হোটেল-রেস্তোরাঁর বিলের লেজুড় অন্যায্য ট্যাক্স! এই কর দিতে বাধ্য আপনি?
ভারতের কোনও হোটেল বা রেস্তোরাঁ এবার থেকে আর কোনও অতিরিক্ত সার্ভিস চার্জ গ্রহণ করতে পারবে না। কোনও অন্য নামেও ভোক্তার কাছ থেকে কোনওরকম অতিরিক্ত চার্জ গ্রহণ করা যাবে না।
আপনারা কি প্রায়শই হোটেল কিংবা রেস্তোরাঁতে খেতে যেতে পছন্দ করেন? প্রতি উইকেন্ডে কি কোনও একটি রেস্তোরাঁয় কিছুটা সময় কাটানোর পরিকল্পনা থাকে আপনার? কিন্তু খাবার শেষে যখন হাতে বিলটা আসে, সেই সময় কি মনে হয়, যত টাকার খেলাম, তার থেকে অনেক বেশি বিল চলে এল? আসলে এই বর্ধিত বিলের কারণ খাবারের দামও নয়, আবার সরকারকে দেওয়া পণ্য ও পরিষেবা করও নয়। আদতে এই বর্ধিত বিলের কারণ ১৪ থেকে ৩০ শতাংশ অতিরিক্ত সার্ভিস ট্যাক্স, যা কার্যত জোর করেই আপনার বিলের ওপর বসিয়ে দেয় সেই হোটেল বা রেস্তোরাঁটি।
কেন্দ্রীয় সরকারের ক্রেতা সুরক্ষা দফতরের নিয়ম অনুযায়ী কিন্তু এই সার্ভিস চার্জ দেওয়া একেবারেই বাধ্যতামূলক নয়। কোনও হোটেল কিংবা রেস্তোরাঁ বলপূর্বক আপনার বিলের ওপর অতিরিক্ত সার্ভিস চার্জ যোগ করতে পারে না। কিন্তু আসল বিষয়টা হলো, এই হোটেল কিংবা রেস্তোরাঁয় যাঁরা খেতে যান, তাঁদের মধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষই কিন্তু পেমেন্টের সময় বিলটা ভালো করে যাচাই করেন না। যত টাকা বিল অ্যামাউন্ট থাকে, সেই টাকা পেমেন্ট করে বেরিয়ে আসেন। তবে, এবার থেকে হয়তো হোটেল বা রেস্তোরাঁর বিলে এই গরমিল থাকবে না। কারণ সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের কনজিউমার প্রোটেকশন অথরিটি রেস্তোরাঁর সার্ভিস চার্জের বিরুদ্ধেই কিছু নতুন নির্দেশিকা জারি করেছে। চলুন জেনে নিই, কী আসলে এই নির্দেশিকাগুলি।
কী আছে এই নির্দেশিকায়?
৪ জুলাই অন্যায্য বাণিজ্য চর্চা রোধ করতে এবং হোটেল পরিষেবায় গ্রাহকদের স্বার্থরক্ষা করার উদ্দেশ্যে এক নয়া নির্দেশিকা নিয়ে হাজির হয় সেন্ট্রাল কনজিউমার প্রোটেকশন অথরিটি। হোটেল এবং রেস্তোরাঁয় সার্ভিস চার্জ ধার্য করার বিরুদ্ধে এই বিশেষ নির্দেশিকা জারি করে এই কনজিউমার প্রোটেকশন অথরিটি।
আরও পড়ুন: মধ্যবিত্তর পকেটে টান, বাজারের কোথায় কতটা কোপ বসাচ্ছে জিএসটি?
