বাবা, কেন তুমি বটগাছ, বুঝতে বুঝতেই কত বছর কেটে গেল...

Father's Day 2023: বিরাট এক অভিমান বাবার উপর আজও থেকে গেছে। কিন্ত সেই অভিমান ভাঙার পথ নেই।

প্রিয় বাবা,

তোমার চলে যাওয়ার এক বছর হবে। আমাদের সমাজে বাবাদেরকে বট গাছের সঙ্গে তুলনা করে। ভাবতে অবাক লাগে, এই তুলনা বুঝতে বুঝতে জীবনের পঁয়ত্রিশটা বছর কেটে গেল। আসলে সমাজের নানারকম চিন্তা, আদর্শ, নীতি সব সময় একই নিয়মে চলে না। চলে অনেকটা জীবনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে। তাই সবার কাছে সব গ্রহণযোগ্যতাও এক নয়।

আমাদের জন্ম ভিটেতে আমরা দেখেছি জমিদারির আচার আচরণ। সমাজের এই নিয়ম কোথায় কখন মুখ থুবড়ে পড়েছে কে জানে! বিরাট জমির আলপথ ধরে যখন আমরা নিজদের গ্রামে পূর্ণিমার রাতে ফিরে আসতাম, সেই সময় দেখতাম জীবনানন্দের মেঠো ইঁদুর। ধানের মধ্যে তৎপর হয়ে পালাচ্ছে মুখে ধান নিয়ে। আমাদের গ্রামে শটিবন ছিল না। ছিল আম বাগান, জাম বাগান,পুকুরের পাড়, সারি সারি তাল গাছ। রাতের নিশাচর থাকত শিকারির অপেক্ষায়।পূর্ণিমার আলোয় মাঠের ধান চক চক করত। আমরা তখন খুব ছোট। আমি, দিদি, মা আমাদের কির্ষাণদের পাহারায় ফিরতাম অপরূপ জ্যোৎস্না মাখা শীতের রাতে কখনও বা গরমের সন্ধ্যায়।

এই গ্রামের স্মৃতি, জীবন। ভোগ্য সবই পেয়েছিলাম গ্রামে থাকাকালীন। সভ্যতার নিয়মেই যেমন সময় এগোয়, ঠিক তেমনই সব কিছুই পরিবর্তনও হয় কালের নিয়মে। আমাদের গ্রামের বাড়ি ছিল বিরাট একটা জায়গা নিয়ে। গ্রামের অনেকেই আমাদের গ্রামের বাড়ির পাঁচিল নিয়ে হাসি-ঠাট্টা, তামাশা করত।কিন্তু এসবই আড়ালে। কেননা জমিদারদের বাড়ি নিয়ে তাদের অপমান করাটা নেহাত খুব সুবিধের কাজ হবে না। এই বাড়ির মাধ্যমেই তারা বেঁচে বর্তে থাকে। মাসের পেট চলে। প্রায় জনা দশ আমাদের বাড়িতে কাজকর্ম করতেন। বাড়ির স্বাভাবিক কাজ ছাড়াও, অনেকে গোয়াল ঘর পরিষ্কার করার জন্য, কেউ গরু মোষ, হাঁসের দেখভালের জন্য, কেউ বাড়ির কুল দেবতার সেবার জন্য, আবার কেউ কেউ থাকতেন আমাদের কাকাদের নানান ফায়ফরমাশ খাটার জন্য। ছোট থেকেই দেখেছি কাকাদের নির্মম নির্যাতনের কাণ্ড কারখানা। আমার সেজকাকা দশাসই চেহারা নিয়ে কলতলায় বসে পড়ত চান করবে বলে। কুড়ি থেকে তিরিশ লিটারের একটা বালতি কলতলায় বসিয়ে উত্তম বলে আমদের এক কির্ষাণ কল টিপেই যেত। আর কাকা জল ঢেলেই যেতেন এবং এই জল তোলা ততক্ষণ চলত যতক্ষণ না পর্যন্ত কাকা জল ঢালা থামায়। শীতকালটা বাদ দিয়ে এই অমানবিক, অবিবেচক কাজ সারা বছর ধরে হতো।
প্রায় দেড় হাজার স্কোয়ার ফুটের একটা বাড়ির মধ্যে উঠোন। এই উঠোন প্রতিদিন ঝাঁট দেওয়া, জল ঢালা ছিল নিত্য কাজ। উঠোন জুড়ে ছিল ধানের গোলা।পশ্চিম দিকে বিরাট রান্না ঘর। একটা ঘর শুধুমাত্র ঠাকুরের রান্নার কাজে ব্যবহার হতো। আর দক্ষিণে ছিল আমাদের ঠাকুর ঘর। ঘরের সামনের উঠোনে ছিল তুলসীর গাছ।

