বন্দুকশিল্প এখন বাংলার 'কুটির শিল্প'? পরপর শুটআউটে উঠছে প্রশ্ন

বিগত কয়েক মাস ধরেই পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক খুনের ঘটনা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। দিনে-দুপুরে চলছে গুলি, সিন্ডিকেটের দৌলতে খাস কলকাতায় জখম হয়েছেন দুই ব্যক্তি। গত মঙ্গলবার বাঁশদ্রোণীতে ঘটা এই ঘটনাজুড়ে এই মুহূর্তে রাজনৈতিক চাপানউতোর চরমে। অভিযোগ উঠছে তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, সিন্ডিকেটের সমস্যা নিয়ে দুই গোষ্ঠীর সংঘর্ষের ফলে আচমকা গুলি চলে এলাকায়। গুরুতর আহত হন মলয় দত্ত ও বিশ্বনাথ সিংহ নামের দুই ব্যক্তি। শোনা যাচ্ছে, এরা দু'জন সিন্ডিকেটের সঙ্গে যুক্ত। 

ঘটনাচক্রে, সোমবার লেক গার্ডেন্সে তৃণমূলের প্রবীণ সাংসদ সৌগত রায়ের বাড়ির কাছে সিন্ডিকেটের যে দুই গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘর্ষের সৃষ্টি হয়েছিল, তার সঙ্গে এই গুলি চালানোর ঘটনার যোগাযোগ রয়েছে বলে জানা যাচ্ছে। সৌগত রায়ের বাড়ির সামনে ঘটে যাওয়া ওই ঘটনায় শেষ পর্যন্ত সৌগত রায়কে হস্তক্ষেপ করতে হয়। জানা যায়, যে বাড়ি ভাঙা নিয়ে বিবাদ চলছিল, সেই বাড়ি ভাঙার কাজ বন্ধ রাখতে পুলিশকে অনুরোধ করেছিলেন সৌগত রায়। এছাড়াও, বৃহস্পতিবার রাতে বেহালায় সিন্ডিকেটের দুই গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘর্ষ হয়। ওই ঘটনায় জখম হয়েছিলেন বেশ কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দা। এর পরেই আবার বাঁশদ্রোণীর ঘটনা।

এখনও পর্যন্ত কংগ্রেস এবং তৃণমূল কংগ্রেসের দুই সাংসদের হত্যাকাণ্ডের ঘটনা বেশ তাজা। সান্ধ্যভ্রমণে বেরিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যু হয়েছিল ঝালদার এক কংগ্রেস কাউন্সিলরের। অন্যদিকে, প্রকাশ্য রাস্তায় বাইক থেকে নেমে মাথা লক্ষ্য করে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল পানিহাটির তৃণমূল কাউন্সিলরকে। তবে, বাংলায় এরকম রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড এই প্রথম নয়। এর আগেও এরকম রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের দস্তুর রয়েছে পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাসে। গত নির্বাচনের আগে বিজেপি নেতা মণীশ শুক্লা এভাবেই খুন হয়েছিলেন। ১৪টি বুলেটে ঝাঁঝরা করে দেওয়া হয়েছিল মণীশের দেহ। কিন্তু এই সমস্ত হত্যাকাণ্ডের মধ্যে থেকে কয়েকটা প্রশ্ন সর্বত্র থেকেই যাচ্ছে। এই খুন কারা করছে? কারা এভাবে হাতের সামনে পাচ্ছে আগ্নেয়াস্ত্র? বাংলার মাটিতে কীভাবে আগ্নেয়াস্ত্র তৈরি চলছে? আর এই সমস্ত আগ্নেয়াস্ত্র তৈরি করছে কারা? 

আরও পড়ুন: জঙ্গলমহলে নতুন করে মাওবাদী সক্রিয়তা?

