তোমাকে বলা হল না বাবা, 'চিন্তা করো না, আমি সামলে নেব'!

Father's Day 2023: এটুকুই বলতে চেয়েছিলাম, বাবা, আমি বড় হয়েছি। এবার সবকিছু গুছিয়ে নেব।

বাবা, তুমি জানতে না, বলো?

সেই যে নার্সিংহোমে গেলে.. আর ফিরবে না, জানতে না? তাই অ্যাম্বুলেন্সে ওঠার আগে ব্যাগে এক প্যাকেট সিগারেট ঢুকিয়ে নিয়েছিলে চুপিচুপি? ফেলে রাখা মিটিং-মিছিলের পরবর্তী ধাপ, এফডি-র ঠিকঠাক ইন্টারেস্ট আসছে কিনা, মায়ের ডাক্তার দেখানোর তারিখ - সব চিন্তাই ঢুকিয়ে নিয়েছিলে ব্যাগে? বোধহয় ভেবেছিলে ফেরার আগে সব ঝালিয়ে নেবে। তোমাকে তো চিনি, কাজ ফেলে রাখলে ঘুম আসে না। আমারই তো বাবা।

আমি কিন্তু জেনে ফেলেছিলাম।

নার্সিংহোমের কালান্তক ফোনটা আসার আগে, শেষ যেদিন দেখতে গেলাম, সেদিন জেনে গেছি। সেদিন তোমার কাছে যেতে দেয়নি। তোমার পরনে শুধু ডায়াপার, আইসিইউ-তে অচেতন হয়ে শিশুর মতো কত কী বলছিলে আপনমনে। বুক ভেঙে যাচ্ছিল আমার। মনে হয়েছিল একবার কেউ দরজাটা খুলে দিক। আমি শুনি, তুমি কী বলছ। আমাকেই বলছ না তো, কী কী কাজ বাকি? সেই শুনতে না পাওয়া আজও রাতবিরেতে হঠাৎ আমার গলা মুচড়ে ধরে। আমার যে তোমাকে বলা হল না, বাবা, আমি সামলে নেব!


আজ দেখো, সামলে নিয়েছি কতকিছু। ব্যক্তিগত ঝড়, মায়ের দরকার-অদকারের হ্যাপা, খরচাপাতি। বিপন্ন লাগলেই তোমাকে ফোন করে কাঁদতাম - 'এবার কী হবে?' তখন বলতে, 'আমি তো আছি রে বাবা!' এখন আমার কাউকে ফোন করার নেই। তাই, সামলে নিয়েছি। তোমার সঙ্গে কথা কাটাকাটি তো লেগেই থাকত, এক বাড়িতে দু'জন গোঁয়ার মানুষ থাকলে যা হয়। এখন দেখো, কারও সঙ্গে ঝগড়াও করার নেই। তবু, সামলে নিয়েছি। এটা তো স্বীকার করবে যে তুমি মানুষটা একটু বোকাই ছিলে! মাথায় হাত বুলিয়ে কতজন কত কাজ করিয়ে নিয়েছে। যারা ব্যবহার করছে, তাদের নিয়ে কম অশান্তি তো হয়নি। আজ কেউ আমাকে ব্যবহার করতে পারে না। কারণ, সামলে নিয়েছি। তোমাকে অনেক মানুষ ভালোবেসেছেন, বন্ধু বলেছেন। তাঁরাও আমাদের সামলে দিয়েছেন অসময়ে। তোমাকে বলা হয়নি, বাবা, 'এত চিন্তা করতে হবে না'। বলা হয়নি, 'তুমি শুধু ফিরে এসো। বাকি সব ঠিক হয়ে যাবে। সব ঠিক হয়ে যায়।'

তা বলে কি কিছুই বলিনি?