এই নির্দেশিকা অনুযায়ী, এবার থেকে রেস্তোরাঁর অতিরিক্ত সার্ভিস চার্জ সম্পূর্ণ রূপে বন্ধ করে দেওয়া হলো। নির্দেশিকায় জানানো হয়েছে, এবার থেকে আর কোনও হোটেল বা রেস্তোরাঁ খাবারের বিলের ওপর নিজেদের ইচ্ছেমতো অতিরিক্ত সার্ভিস চার্জ বসাতে পারবে না। অন্য কোনও নামেও কোনও অতিরিক্ত চার্জ গ্রহণ করতে পারবে না এই রেস্তোরাঁগুলি। কনজিউমার অথরিটির বক্তব্য, "ভারতের কোনও হোটেল বা রেস্তোরাঁ এবার থেকে আর কোনও অতিরিক্ত সার্ভিস চার্জ গ্রহণ করতে পারবে না। কোনও অন্য নামেও ভোক্তার কাছ থেকে কোনওরকম অতিরিক্ত চার্জ গ্রহণ করা যাবে না। হোটেল এবং রেস্তোরাঁগুলিকে প্রতি ভোক্তাকে জানাতে হবে, সার্ভিস চার্জ দেওয়া বা না দেওয়া সম্পূর্ণ তাঁর ব্যাপার, তা কোনওভাবেই বাধ্যতামূলক না। যদি ভোক্তা ইচ্ছুক থাকেন, তবেই তিনি সার্ভিস চার্জ দেবেন, নতুবা তাকে জোর করা যাবে না।"
নির্দেশিকায় আরও জানানো হয়, "কোনও ভোক্তা যদি সার্ভিস চার্জ না দিতে চান, তাহলেও সেই হোটেলে তাঁর প্রবেশ বন্ধ করা যাবে না, এবং তাঁকে সমস্ত সার্ভিস প্রোভাইড করতে হবে। ভোক্তাদের ওপর কোনওভাবেই সার্ভিস চার্জ বলপূর্বক চাপানো যাবে না। আর সবশেষে, কোনও হোটেল বা রেস্তোরাঁ, খাবারের দামের সঙ্গে সার্ভিস চার্জ যোগ করে সেই মূল অ্যামাউন্টের ওপর জিএসটি বসিয়ে সেখান থেকে সার্ভিস চার্জ কালেক্ট করতে পারবে না।" আর যদি কোনও ভোক্তা তাঁর হোটেল বা রেস্তোরাঁর বিলে সার্ভিস চার্জ যুক্ত দেখে, তাহলে সে ১৯১৫ নম্বরে ফোন করে সেই হোটেলের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করতে পারে।
কী আসলে এই সেন্ট্রাল কনজিউমার প্রটেকশন অথরিটি?
এটি আদতে একটি কেন্দ্রীয় সংস্থা, যা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল জুলাই, ২০২০ সালে, ২০১৯-এর ক্রেতা সুরক্ষা আইনের ওপর ভিত্তি করে। এই সংস্থাটি ক্রেতা অথবা ভোক্তার অধিকার রক্ষা এবং তার বিস্তার নিয়ে কাজ করে থাকে। কেন্দ্রীয় সরকারের এই সংস্থাটি সরাসরি ক্রেতা সুরক্ষা দফতরের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রয়েছে।
বিলে সার্ভিস চার্জ থাকলে ভোক্তা কী করতে পারেন?
আপনি যদি কোনও হোটেল বা রেস্তোরাঁয় খেতে যান, এবং সেখানকার বিলে সার্ভিস চার্জ দেখেন, তাহলে আপনি বিভিন্ন স্তরে অভিযোগ জানাতে পারেন সেই হোটেল বা রেস্তোরাঁর বিরুদ্ধে। মূলত চারটি স্তরে সেই ভোক্তা তাঁর সার্ভিস চার্জ নিয়ে অভিযোগ করতে পারেন। প্রথমত, সেই ভোক্তা হোটেলের ম্যানেজারকে তাঁর বিল থেকে সার্ভিস সরিয়ে দেওয়ার অনুরোধ করতে পারেন। দ্বিতীয়ত, ওই ভোক্তা ন্যাশনাল কনজিউমার হেল্পলাইন নম্বর ১৯১৫-তে ফোন করে ওই হোটেল বা রেস্তোরাঁর অন্যায্য বাণিজ্য চর্চার অভিযোগ দায়ের করতে পারেন। তৃতীয়ত, ওই ভোক্তা সরাসরি কনজিউমার ফোরামে অভিযোগ দায়ের করতে পারেন। এবং সবশেষে, ওই ভোক্তা জেলাশাসকের কাছে ওই হোটেলের বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ দায়ের করতে পারেন।
কেন জারি করা হলো এই নির্দেশিকা?