বাংলায় বন্দুকের রাজনীতি

তবে, পশ্চিমবঙ্গে অতি সম্প্রতি যে সমস্ত রাজনৈতিক খুন ঘটেছে সেখানে একটা নির্দিষ্ট প্যাটার্ন রয়েছে। দুই কাউন্সিলরের খুনের ঘটনায় আমরা লক্ষ্য করেছি রাজ্য সরকারের নীরবতা। এর মধ্যে একজন তৃণমূল কংগ্রেসের কাউন্সিলর ছিলেন, কিন্তু তবুও এই ঘটনায় সরকার সম্পূর্ণ নীরব। ফিরহাদ হাকিম দাবি করেছেন, খুনিরা বহিরাগত। তবে, এই প্রত্যেকটি ঘটনায় কিছু জিনিস একেবারেই একইরকম। যে সমস্ত ঘটনা সম্প্রতিকালে ঘটেছে, সেইসব ঘটনাতেই রয়েছে বাইকবাহিনীর যোগাযোগ। একটা বা দুটো বাইক নিয়ে আততায়ীরা আসছে, যাঁকে হত্যা করার কথা, তাঁর মাথায় বন্দুকের নল ঠেকিয়ে গুলি চালাচ্ছে, তারপর সেখান থেকে সেই বাইক নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু প্রশ্নটা হল, এই নব‍্য প্রজন্মের কাছে এত অত্যাধুনিক অস্ত্র আসছে কোথা থেকে? পশ্চিমবঙ্গে বেআইনি অস্ত্র কারখানার রমরমা কতটা দূর ছড়িয়ে পড়েছে? 

আগেও বেশ কিছু ঘটনায় আমরা লক্ষ করেছি, এই সমস্ত ক্ষেত্রে কিছু বিশেষ ধরনের অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করা হয়। আর এই সমস্ত অস্ত্র-গুলি তৈরি হয় মূলত পশ্চিমবঙ্গের ছোটখাটো বিভিন্ন গ্রামে কিংবা মফস্বলে। কোনও মুদির দোকান কিংবা কোনও ছোটখাটো কারখানার আড়ালে দেদার চলে বেআইনি অস্ত্র তৈরির কাজ। আর খুব সহজেই সেই সমস্ত অস্ত্র পৌঁছে যায় পশ্চিমবঙ্গের এই সমস্ত রাজনৈতিক চ্যালাচামুন্ডাদের কাছে। একটা সময় পর্যন্ত উত্তরপ্রদেশ কিংবা বিহারে এই সমস্ত ঘটনা ঘটত। তবে এখন পশ্চিমবঙ্গেও এই ধরনের ঘটনার রমরমা। একটা সময়ে বাংলায় বিক্রি হতো বিহারের মেড ইন মুঙ্গের বন্দুক। এখন সব বন্দুকই মেড ইন কলকাতা! বাংলা এখন অবৈধ অস্ত্রের কারখানা হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলের কাছে রয়েছে এরকম অস্ত্র। পাড়ায় কোনও সমস্যা হলেই বেরিয়ে আসছে বন্দুক। ছাপোষা মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েদের হাতেও চলে আসছে এইরকম আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র। কিন্তু প্রশ্নটা হল, তারা লাইসেন্স পাচ্ছে কী করে? কে এই সমস্ত লাইসেন্স ইস্যু করছে?

বেআইনি অস্ত্র-চক্র 

সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গে একটি ফেক আর্মস লাইসেন্স র‍্যাকেটের কথা প্রকাশ্যে এসেছে। যে কেউ একটি সাধারণ বন্দুক কিনে এই জালিয়াতি চক্রের কাছ থেকে বন্দুকের লাইসেন্স বের করে নিতে পারে। কিন্তু, এই বিষয়টা পশ্চিমবঙ্গের প্রত্যেকটি জায়গাতে এখন মাথা চাড়া দিয়ে উঠলেও রাজনৈতিক দলের নেতারা এই নিয়ে তেমন মাথা ঘামাতে রাজি নন। পাশাপাশি, কোনও রাজনৈতিক সংঘর্ষে গুলি চলা কিংবা বোমাবাজি এখন পশ্চিমবঙ্গে বেশ সাধারণ একটি ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই নিয়েও তেমন চিন্তিত নন কেউ। প্রত্যেক নির্বাচনের আগেই পশ্চিমবঙ্গে প্রচুর পরিমাণ থোক টাকা, অস্ত্র, বন্দুক এবং বোমা উদ্ধার করে পুলিশের স্পেশাল টাস্ক ফোর্স। কিন্তু, যেটুকু পরিমাণ উদ্ধার হয় সেটুকু শুধুমাত্র ওপরের শাকটুকুই। ভেতরে মাছ যে কতটা আছে, সেটা কেউই জানে না। 