ঠাকুরের দেখাশোনার কাজে বহাল ছিল আমাদের গ্রাম থেকে আট কিলোমিটার দূরের বিষ্টপুর গ্রামের এক ব্রাহ্মণ। নাম উত্তম। আমরা উত্তম কাকা বলতাম। খুব সকাল সকাল নিজের গ্রাম থেকে চলে আসতেন আমদের গ্রামে। এসে ঠাকুরঘরে পোশাক বদলে ধুতি গেঞ্জি পরে নিতেন। তারপর সোজা আমাদের বাড়ির পেছনের দরজা মানে পশ্চিমের দরজা দিয়ে দিঘিতে যেতেন পিতলের কলসি নিয়ে জল আনতে। ওই জলেই পুজো আর নিত্য অন্নের ভোগ হতো।গ্রামের জমিদার বাড়ি! পাকা বাড়ি বলতে ছোটবেলায় বইয়ের পাতায় যেটা জেনেছি অর্থাৎ কংক্রিটের বাড়ি, ঢালাই ছাদ। শুধুমাত্র আমাদের আর দু'জনের বাড়ি ছিল তেমন। এক হচ্ছে, আমাদের ওই গ্রামের বড় পিসির বাড়ি। দুই হলো, আমাদের এক দুঃসম্পর্কের আত্মীয়র বাড়ি। তাই বাড়ির নিয়ম কানুন ছিল খুব কঠিন। ছিল জাতপাতের ব্যাপার। অথচ কোনওদিন বাবাকে এই আয়নায় দেখিনি। গাছের বেল পেড়ে খাওয়া থেকে শুরু করে গ্রামের যেকোনও দরকারে সবাই জানত কাকাবাবু আছেন। একটা গল্পের চরিত্রের কথা মাথায় এল, রবিন হুড। না, তেমন কিছু না থাকলেও উদাসীনতা ছিল মস্ত বড় এক হাতিয়ার। গরমে আমের সময় সেজকাকা কোমরে লুঙ্গি পরে উত্তাল ঝড়ে বাগানে লাঠি হাতে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকত যাতে ঝড়ে পড়া আম কেউ নিতে না পারে।অথচ ওই ঝড়ে বাবা নাপিত পাড়া, ঘোষ পড়ার ছোট ছোট ছেলমেয়েদের বলত, "যা যা বাগানে আম কুড়িয়ে নে।" অথবা তেঁতুলের সময় তেঁতুল। গোলায় ধান তোলার সময় এমন অনেকেই বাড়ির একটু মাস কাবারি চালের জন্য ধান আবদার করলে কোনওদিন না শুনিনি। কিন্ত নিজের জীবনে বিরাট একটা 'না'। শুনতে শুনতে অনেকটা বড় হয়েছি, বিরাট এক অভিমান বাবার উপর আজও থেকে গেছে। কিন্ত সেই অভিমান ভাঙার পথ নেই। যাক সে কথা।

উত্তম দা দিঘির জল এনে ঠাকুরের রান্নাঘরে ভোগ তৈরি করতেন। সারা বছর আমাদের অন্নের ভোগ হতো। থাকত গাওয়া ঘি, আলু ভাতে আর আতপ চালের ভাত। ভাত তৈরি হতে হতে প্রায় বারোটা বেজে যেত। এরপর রান্নাঘর থেকে ভোগ যখন ঠাকুরঘরে যেত, তখন আমি, দিদি, আরও এক খুড়তুতো বোন সবাই বাড়ির দুই দিকের দরজা বন্ধ করে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলতাম, "ভোগ যাচ্ছে, কেউ তাকিও না। ভোগ যাচ্ছে কেউ ঢুকো না।" অর্থাৎ বাড়ির কৃষ্ণরাধার ভোগ ব্রাহ্মণ ছাড়া কোনও শূদ্র দেখতে পারবে না। তাতে সংসারের অকল্যাণ হবে। তাই মঙ্গলের ধ্বজা ধরতে আমরা পিছু পা হতাম না। সেই সময় এমনও হতো, বাড়িতে কোনও কির্ষাণ বাড়ির কাজে বাড়ির ভেতরেই আছে, তখন তারা মুখে গামছা চাপা দিয়ে সরে যেত। আমাদের বাড়ির সদর দিক ফেলে একটা রাস্তা সোজা চলে গেছে মুসলমান পাড়ায়। আর এই মুসলমান পাড়ার মুখের বাম হাত নিলে নাপিত পাড়া হয়ে হালদার পাড়া। আমাদের বাড়ির পূর্বের সদর দরজা দিয়ে পশ্চিম দিকে চলে যাওয়ার জন্য অনেকেই বাড়ির বিরাট উঠোনটা ব্যবহার করত। ফলত আড়াইশো তিনশো মিটার রাস্তা অনায়াসেই বেঁচে যেত। সেই জন্য বাড়ির মধ্যে দিয়ে লোকজন চলাচলের রেওয়াজ ছিলই। তাই ঠাকুরের ভোগ রান্নাঘর থেকে যাওয়ার সময় আমরা চ্যাঁচামেচি করে সবাইকে একরকম স্তব্ধ করে দিতাম। বাবা মাঠ থেকে অনেকটা বেলায় ফিরত। গ্রামের ছেলেপুলে "কাকাবাবু আম খাব, কাকাবাবু তেঁতুল খাব, কাকাবাবু আইসক্রিম খাব" বলে বায়না ধরত। বাবা কোনওদিনই না বলত না। অথচ ওদের এই আবদার কোনওদিন আমার কাকা জ্যাঠাদের করতে দেখিনি। বাবা হয়তো চেয়েছিল প্রথার বিপরীতে হাঁটতে।

