বাবা, আমার মধ্যে কীসের অভাব ছিল যে সারাজীবন তোমার ভালোবাসা পেলাম না?
Father's Day 2023: তুমি ভালো থেকো, বাবা। আমি তোমায় আজও সত্যিই খুব ভালবাসি। কিন্তু তুমি আর কখনও আমায় ফোন কোরো না, কেমন?
শ্রীচরণেষু বাবা,
ছোটবেলার স্কুলপাঠ্যে এভাবে চিঠি শুরু করতে হয় শিখেছিলাম বলে তোমাকে এমনভাবে লিখছি। এত চিঠি স্কুলজীবনে লিখেছি, বাংলা পরীক্ষায় কখনও দশে আট পেয়েছি। স্বপ্না আন্টি বলত আমার চিঠিতে "বয়স অনুযায়ী দুঃখের ভার বেশি"। তবু তোমায় কোনও একদিন চিঠি লিখব তা কল্পনাও করিনি। করিনি কারণ কোথায়, কোন ঠিকানায় চিঠি পাঠাতাম? কে.পি রায় লেনে নাকি যাদবপুর-সেলিমপুরের কোন ব্রিজের নিচে এক সম্ভ্রান্ত পাড়ায় নিজের শ্বশুরবাড়িতে তুমি থাকো, সেই ঠিকানায়? মাঝখানের সাতাশটি বছরের ব্যবধানে আমি যতবার তোমার কথা ভেবেছি কোনওবার অবশ্য কে.পি রায় লেন বা যাদবপুরের কথা আমার মনে আসেনি। ওই মনে ভিড় করে ছিল কেবল মুচিপাড়ার যশোদা বারিকের ছোট্ট এক চিলতে ভাড়ার ঘরটা। ওতে আমি, তুমি আর মা ছিলাম কোনও এক শীতকালের কয়েকটা দিন। সেইই আমাদের তিনজনের প্রথম এবং শেষ একসঙ্গে থাকা। মা আমার কত ভালো রান্না করে, ঘর গোছায়, সস্তায় বাজার করে, আয়নার সামনে পরিপাটি সাজে আর মাঝে মাঝে মধ্যরাতে বাথরুম যাওয়ার জন্য উঠে টিউবলাইটের আলো-পড়া মায়ের ঘুমন্ত মুখটার দিকে তাকিয়ে আমি ভাবি কী কমতি ছিল এই মেয়েটার মধ্যে যে ওকে ছেড়ে, একমাত্র ছেলেটাকে দূরে ঠেলে তোমায় অন্য কারও সঙ্গে ঘর বাঁধতে হলো? এখন যখন তুমি বলো সেটা তোমার অন্যায় হয়েছিল তখন হাসি পায় আমার। অনেকদিন পর হাহা করে হেসে মনের ভার লাঘব হয়।
তুমি জানো না, যখন স্কুলে সবার মা-বাবা আসত গার্জেন মিটিংয়ে আর আমার কেউ আসত না মাসতুতো দিদি ছাড়া, যখন সবাই করুণার চোখে আমার দিকে তাকাত যেন আমি অনাথ- ইচ্ছে হতো চিৎকার করে বলি, "তোমরা ভুল ভাবছ! আমার বাবা আছে। আমি, মা আর বাবা কয়েকদিন একসঙ্গে থেকেছি। আবার একদিন থাকব", তখন মনের ভেতরটা কেমন লাগত আমার! শুভজিৎ ওর বাবার বুকে ছুট্টে গিয়ে পড়ত যখন, আমার বুকে কে যেন একটা ঘুষি মারত আর আমি না দেখার ভান করতাম। নিজেকে বলতাম শুভজিতের ওগুলো আদিখ্যেতা। এরকমই ঘুষি পড়ত যখন মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিকের সময় বন্ধুদের বাবারা ছেলেদের ব্যাগ বয়ে নিয়ে আসত বা মিষ্টির দোকানে দাঁড় করিয়ে পেট ঠান্ডা করার জন্য দই খাওয়াত। ওদের বাবাদের নিশ্চয়ই তেমন কাজ থাকত না। আমি পাকামি করে গর্ব বোধ করতাম যে আমার বাবা ব্যস্ত বাবা। সময় পায় না। নাহলে আমরা আবারও একদিন একসঙ্গে থাকতাম। 