একটা সময় পর্যন্ত রাজনৈতিক ঝামেলায় লাঠি কিংবা ছুরি বেরিয়ে আসত। আর এখন সরাসরি হাতে চলে আসছে বন্দুক। যে কোনও সময় যে কোনও ঝামেলায় বন্দুক হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক নেতাদের ও রাজনীতির বর্তমান দিকপালদের প্রধান অস্ত্র। কিছুদিন আগে মালদার একজন তৃণমূল নেতা হাতে একটি বন্দুক নিয়ে ফেসবুকে ছবি পোস্ট করে দিয়েছিলেন। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তিনি দাবি করেন, ওটি আসলে পাখি মারার বন্দুক। এছাড়াও, তৃণমূল পঞ্চায়েত ছেলের হাতের বন্দুক ভাইরাল হতে না হতেই হয়ে যায় খেলনা বন্দুক। দেগঙ্গাতেও দিনকয়েক আগে বন্দুক হাতে নিয়ে এলাকাজুড়ে তাণ্ডব করেছিলেন একজন তৃণমূল নেতা। এছাড়াও, বোমা-বন্দুক দেখিয়ে সিপিএমের পঞ্চায়েত সদস্যকে অপহরণ করার অভিযোগ উঠেছিল কোনও 'মহিলা গ্যাং'-এর বিরুদ্ধে। কিন্তু, সবার হাতে কেন বন্দুক এতটা সহজে আসছে? বাংলায় কি তাহলে এবারে বন্দুক শিল্প একটা কুটির শিল্পের আকার নিল?

আরও পড়ুন: দলে থেকেই ফোঁস! সিবিআইয়ের তলব ঘিরে দেবের প্রতিক্রিয়া কেন দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে?

বাংলার বন্দুক শিল্প 

কিছুদিন আগে বাংলার এক প্রেমিক-প্রেমিকা জুটির খবর শিরোনামে উঠে আসে, যেখানে সম্পর্কের টানাপোড়েনের ফলে অতিষ্ঠ হয়ে এক বাইশ বছরের তরুণী তার প্রেমিককে গুলি করে হত্যা করতে চায়। সে সফল না হলেও, তার হাতে বন্দুক, গুলি লাইসেন্স সবকিছু চলে আসা বাংলার একটি আলাদা রূপ চোখের সামনে নিয়ে আসে আমাদের। বিগত দুই দশকে বাংলায় আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের প্যাটার্ন অনেকটাই পাল্টে গেছে। একটা সময় ছিল, যখন শুধুমাত্র গুন্ডা-মস্তানদের হাতে শোভা পেত এই বন্দুক নামক বস্তুটি। কিন্তু, আজকাল পলিটিশিয়ান থেকে শুরু করে পারিবারিক ঝামেলা, বন্ধুদের মধ্যে ঝামেলা সবকিছুতেই বেরিয়ে আসছে আগ্নেয়াস্ত্র, চলে যাচ্ছে গুলি! 

এখন আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করা পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে খুবই সহজ একটা বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। একদিকে যেমন পশ্চিমবঙ্গে বাইরের রাজ্য থেকে আগ্নেয়াস্ত্র প্রবেশ করা শুরু হয়েছে, সেরকমই পশ্চিমবঙ্গেও কিন্তু তৈরি হয়েছে একটা আগ্নেয়াস্ত্র তৈরি করার চক্র। শহরতলি বা মফস্বল অঞ্চলে অনেক জায়গাতেই ব্যাঙের ছাতার মতো এরকম কিছু কিছু কারখানার আবির্ভাব ঘটেছে বিগত কয়েক বছরে। আর এই সমস্ত কারখানা তৈরি হওয়ার ফলেই, পশ্চিমবঙ্গে বেআইনি অস্ত্র রমরমিয়ে চলতে শুরু করেছে। কিন্তু প্রশ্নটা হল, পশ্চিমবঙ্গে এই বেআইনি অস্ত্র পাওয়া এবং তা ব্যবহার করা কতটা সহজ?

