প্রিয় বাবা, আমি কি তোমার কমরেড হতে পারি না?

Father's Day 2023: তোমার বন্ধুরা চলে যাচ্ছে একে একে, বুঝি। আমি তোমার বন্ধু হতে পারি না বাবা? চেষ্টা করবে একবার?

বাবা,

কবীর সুমনের এই গানটা তুমি বোধহয় শোনোনি—

"তিনি বৃদ্ধ হলেন, বৃদ্ধ হলেন

বনস্পতির ছায়া দিলেন সারা জীবন

এই বুড়ো গাছের পাতায় পাতায়

সবুজ কিন্তু আজও মাতায়

সুঠাম ডালে...

ডালই বলো, ভাতই বলো

গান বাজে তার গেরস্থালির তালে তালে"

এই কথাগুলো হুবহু আমার জানো, আর এই ছবিটা তোমার। স্কুল-কোচিং-কলেজ-কেরিয়ার-অনিশ্চয়তার মধ্যে দিয়ে এক-একটা করে জন্মদিন পেরিয়ে বড়ো হতে হতে কখনও তোমাকে যখন দেখি, দেখি অবিকল একটা গাছ। বিরাট। ঠান্ডা। খাঁ খাঁ রোদে ঝুরি নেমে এসেছে মাটিতে, আর তার ছায়ায় হেলান দিয়ে বসে আছে আমার ঊনত্রিশটা বছর।

"ওহে ও গেরস্থ, ভীষণ ব্যস্ত

একটু ভালো চা পাওয়া যায় কোন দোকানে

ওহে সবজিওয়ালাই বন্ধু তোমার

সবুজ বেচা মানুষ আসে তোমার টানে

ওহে প্রতিদিনের বাজার যাওয়া

থলি হাতে কেটে গেল সারা জীবন..."

রোজকার বাজারের ব্যাগ, মায়ের প্রেসক্রিপশন, ব্যাঙ্ক, ইনসিওরেন্সের ডাঁই করা কাগজ সামলানোর পরও তুমি কী অবলীলায় মনে রাখো বিবাহবার্ষিকীর দিন। আমি দেখতে পাই, ওই তো কাঁধে ব্যাগ নিয়ে একটা ফর্সা লোক সাইকেল চালিয়ে অফিস থেকে ফিরছে বছরের পর বছর, একের পর এক মিটিয়ে চলেছে ছেলে-মেয়ের আবদার-চাহিদা-প্রয়োজন-অপ্রয়োজন, ভালোবাসছে আমার মা'কে, ঝগড়া করছে সারা সন্ধে। ওই তো লোকটা চেয়ারে বসে কাগজ পড়তে পড়তে ঢুলছে। একটা সিগারেট ধরালো। ভোরবেলা উঠে প্রাণায়াম করছে। ওই তো, লোকটা ঘেমে নেয়ে বাগানের মাটি কোপাচ্ছে, টবের গাছে জল দিচ্ছে, বুঝে নিচ্ছে কতখানি সার দিলে আর যত্ন নিলে কতখানি ফুল...

জানো, কয়েক বছর আগের যে সন্ধেটায় মানপত্র-ছাতা-শাল-মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে বাড়ি ফিরলে, খুব কান্না পেয়েছিল। তুমি কিন্তু একইরকম হাসছিলে— বত্রিশ বছরের অভ্যেস ফুৎকারে উড়িয়ে একটা লোক হাসতে হাসতে কেবল মেনে নিচ্ছিল সময়কে।