'জখম' সিনেমায় কী সুন্দর একজন বাবা মাঝে মাঝে বাড়ি আসত। তুমি ওইরকম এলেও আমি খুশি থাকতাম। তোমায় একটু দেখতে পারলেই হতো। কারও সঙ্গে তোমাকে ভাগ করে নিতে আমার কোনও অসুবিধা ছিল না। ওই যে 'নূপুর' রেস্টুরেন্ট থেকে তোমার আনা শিক-কাবাব জ্যাঠার মেয়ে টুম্পাদি আমায় না দিয়ে খেয়েছিল আর সন্ধাবেলা গা ধুয়ে এসে জেঠিমা তোমায় বলছিল পিঠে হাত যাচ্ছে না তাই তুমিই ব্রায়ের স্ট্র্যাপটা লাগিয়ে দাও, সেদিন কই আমার তো মনে হয়নি তুমি ওদের হয়ে যাচ্ছ! তুমি তো ওদের কাকা। তোমার ভাইরাও ওদের কাকা। কিন্তু আমার তো বাবা একটাই এবং সেটা তুমি।
শুনেছি তুমি নিজের বাবাকে ছোটবেলায় হারিয়েছিলে। নিজে মানুষ হয়ে আপন ভাইগুলোকে পিতৃস্নেহে মানুষ করেছিলে। তুমি বাচ্চা-পাগল লোক ছিলে, রাস্তার বাচ্চাকেও কোলে তুলে আদর করতে, আমার মাসতুতো ছোটদি টিঙ্কু ছোটবেলায় বমি করে করে তোমার খয়েরি শার্ট সাদা করে দিত তবু তুমি ওকে কোল থেকে নামাতে না। কত কথা শুনেছি তোমাকে নিয়ে আর ততবারই নিজের প্রতি রাগ হয়েছে যে আমার মায়ের মতো আমার মধ্যেও নিশ্চয়ই কিছুর অভাব ছিল যে জন্য সারাজীবন তোমার সঙ্গ পেলাম না। ভালোবাসা তো নয়ই।
তুমি কোনওদিনই জানতে না পুজোর সময় বন্ধুদের নিয়ে ঘুরতে বেরলে আমি একদিন না একদিন কে.পি রায় লেনের বাড়ির পাশ দিয়ে যেতামই। ভাবতাম যদি তুমি রোয়াকটায় বসে থাকো! কিন্তু সেটা হয়নি কোনওদিন। কখনও দেখেছি ঠাকুমা বসে আছে আবার কখনও রোয়াক একেবারেই ফাঁকা। আবার সাহস করে যে ওই বাড়িতে ঢুকব তাতেও ভয় লাগত। সেই একবার মনে আছে, মা আর খুকুদি ডাক্তার দেখাতে যাবে বলে আমাকে ও-বাড়ি কয়েক ঘণ্টার জন্য রেখে এসেছিল আর ঠাকুমা কী সাংঘাতিক রেগে গিয়েছিল? দুপুরের ভাতে সবাই যখন একসঙ্গে বসেছে- তুমি, আমি আর তিন কাকা, ঠাকুমা গজর গজর করেই যাচ্ছে, একবার বলেই ফেলল, "কোন ভাগাড় থেকে জন্ম দিয়ে এনে আমার ছেলের ঘাড়ে চাপাচ্ছে!" আমি সেদিন ডাল-ভাতের সঙ্গে কান্না মিশিয়ে কী করে খেতে হয়, শিখেছিলাম। স্বাদ একেবারেই নোনতা হয়! ওই স্বাদ আর কোনওদিন পেতে চাইতাম না বলে ঠাকুমার বাড়ি ঢোকার সাহস করতাম না। ছোটবেলা থেকে আজ অবধি একটা রাতও ও-বাড়ি কাটাইনি।
আমার নিজের বাড়ি ছিল মাসি-মেসোর কোয়ার্টার্স। মাসির ছয় ছেলেমেয়ের মধ্যে আমিও একজন ঠিক মানুষ হয়ে গেলাম। দিদিরা আমার মা হয়ে উঠল আর ওই যে মেসো আমায় গালি দিতেন, মারতে আসতেন আমার খারাপ লাগত না। আনন্দ হতো বরং কারণ তিনি বাকি ছেলেমেয়েদের মানে দাদা-দিদিদেরও গালি দিতেন, মারতে ছুটতেন। এই যে অত্যাচারের মধ্যেও সবাইকে এক করে দিতেন মেসো কোথাও একটা স্নেহ লুকিয়ে থাকত ওঁর, আমি ওই ছোট বয়সেই টের পেতাম। তবু আমি মেসোকে বাবা ভাবতে পারতাম না। সঙ্গে না থাকলেও আমার বাবা তুমিই ছিলে এবং থাকবে। শুধু তোমাকে কাছে পাওয়ার সৌভাগ্য ছিল না। অনেক বছর পর আমার বন্ধু সূর্যদের বাড়িতে কয়েকদিনের জন্য ওর মাসতুতো ভাই বনি থাকতে এসেছিল। ভাইবোনে ঝগড়া লাগলে