যদি আপনি ঠিকঠাক কৌশলে চালাতে পারেন, তাহলে আপনি কিন্তু বাড়িতে বসেই কিনে ফেলতে পারবেন আপনার জন্য একটি পিস্তল কিংবা অন্য অস্ত্র। ফেসবুক গ্রুপ, হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ খুলে দিব্যি এই ধরনের ব্যবসা চলতে শুরু করেছে পশ্চিমবঙ্গে। সেখানে পেশ করা হচ্ছে কিছু ক্যাটালগ। সেই ক্যাটালগ থেকে আপনি নিজের পছন্দমতো গুলি এবং বন্দুক কিনে ফেলতে পারবেন খুব সহজেই। আর ডেলিভারিও দেওয়া হচ্ছে একদম সুরক্ষিতভাবে। বিক্রেতা কিংবা বিক্রেতার কোনও শাগরেদ নিজেই ব্যাগে পুরে বাড়ি বাড়ি গিয়ে সাপ্লাই করছে এই সমস্ত আগ্নেয়াস্ত্র। আবার আগ্নেয়াস্ত্র খারাপ হলে সেটা সারাই করার জন্য সার্ভিস সেন্টারও খুলে বসেছে এই সমস্ত ব্যবসায়ীরা। এদের মধ্যে পুলিশের জালেও ধরা পড়েছেন অনেকেই, কিন্তু এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গের এই চক্র এতটাই বড় আকার ধারণ করেছে যে শুধুমাত্র একটা-দুটো জায়গায় আগ্নেয়াস্ত্র ধরা পড়লে কোনও লাভ নেই। যে-কোনও শান্ত নিরিবিলি জায়গায় একটা লেদ মেশিন ব্যবহার করেই তৈরি করে ফেলা যায় এই ধরনের বন্দুক। আর এই সমস্ত বন্দুকের কার্তুজের দাম অনেক কম। তাই সামনে-পিছনে কিছু না ভেবেই মানুষের কিনে ফেলেছেন এই ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র।

মুঙ্গের কি এখন বাংলায়?

একটা সময় ছিল, যখন বেআইনি আগ্নেয়াস্ত্রের কথা উঠলেই সবার মুখে আগে উঠে আসত বিহারের মুঙ্গেরের কথা। এই এলাকাটি একটা দীর্ঘ সময় পর্যন্ত বেআইনি অস্ত্রশস্ত্র তৈরি করার জন্য কুখ্যাত ছিল। মুঙ্গেরের প্রত্যেকটি বাড়িতেই এই ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র তৈরি করার ব্যবসা এখনও চলছে। কিন্তু, দীর্ঘ বেশ কয়েক বছর ধরেই বিহার থেকে প্রচুর মানুষ পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশ করেছেন। আর তারাই শুরু করেছেন তাদের বাপ-ঠাকুরদার শিখিয়ে দেওয়া অস্ত্রের কারবার। এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গের এই সমস্ত বেআইনি অস্ত্র কারখানাগুলিতে সবচেয়ে বেশি যে ধরনের বন্দুক তৈরি করা হয়, সেটা হল ওয়ান শটার বন্দুক। এই বন্দুকের দাম মাত্র চার হাজার টাকা এবং এই বন্দুকের প্রতিটি গুলির দাম মাত্র ৪০ টাকা করে। আর যদি আপনি এর থেকে ভাল কিছু কিনতে চান, তাহলে আপনার কাছে রয়েছে নাইন এমএম পিস্তলের বিকল্প। এই বন্দুকের দাম মোটামুটি ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা করে এবং এর কার্তুজের দাম প্রতিটি ৪০০ টাকা করে। অর্থাৎ একটা ভাল মোবাইল ফোনের থেকে কম দামে আপনি পেয়ে যাচ্ছেন একটা ভাল বন্দুক। তাহলে, এই বন্দুক পাড়ার মস্তানরা কেন কিনবে না? আর কেনই বা রাজনৈতিক ঝামেলায় বন্দুক বেরবে না? 