তুমি তো আর 'দুঃখিত' বলার পাত্র নও! তুমুল অশান্তির পর নিতান্ত তুচ্ছ কারণে যখন ফের স্বাভাবিক গলায় ফোন করেছ, 'সরি' বলেছি, অন্যমনস্কভাবে। আমাদের সম্পর্ক ঠিক গদগদ স্নেহ-প্রতিবাৎসল্যের ছিল না। তবু, আমি ভাল কিছু করলে আমি বাদ দিয়ে আর সবাইকে যেমন তুমি ডেকে ডেকে বলতে - আমিও আমার বৃত্তে সগর্বে বলেছি তোমার যাবতীয় যুদ্ধের কথা। 'আমার বাবা লড়ছে, কিছুতেই ছেড়ে দেবে না।' প্রত্যেকবার যাবতীয় পুরুষতান্ত্রিক উদাহরণের মুখে চামড়া-জ্বালানো থাপ্পড় হয়ে দাঁড়িয়েছি তোমার কথা বলে - যে তুমি কোনওদিন চাকরি না করে শুধু মানুষের জন্য কাজ করেছ। যে তুমি বুঝতেই দাওনি, এ সমাজে স্ত্রীর উপার্জনে সংসারপালন নাকি বাঁকা চোখে দেখে। যে তুমি ছোট্ট থেকে একবারের জন্যও ভাবতে দাওনি - চাকরি করে বাবা-মাকে দেখার বিকল্প হতে পারে 'বিয়ে'। যে তোমার জন্য, আজ পর্যন্ত, হৃদয় নিংড়ে ভালবাসা সত্ত্বেও কারও কাছে দাসখত লিখে দিইনি। সেসব কথা বলেছি। পরোক্ষে বলেছি, যাপনে বলেছি, সময়বিশেষে তোমাকেও বলেছি বইকি।

তারপরেও বোঝা যায় না, কখন বলার সময় ফুরিয়ে যাবে। অনুষ্ঠানের অদৃশ্য সঞ্চালক যখন ইচ্ছে চিরকুট পাঠিয়ে বলে দেবেন, সময় শেষ, নেমে পড়ো বাপু। তখন আর কিছু করার থাকে না। সারাক্ষণ উদাত্ত গলায় হাসা, ভুল সুরে গান গাওয়া আর কথা বলে চলা মানুষটা তখন আর সাড়া দেয় না। ঠান্ডা হয়ে কাচের বাক্সে শুয়ে শেষবারের মতো বাড়ি যায়, গাড়িচালককে চা খেতে অনুরোধ পর্যন্ত করে না - আর তারপর 'নেই' হয়ে যায়। পড়ে থাকে নোটখাতায় লেখা অসমাপ্ত কর্মসূচি, আর একটি মেয়ের মাথাভর্তি কথা।

এটুকুই বলতে চেয়েছিলাম, বাবা, আমি বড় হয়েছি। এবার সবকিছু গুছিয়ে নেব। জীবনে যা কিছুই আসুক, আমাকে ভাঙতে পারবে না। এইটুকু আশ্বাস সব বাবাদের প্রয়োজন, তাঁদের মেয়েদের থেকে। সময় থাকতে থাকতে বলা হল না।

যতই দর্শন আওড়াই, যতই বিড়বিড় করি 'ফুরায় যা তা ফুরায় শুধু চোখে' - আমি আর জানি না তোমাকে কোন ঠিকানায় চিঠি লিখলে পাবে। শুধু বিশ্বাস করি, তুমি সবার মধ্যে আছ। পৃথিবীর সমস্ত বাবাদের মধ্যে একজন হয়তো তোমার মতোই জেদি, কেউ তোমার মতো বোকা, কেউ তোমার মতো মাটি কামড়ে লড়াই করা মানুষ, কেউ রাত্তির দুটোয় কাজকর্ম শেষ করে দক্ষিণী সিনেমা দেখতে বসেন। এই চিঠিটা তাঁদের জন্যেও লেখা। যাঁদের সন্তানরা এখনও বলে উঠতে পারেনি কিছু, তাঁদের বলা - চিন্তা করবেন না। যে শিক্ষা দিয়েছেন, যে ভরসা - একদিন ঠিক ওরা সব সামলে নেবে। বিপদ এলে মাথার ভেতর আগলে রাখা বাবাকে জিগ্যেস করবে, 'তুমি হলে কী করতে?' দেখবেন, সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাচ্ছে।

আমি উত্তর পাই। শুধু বাবা আর একগাল হেসে একে-ওকে গল্প করে না, 'দেখেছ, বলেছিলাম না পেরে যাবে?'

হ্যাপি ফাদার্স ডে, বাবা।

More Articles