প্রিয় বাবা, “তুমি এই লোকটাকে কেন বিয়ে করলে?” বারবার জিজ্ঞেস করেছিলাম মাকে...

Father's Day 2023: আমার চোখে সুদর্শন ঠেকে এমন কোনও পুরুষ চোখে পড়লে মাকে দেখিয়ে বলতাম, “মা, তুমি এই লোকটাকেও তো বিয়ে করতে পারতে!”

বাবা, তোমায় যা বলার ছিল...

তোমার ছবিটা দেখে সবার প্রথমে মনে হলো, বাবাকে বেশ ভালোলাগছে। আমাকে, মাকে, দিদুভাইকে ভালো লাগছে না। ছবিটা তোলার ঠিক আগেই মায়ের সঙ্গে কথা কাটাকাটি ও কান্নাকাটি করায় আমার চোখ ছলছলে। মায়েরও মুখ গম্ভীর। দিদুভাইদের সময়কার লোকজনেরা সম্ভবত জানতই না ছবি তোলার সময় হাসতে হয়।

ছোটোবেলা থেকেই কী করে যেন বাবা আমার কাছে ‘লোকটা’ হয়ে গেছিল। এসব কথা মনে করতে করতে হাসি পাচ্ছে ভারি। একেবারে ছোট্টটি যখন ছিলাম, তখন থেকেই আমার মনে হতো আমার মা অসামান্য সুন্দরী একজন মানুষ। আমি মাঝেমাঝেই মাকে দেখে দেখে অবাক হয়ে যেতাম। মাকে বলতাম, মা, তুমি এত সুন্দর কেন? ঠিক কোত্থেকে জানি না, সম্ভবত হিন্দি সিনেমা দেখে বেড়েপাকা হয়ে যাওয়ার ফলেই, ‘আই লাবিউ’ কথাটা শিখেছিলাম। মাকে জড়িয়ে ধরে গালে হামি খেয়ে বলতাম, “মা, আই লাবিউ”। মা খুশি হতো নাকি বিব্রত, তা ঠিক আমার মনে নেই। ওই ছোটোবেলা থেকেই কীভাবে জানি না আমার মনে হয়েছিল, আমার বাবাকে ‘দেখতে’ মায়ের তুলনায় একেবারেই ভালো না। মাকে বহুবার বলেছি, “মা, তুমি এই লোকটাকে কেন বিয়ে করলে? আর কোনও লোক পেলে না?”

আমার বাবা মাঝেমাঝেই বাবা থেকে ‘লোকটা’ হয়ে যেত, তার কয়েকটা কারণ মনে করতে পারি, ছোটোবেলার ভাবনাচিন্তা হাতড়ে। বাবা লোকটা কেমন যেন সব দিক থেকে আমার অপছন্দের ছিল। লোকটার আশ্চর্য বিনয়। লোকটাকে কোনওদিন প্রশংসা গ্রহণ করতে দেখতাম না। কেউ প্রশংসা করার জন্য যখন জিজ্ঞেস করতেন, “স্বপন, এই কাজটা কি তুমি করেছ? খুব ভালো হয়েছে!” লোকটা দেখতাম, “হ্যাঁ, থ্যাঙ্ক ইউ” – এইসব বলার ধার ধারে না। আমি জানতাম কেউ প্রশংসা করলে ‘থ্যাঙ্ক ইউ’ বলতে হয়। কিন্তু লোকটা হাত জোড় করে ফেলত, বলত “আপনাদের দয়া”, বা “আপনাদের আশীর্বাদে…” ইত্যাদি। লোকটা দেখতাম খালি নুয়ে পড়ে, কিছুতেই হ্যাঁ বলে না, কিছুতেই প্রশংসা গ্রহণ করে না। এই লতানে ব্যাপারটা আমার একেবারেই ভালোলাগত না। লোকটা আমাকেও বিনয় শেখাবার চেষ্টা করত দেখে আমি খুবই বিরক্ত হতাম। যে কোনও বয়সে বড় মানুষ দেখামাত্রই লোকটা বলে উঠত, “শর্মি, প্রণাম করো”। অনুষ্ঠানবাড়িতে অনেক জুতো পরা পা-কে লোকটার আদেশে অনিচ্ছাতেও প্রণাম করতে হতো। মা মাঝেমাঝে মুখ চুন করে বলত আহা মেয়েটাকে দিয়ে অতগুলো লোকের জুতোয় হাত দেওয়া করালে! লোকটা বলত, “সম্মান দিলে হাতে ধুলো লাগে না”। এইসব বইয়ের আদর্শবাক্যের মতো বাণী আমার একেবারেই ভালোলাগত না।