পশ্চিমবঙ্গ এখন অস্ত্রভান্ডার

বছরদুয়েক আগে একজন পুলিশ কর্তা একটি টিভি চ্যানেলে অকপটে স্বীকার করেছিলেন, পশ্চিমবঙ্গ এই মুহূর্তে অস্ত্রভান্ডার হয়ে উঠেছে। এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গের জায়গায় জায়গায় তৈরি হচ্ছে অস্ত্র। আমার-আপনার বাড়ির পাশেই হয়তো একটা অস্ত্র তৈরির কারখানা রয়েছে, অথচ আমরা কেউ জানি পর্যন্ত না। ঠিকঠাক লোককে ধরতে পারলেই, খুব সহজেই আপনার পছন্দসই বন্দুক আপনার হাতে চলে আসবে। ২০১৯-এর একটি সমীক্ষা থেকে উঠে এসেছে, বেআইনি অস্ত্র উদ্ধারের ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ এই মুহূর্তে রয়েছে দেশের চতুর্থ স্থানে। এর আগে যে তিনটি রাজ্য রয়েছে, সেগুলি হল উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান এবং মধ্যপ্রদেশ। 

অর্থাৎ, যেটুকু ধরা পড়েছে, সেটুকুই নিরিখেই এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গ রয়েছে চতুর্থ স্থানে, তাহলে এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গে অস্ত্র কতটা পরিমাণ রয়েছে তা আন্দাজ করতে পারলে অবস্থা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, বলা কঠিন। এখনও অনেক পরিমাণ অস্ত্র রয়েছে, যে গুলি উদ্ধার করা যায়নি। কিন্তু, এই অস্ত্র উদ্ধার করা হচ্ছে না কেন? অনেকের মতে, এই অস্ত্র তৈরির পিছনে সরাসরি মদত রয়েছে পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক নেতাদের। পশ্চিমবঙ্গে এই মুহূর্তে বছরজুড়েই নানা অস্ত্রশস্ত্র কেনাবেচার পালা চলতে থাকে। তবে, বন্দুক বাজার সবথেকে বেশি জমে ওঠে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন ভোটের সময়। এই সময়েই অস্ত্রের বাজার যেন ফুলে-ফেঁপে ওঠে। 

আর এবারের পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচন এর সবথেকে বড় প্রমাণ। এবারের বিধানসভা নির্বাচনের আগে যেরকম ট্রেন্ড চলছিল, তাতে স্পষ্ট বলা যায়, প্রচুর পরিমাণ অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছিল ভোটের বাজার গরম করার জন্য। আর এটা যে শুধুমাত্র রাজনৈতিক নেতাদের কিংবা ক্রিমিনালদের কাজ, তা কিন্তু না, পাড়ার যে কোনও উঠতি মস্তানের হাতেও এই মুহূর্তে রয়েছে একটি বন্দুক। তার মূল কারণ হল, এই ধরনের বন্দুক অত্যন্ত সহজলভ্য এবং এই বন্দুকের দাম অত্যন্ত কম। 

হাতে বন্দুক নিয়ে এক তৃণমূল নেত্রীর ছবি সোশ্যাল মিডিয়াতে ভাইরাল হয়ে উঠেছিল কয়েকদিন আগে। দেখে আসল বন্দুক মনে হলেও, তৃণমূল নেত্রী তুললেন সেই 'খেলনা' তত্ত্ব। তবে শুধু তৃণমূল একা নয়, বিরোধীরাও খুব একটা কম যায় না। কিছুদিন আগে পেট্রল পাম্পে এক বিজেপি নেতার ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল, যেখানে তিনি বলছেন, তাঁকে বোতলেই পেট্রল দিতে হবে না হলে পেট্রল পাম্পে গুলি চালিয়ে দেবেন তিনি। তার ওপর, একাদশ শ্রেণির ছাত্রের সঙ্গেও মিলেছিল আগ্নেয়াস্ত্র পাচারের যোগ। কিছুদিন আগে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে সে নিজের দোষ স্বীকার করলেও, সমাজের অবনতির চিত্র এই একটা ঘটনা থেকে স্পষ্ট। হয়তো, এখন শুধুমাত্র আগ্নেয়াস্ত্র পাচারের সঙ্গে স্কুলের ছাত্রদের যোগ মিলছে। হয়তো একদিন এমন হবে, যখন স্কুলের ব্যাগে করেই স্কুলের ভিতরে প্রবেশ করে যাবে একটি বন্দুক। চলে যাবে গুলি! এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গের কমবেশি প্রত্যেকটি জেলা থেকেই পুলিশ কমবেশি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করেছে। নানা জেলা থেকে এই ধরনের বেআইনি আগ্নেয়াস্ত্র তৈরির কারখানা ধ্বংস করেছে পুলিশ। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যেই সেখানে তৈরি হয়ে যাচ্ছে অন্য একটি কারখানা। 