আমাদের গ্রামের এক বুড়ি ছিলেন, ঊষা। তাঁর একটা চোখ ছিল কানা। মানে সেই চোখে দেখতে পেতেন না। গ্রামের সবাই একটু অন্য নজরে দেখত। কেউ কেউ বলত ডাইনি বুড়ি! একদিন ওঁর নাতির জ্বর হলো। এই জ্বর বেশ অন্যরকম। দিন পাঁচেক কেটে যাওয়ার পরও সেই জ্বর নামছে না। একটা ছোট্ট মাটির ঘরে পড়ে থাকতে। তাও একদিকের মাটি জল, কাদায়, বর্ষায় গেছে গলে। সামান্য উঠোনে বিছিয়ে থাকত রোদে পুড়ে যাওয়া তালপাতা। বর্ষার সময় করুণ অবস্থা দেখে মন খারাপ করে উঠবে যে কারও। ত্রিপল বেয়ে জল ঘরে ঢুকত। মাটিতেই থাকত বুড়ির বিছানা। গুটিয়ে নিয়ে ঘরের এক কোণেই পড়ে থাকত।গ্রামের বেশ কিছু বাড়িতে মুড়ি ভেজে সামান্য কিছু আয়। মাঝে মাঝে বাসন মাজার কাজও করতেন। নাতির জ্বর কীভাবে সারবে সেই উতলা হয়ে গিয়েছিলেন সেই বুড়ি। অথচ একটি বারের জন্যও ডাক্তার বদ্যি দেখাবেন না। বিশ্বাস সেই জল পোড়া, তেল পোড়াতেই। তাই স্কুল ডাঙার মাঠ পেরিয়ে একদিন বুড়ি গেলেন মনসা মন্দিরে। সন্ধায় এক পুরুত বসতেন, তাঁর কাছেই জল পোড়া আনতে গেলেন ঊষা। অথচ সেবার এক আশ্চর্য ঘটনা ঘটেছিল।পুরুত বুড়িকে বলেন, সন্ধায় পশ্চিম থেকে আসা কোনও ব্রাহ্মণের হাতের জল খাওয়াও ভালো হয়ে যাবে। এমন বচনে বুড়ি কুপোকাত। একটু সাহস নিয়েই জানালেন, এই তল্লাটে বাবুদের বাড়ি ছাড়া আর ব্রাহ্মণ কোথায় পাই? কিন্তু নাতির মুখপানে চেয়ে এইকাজ করতে হবে। মন্দির থেকে বেরিয়ে সেদিনই স্কুল ডাঙার মাঠের কাছে এসে খুঁজতে লাগলেন বুড়ি। বাবা ওইদিন আসছিলেন সেই পথেই কোনও কাজ সেরে। ছুটে গিয়ে বাবাকে বলেছিলেন, "কাকাবাবু আপনি একটু আপনার হাতের জল ধরে আমাকে দিন। নাহলে নাতি আমার বাঁচবে না।" বাবা শুনে বলেছিল, "এসব পাগলের কথা তোকে কে বলল। যা নাতিকে অশোক ডাক্তারের কাছে দেখিয়ে আয়, পয়সা বললে বলবি কাকাবাবু দেবে।" বুড়ি তো এসবে নাছোড়বান্দা। কিছুতেই ছাড়বে না বাবাকে। বাবাও অগত্যা মোড়ের মাথায় পদ্মদের দোকানে গিয়ে উঠলেন। বলল, "ওরে পদ্মা একটু জল দে তো। এক জগ জল নিয়ে ঊষাকে দিলেন। সাতপাঁচ না ভেবে, জগ নিয়ে সোজা নিজের ভাঙা ঘরে গিয়ে নাতিকে জল খাইয়ে দিলেন ঊষা। পরের দিন থেকে নাতি অনেকটা নাকি সুস্থ হতে থাকল।

তোমার এমন অনেক ঘটনাই জেনেছি বাবা। আজ অনেক কথাই মনে পড়ে। স্বাভাবিকের থেকে অস্বাভাবিক ঘটনাগুলো ঘুরপাক খায়। আসলে কিছু কিছু প্রবৃত্তি আছে যা সমাজসিদ্ধ আর কিছু পার্থিব। বাবাকে কোনওদিন বলিনি, বাবা তুমি মানুষ না ঈশ্বর? আসলে মানুষই। চোখে হয়তো পড়েছিল ঐশ্বরিক চেতনা। অথচ তুমি নশ্বর ছেড়ে চলে গেলে। চুল্লিতে পুড়ে ছাই হয়ে গেলে। অথচ চিন্তার স্বর কোথাও যেন আমার স্নায়ু আবৃত করে রাখল বরাবরের মতো।

More Articles