বাচ্চা ছেলেটা একটা কথা বলত খুব যাতে আমার হাসি পেত, "বেশি কথা বলবে না আমার বাবা তোমাদের দেখে নেবে।" এটা শুনলে তখন হাসি পেলেও বাড়ি এসে চোখে জল আসত। আমাকে স্কুলে মাইনে না দেওয়ার জন্য যখন লেখা থামিয়ে বসিয়ে রাখা হতো, দুপুরে বাড়িতে ডেকে বুবুলদা প্যান্ট খুলতে বলত যখন, খেলার মাঠে বড়রা খেলতে না পারলে ফটাফট চড় মারত যখন কিংবা আমার বয়সি বাচ্চারা পুজোতে কত কত জামা পরত আর আমার দিদিদের দেওয়া একটাই জুটত- তখন কাউকে আমি বনির মতো বলতে পারতাম না "আমার বাবা তোমাদের দেখে নেবে।" আর তাই কান্না পেত। খুব কান্না পেত। তবু তোমাকে আমি ভালোবাসতাম খুব। আসলে এই ভালোবাসার রোগটা মায়ের কাছ থেকে পাওয়া। মা কোনওদিন তোমার কথা বলা থামায়নি। তোমার সম্বন্ধে একটা কটু কথা বলেনি এতগুলো বছরে। বলত, তুমি ফিরে আসবে। কোনও এক শ্রাদ্ধবাড়িতে তুমি বউ নিয়ে গিয়েছিলে আর আমিও ছিলাম। বাড়ি ফেরার পর মা বার বার জিজ্ঞেস করছিল, অত ছোটবয়সের আমাকে মা জিজ্ঞেস করছিল তোমার বউয়ের বুকটা বড় নাকি ছোট! আর বড় হলে কতটা বড়? আমি সদুত্তর দিতে পারিনি কারণ আমি ওই অনুষ্ঠানে তোমাদের দেখতেই পাইনি। আমি সাতাশ বছর তোমাকে দেখিনি। তুমিই যে ফেসবুকে রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছিলে চিনতেও পারিনি। তুমিই যে অচেনা নম্বর থেকে ফোন করে চুপচাপ থাকতে, কোনও কথা বলতে না সেটা আমি কখনও টেরও পেতাম না পরে তুমি না বললে।
তবে ওই সাতাশ বছর পর টালিগঞ্জের ক্যাফেতে তোমার সঙ্গে দেখা আমি করতাম না যদি না আমার বন্ধু অবিনাশের বাবা মারা যেত। প্রবল শ্বাসকষ্ট নিয়ে ভোর রাত্রে কাকু চলে গেল আর অবিনাশ সুইডেন থেকে ফিরতে পারল না অতিমারির ঘেরাটোপে। আমি, কাকিমা আর গুটি কয়েক মানুষ শ্মশানে ছিলাম। কাকিমা মুখাগ্নির সময় কেঁদে ফেলল আর আমি গিয়ে ধরলাম। দুটো পাক আমিই কাকিমাকে নিয়ে পার হলাম। এই মুহূর্তে কেউ আছে আর পরক্ষণেই আর নেই, এই অনুভূতিটা বড্ড জ্বালাতনের। তুমিও যদি এমন নেই হয়ে যাও কোনওদিন আর দেখতে না পাই, তাই ওই ক্যাফেতে গিয়েছিলাম। দেখলাম তুমি বুড়ো হয়ে গেছ। শুনলাম তোমার ও-ঘরে কোনও ছেলেমেয়ে নেই, শ্বশুরবাড়ির যে অংশ তোমরা পেয়েছ তার একটা দিক ভাড়া দিয়ে তোমাদের গ্রাসাচ্ছাদন চলে অথচ আমাকে দেখো ছোটবেলায় অন্যের বাড়িতে থেকে, পুজোয় একটা জামা পেয়ে, বন্ধু আর তার বাবাদের সারাজীবন হিংসা করে কেমন বড় হয়ে গেলাম! জীবনে আর্থিক অভাব নেই। ছোট একটা ফ্ল্যাট আছে, গাড়ি নিয়েছি আর মায়ের যত্ন নিই। দিদিদেরও দেখাশোনা করি। আমার বাবার আজ আর কাউকে দেখে নিতে হবে না, আমি নিজেই নিজের জন্য, বাড়ির আর সকলের জন্য যথেষ্ট।
তুমি ভালো থেকো, বাবা। আমি তোমায় আজও সত্যিই খুব ভালবাসি। কিন্তু তুমি আর কখনও আমায় ফোন কোরো না, কেমন?
ইতি-
তোমার বাবু।