'রাঘব-বোয়াল'-রাও কম যান না

এই বন্দুক নিয়ে হামলার ঘটনায় সব সময় অভিযোগের আঙুল ওঠে এলাকার নীচু স্তরের রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে। কিন্তু বিরোধী দল কিংবা শাসকদলের বড় রাজনৈতিক নেতারাও কিন্তু এর থেকে কম যান না। কিছুদিন আগে বিজেপি নেত্রী রূপা গঙ্গোপাধ্যায় প্রকাশ্য মঞ্চ থেকে হুংকার দিয়েছিলেন, তিনি নাকি খুব ভাল AK-47 বন্দুক চালাতে পারেন। তিনি এক ব্যারেল, দুই ব্যারেল, সব ধরনের বন্দুক চালাতে জানেন। বিজেপির কর্মীরা শুধুমাত্র বসে বসে মার খাবে না, তারা পাল্টা মারতে জানে। মনে পড়ে যায়, বহুদিন আগে একটি রাজনৈতিক সভা ঘিরে ঝামেলায় তপন শিকদার বলেছিলেন, সঙ্গে তাঁর বন্দুকটা থাকলে তিনি দেখে নিতেন। বাম সরকারের দমকলমন্ত্রী প্রতিম চট্টোপাধ্যায়ও একবার নিজের পিস্তল থেকে গুলি চালানোর হুঁশিয়ারি দেন। তবে সেই সময়ের থেকে অনেকটাই অগ্নিগর্ভ এই সময়ের প্রেক্ষিত।

অনেকে মনে করতে পারেন, এই বিষয়টা রাজনীতির অঙ্গীভূত হয়ে উঠেছে এই মুহূর্তে। দলের কর্মীদের উদ্বুদ্ধ করার জন্য সকলেই এই ধরনের কথাবার্তা বলেই থাকেন। কিন্তু, ভেবে দেখার বিষয়টা হলো, যদি কোনওদিন সেই দলের কোনও ছোটখাটো কর্মী এই বিষয়টা সিরিয়াসলি গ্রহণ করে নেয়, একটা অবৈধ বন্দুক কিনে যদি কোনওভাবে চালিয়ে দেয়? তাহলে হয়তো সেই বক্তৃতা আর শুধু বক্তৃতার জায়গায় সীমিত থাকবে না। কীভাবে পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতির মধ্যে এই বেআইনি আগ্নেয়াস্ত্র বিষয়টি ছড়িয়ে পড়েছে, কীভাবে বেআইনি অস্ত্র কারবার রমরমিয়ে চলতে শুরু করেছে সারা বাংলায়, সেটার ইয়ত্তা পর্যন্ত নেই সাধারণ মানুষের। এখন যে-কোনও সাধারণ ব্যক্তিও সামান্য কিছু টাকা খরচ করে কিনে ফেলতে পারেন নিজের জন্য একটা আগ্নেয়াস্ত্র বা ফেক আর্মস। যদি এরকমভাবেই রাজনীতি এবং সমাজনীতি চলে, তাহলে সত্যিই একদিন এমন হবে, যেদিন বন্দুকশিল্পই হয়ে উঠবে বাংলার 'কুটির শিল্প'।

More Articles