তুলসীমঞ্চের সামনে দাঁড়িয়ে 'জবাকুসুম সঙ্কাশং'-এ তোমাকে দেখেছি। আবার 'গণশক্তি', 'সমন্বয়', 'সংগ্রামী হাতিয়ার'-এ ডুবে থাকতে দেখেছি, সমিতি ভবন-কোঅপারেটিভে দেখেছি, লাল পতাকার নীচে গণসঙ্গীতে দেখেছি। বাবা, তুমি কখনও কবিতা লেখোনি (নাকি লিখেছ, কখনও দেখাওনি কাওকে?), তবে পান্নালালের শ্যামাসঙ্গীতে, ভূপেন হাজারিকায় বুঁদ থাকতে দেখেছি তোমাকে। এতখানি সহনশীলতা, এতখানি সাবলীলভাবে বেঁচে নেওয়া— আমার কাছে পুরুষকারের শেষ কথা তুমি— কমরেড।

মাঝে মাঝে অ্যালবাম হাতড়ে আমাদের ছেড়ে আসা হাসি হাসি মুখগুলো দেখি আর দেখতে পাই অত্যন্ত সাধারণ একটা মানুষ কুচি কুচি মধ্যবিত্ত স্বপ্ন নিয়ে আস্তে আস্তে আস্তে এগোচ্ছে... হিসেব করছে আর কতটুকু হলে আর একটু ভালো রাখা যায় নিজের মানুষগুলোকে।

পিছন ফিরে দেখি দিদির ঘুঙুরে, হারমোনিয়ামে, আমার তবলায়, আঁকার ক্লাসে আস্ত ছেলেবেলাটা জুড়ে মায়ের পাশাপাশি মিশে আছে একটা পরম নিশ্চয়তা, তুমি, বাবা, যে ছোট্ট আমি'র জ্বর-কপালে গাল ছুঁইয়ে শুষে নিচ্ছে তাপ, বলছে "এই তো বাবু আমি এসে গেছি, আর কষ্ট থাকবে না..."

"দেখো, বইছে এখন বয়সকালে

পাতায় পাতায় এবং ডালে

কালের ওজন...

তিনি বৃদ্ধ হলেন, বৃদ্ধ হলেন

আমায় ছেড়ে বুড়ো হলেন আমার সুজন"

বাড়ি গেলে শেষ রাতের দিকে কোনও কোনওদিন উঠে যাই তোমাদের ঘরে। দেখি, আমার কবিতার মতো মায়ের পাশে শুয়ে নিষ্কলঙ্ক ঘুমোচ্ছে একটা কাল— আমি আলতো ছুঁয়ে থাকি তোমাকে, বাবা। চেতনা বলে তখন কিছু থাকে না। কাঁদি। বাইরে আলো ফুটতে ফুটতে প্রাণপণে বুঝে নেবার চেষ্টা করি এই ক'টা বছরে আমি কতখানি তুমি হয়ে উঠতে পেরেছি।

আর ক'বছর থাকো বাবা, তোমাকে হারিয়ে ফেললে তোমার অকর্মণ্য ছেলের অবলম্বন বলে কিছু থাকবে না। দূর থেকে হারানোর ভয় পাই, কাছে গেলে কত কথা বলি না তোমাকে, কিছু অপছন্দ হলে রেগে যাই, এ আমার অপারগতা। তুমি যে আছো, এ আমার অদৃশ্য খুঁটি বাবা। সাফল্য আমি পাব কিনা জানি না, আমার সময়ে সাফল্য কী— তারও সবটা বুঝি না। তোমরা শিখিয়েছ ছুটতে হবে— বুঝে নিতে হবে নিজেরটা। ছুটছি। তুমি আর মা যে আছো সর্বক্ষণ, কথা না হলেও, দেখা না হলেও— এ বিশ্বাস এই ছুটন্ত ঘোড়ার পিঠে চাবুকের মতো। শরীর ভেঙে গেছে, চামড়ায় ছোপ তোমার, রোদে বেরোলে হাঁপিয়ে যাচ্ছ খুব, দেখতে পাই— তোমার বন্ধুরা চলে যাচ্ছে একে একে, বুঝি। আমি তোমার বন্ধু হতে পারি না বাবা? চেষ্টা করবে একবার? যদি নাও পারি, তুমি যেন যেও না কোথাও...

 

ইতি,

রোজ তোমার মতো হতে চাওয়া তোমার ছেলে

More Articles