এই নির্দেশিকা জারি করার মূল বিষয়টি হলো, উপভোক্তাদের লাগাতার অভিযোগ। দীর্ঘ বেশ কয়েকদিন ধরে কনজিউমার প্রোটেকশন অথরিটি বারবার ভোক্তাদের কাছ থেকে বিভিন্ন হোটেলের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাচ্ছিল। ভোক্তাদের অভিযোগ ছিল, হোটেল এবং রেস্তোরাঁগুলি তাঁদের অজান্তেই তাঁদের বিলে অতিরিক্ত সার্ভিস চার্জ যোগ করে দিত। না চাইতেও তাঁদের সার্ভিস চার্জ দিতে হতো হোটেলগুলিতে। এই অভিযোগের ভিত্তিতে ২ জুন, কেন্দ্রীয় ক্রেতা সুরক্ষা দফতর এই সার্ভিস চার্জের বিষয় নিয়ে রেস্টুরেন্ট অ্যাসোসিয়েশন এবং কনজিউমার অর্গানাইজেশনের সঙ্গে একটি বিশেষ বৈঠক করে। এই বৈঠকের পরেই কেন্দ্রীয় ক্রেতা সুরক্ষা দফতর ঘোষণা করে, কেন্দ্রীয় সরকার খুব শীঘ্রই হোটেলের সার্ভিস চার্জ নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য একটা বিশেষ পরিকাঠামো নিয়ে আসতে চলেছে। এই ঘোষণার ঠিক একদিন পরেই কেন্দ্রীয় মন্ত্রী পীযূষ গোয়েল ঘোষণা করেন, হোটেল কিংবা রেস্তোরাঁগুলি গ্রাহকদের তাদের বিলে অতিরিক্ত সার্ভিস চার্জ দেওয়ার জন্য অনুরোধ করতে পারবে না। পীযূষ গোয়েলের এই বক্তব্যই পরবর্তীতে সার্ভিস চার্জ বিষয়ক নির্দেশিকা হিসেবে নিয়ে আসে কেন্দ্রীয় কনজিউমার প্রোটেকশন অথরিটি।
রেস্তোরাঁ জয়েন্টগুলির কী বক্তব্য?
ভারতের রেস্তোরাঁ অ্যাসোসিয়েশন যদিও এই বিশেষ আইন নিয়ে একেবারেই খুশি নয়। তারা দাবি করছে, সার্ভিস চার্জ গ্রহণ করা কোনওভাবেই বেআইনি নয়। এর থেকে সরাসরি সরকারের কাছেও রেভিনিউ পৌঁছে দেওয়া হয়। ফেডারেশন অফ হোটেল এন্ড রেস্টুরেন্ট অ্যাসোসিয়েশন অফ ইন্ডিয়া-র ভাইস প্রেসিডেন্ট গুরবক্স সিং কোহলি বলছেন, বারবার শুধুমাত্র হোটেল ইন্ডাস্ট্রিকে টার্গেট করে ভারত সরকার। সিসিপিএ সম্প্রতি যে নির্দেশিকা জারি করেছে, তা বহু বছর ধরেই মেনে আসছে ভারতের সমস্ত হোটেল এবং রেস্তোরাঁগুলি। সার্ভিস চার্জ তো অনেক ইন্ডাস্ট্রি বিভিন্নভাবে গ্রহণ করে থাকে, আর এই চার্জ গ্রহণ করা তো কোনওভাবেই বেআইনি নয়। তাহলে কেন বারবার হোটেল ইন্ডাস্ট্রিকে টার্গেট করা হচ্ছে? তিনি আরও বলছেন, এই সার্ভিস চার্জের একটা বড় অংশ রেস্তোরাঁর ওয়েটার এবং কুকদের কাছে যায়। এই সার্ভিস চার্জ যদি সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে সবথেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে এই মানুষরাই। তাই তিনি ভোক্তাদের কাছেই আবেদন রেখেছেন, যেন তাঁরা এবার থেকে রেস্তোরাঁ ওয়েটারদের কিছু বেশি টাকা টিপস দেন। তাহলে কিছুটা হলেও তাঁদের সমস্যা কমবে।
আপনি কি তাহলে সার্ভিস চার্জ দেবেন?
কেন্দ্রীয় সরকারের গাইডলাইন অনুযায়ী ভারতের কোনও রেস্তোরাঁই কিন্তু এই ধরনের সার্ভিস চার্জ গ্রহণ করতে পারে না। অনেক হোটেল এবং রেস্তোরাঁ ইতিমধ্যেই এই নতুন নিয়ম মেনে চলতে শুরু করেছে। তবে কিছু দামি রেস্তোরাঁ এই নিয়মের বিরোধী। অনেক রেস্তোরাঁ দাবি করে, তাদের বিলের সঙ্গে যোগ করা সার্ভিস চার্জ তারা সরাসরি ওয়েটার এবং শেফের কাছে পৌঁছে দেয়। তবে, সেরকমটা আদৌ হয় কি না, সেই ব্যাপারটা পুরোটাই অজানা। তাই যদি আপনার কোনও ওয়েটারের সার্ভিস পছন্দ হয়, তাহলে তাঁকে অবশ্যই টিপস দিন, কিন্তু বিলের সঙ্গে অতিরিক্ত সার্ভিস চার্জ দেওয়া নিয়মবিরুদ্ধ। তাই যদি কোনও রেস্তোরাঁ তাদের বিলের সঙ্গে অতিরিক্ত সার্ভিস চার্জ যোগ করে, তাহলে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ জানান।