন আগেই পরিচালক কুমার চৌধুরীর 'প্রিয় চিনার পাতা, ইতি সেগুন'- এই ছবিটি আলোড়ন ফেলে। কাশ্মীর, রোহিঙ্গা সংকট, হিন্দু-মুসলমান আর এক সহজ গল্পে এই ছবি ভাবিয়েছিল দর্শককে। বহু চেষ্টায় কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবে দেখানো হয় এই ছবিটি। বিদেশে বিভিন্ন ক্ষেত্রে পুরস্কার জিতে নেয় কুমারের এই ছবি।
'সহজ পাঠের গপ্পো'- মানস মুকুল পালের তৈরি এই স্বল্প বাজেটে ছবিটি মুক্তির আগে থেকেই নজরে আসে সমালোচকদের। গ্রাম্য পরিবেশে আর দুই ভাইয়ের সংসার বাঁচানোর লড়াই দাগ কাটে দর্শক মনে। মানসের সৃষ্টিতে কম বাজেটে আর সাদামাটা অভিনেতাদের বিচ্ছুরণ এই ছবিতে বড় পর্দার অন্তরালেও করে তোলে জীবন্ত। যেখানে গোপাল আর ছোটুর জীবন সংগ্রামের কথা ভাবতে শেখায় বারবার। কিন্তু বাজেট, মুক্তির খরচ আর লড়াইয়ে আটকে ছিল এই ছবিও। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তাঁর রচিত তালনবমীর আদলের কথা এই ছবির গল্পে অনুরণিত হলেও সহজ পাঠের গপ্পো ছিল সহজ আর অনবদ্যও।
'সেমিকোলন', নবীন পরিচালক সুজয়নীল এবং অভীকের এই ছবিও সাড়া ফেলছে। একেবারে কম বাজেটে মৌলিক ভাবনার এই বাংলা ছবি প্রশংসা কুড়িয়েছিল দর্শকমহলে।
'দুধপিঠের গাছ', নবীন পরিচালক উজ্জ্বল বসুর এই ছবি সাড়া জাগিয়েছিল সোশ্যাল দুনিয়ায়। ক্রাউড ফান্ডিং করে বড় পর্দায় মুক্তির উদ্যোগ নেওয়া হয় এই ছবির জন্য। যেখানে নদিয়ার আড়ংঘাটার ৯৩০ পরিবারের সাহায্যে তৈরি হয় এই ছবি। পরবর্তীতে নানা প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে এই ছবিও প্রশংসায় ভাসে। যেখানে দেখা যায় কম খরচে শুধুমাত্র মৌলিক গল্পের ছোঁয়ায় মারাত্মক হতে পারে এক একটি সিনেমা।
সামগ্রিকভাবে 'দোস্তজী'-র মতো বাংলা সিনেমার ইতিহাস দিকে দিকে চর্চিত। একের পর এক মৌলিক ভাবনার প্রকাশ হলেও মানুষের সামনে পৌঁছতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয় নির্মাতাদের। ঠিক সেই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে একাধিক বিদেশি পুরস্কারের ভেলায় চড়ে দোস্তজী-কে নিয়ে এই উন্মাদনা 'হাওয়া' গরমের যুগেও গুরুত্বের বলেই মনে করছেন অনেকেই।