আমার সাজগোজের একটা বাতিক ছিল। ভয়াবহ বাতিক। আমি আর পার্টনার-ইন-স্টাইল ছোটকাকু, যৌথ প্রচেষ্টায় ট্রেন্ড ফলো করা কাকে বলে তার একটা মোটামুটি উদাহরণ স্থাপন করে ফেলেছিলাম। টিভিতে হাল ফ্যাশনের কিছু একটা দেখলেই সেটা এনে দেওয়ার দায়িত্ব থাকত ছোটকাকুর। আমি, এমন বিটকেলে সাজতাম, লোকজন প্রশংসা বা ঠাট্টার মধ্যে কোনও একটা করার দায় কিছুতেই এড়িয়ে যেতে পারত না। আমাদের আবার যেহেতু যৌথ পরিবার, কোনও অনুষ্ঠানে গেলে, আমার কাজ হতো সেজে সবার ঘরে ঘুরে নিয়ে কেমন সেজেছি তার ভ্যালিডেশন নেওয়া। কেউ যদি বলল, “ন্যাহ, ভাল্লাগছেনা”, ব্যাস! আবার সব সাজ পাল্টাতে হবে। বাড়ির সবাই আমার এই জেদের কথা জানত বলেই পারতপক্ষে সাজ ভালো হয়নি– এই কথা বলত না। কারণ সবাই জানত সাজ পাল্টাতে শুরু করলে আবারও একঘণ্টার ধাক্কা। তাই খুব বিটকেল লাগলেও সবাই বলত, খুব ভালোলাগছে। চোখের পাশে চকমকি টিপ আটকে দিয়ে কী একটা বিদঘুটে সাজ সাজতাম, টিভিতে দেখে! ভাবলেও হাসি পাচ্ছে! বেড়েপাকা বাচ্চা ছিলাম বটে!

লোকটা সাজের ব্যাপারেও খুবই সমস্যা বাধাত। কোথাও যাওয়ার থাকলে মা আর আমি মোটামুটি ঘণ্টাখানেক ধরে সাজতামই। এটাই আমার স্বাভাবিক মনে হতো। যেদিন কোথাও যাওয়ার কথা থাকত, মা ম্যাচিং রঙের জামাকাপড় সবার জন্য বের করে রাখত। আমাদের সাজ শেষ হওয়ার মিনিট পনেরো আগে লোকটা ঘরে এসে ঢুকত। প্রথমেই আমাকে দেখে চোখের পাশের টিপগুলো খুলতে বলত। আমি জন্মের পর থেকেই সম্ভবত ঠিক ছিল আমার সবকিছুই লাউড হবে। সাজও। (হেহে!) ব্যাস! আমার তখনই বিরক্ত লাগত। এসেই আমার সাজে অল্টারেশন শুরু করে দিল লোকটা! সাজ খুলব না জেদ করে কান্নাকাটি করেও দেখেছিলাম, ম্যানিপুলেট করা যাবে এই আশায়। কিন্তু সেসবে জল ঢেলে লোকটা বলত, সাজ না পাল্টালে অনুষ্ঠানে নিয়ে যাওয়া হবে না। মুখ হাঁড়ি করে আমি লোকটার নির্দেশ পালন করতাম। লোকটার কোনও সাজের বালাই ছিল না। মুখটুখ ধুয়ে একটা মলিন হয়ে যাওয়া কাচা পরিষ্কার টানটান জামা প্যান্ট পরে রেডি হতো লোকটা। মা তখন গজগজ করতে করতে বলত, “মেয়েটাকেও সাজতে দেবে না, নিজেও কোনও ভালো জামাকাপড় পরবে না, আলমারিতে পড়ে পড়ে ভালো শার্টগুলো নষ্ট হবে।” লোকটাকে প্রত্যুত্তরে শুধু বলতে শুনতাম, “আমাকে কে আর দেখবে! আমি সাধাসিধে থাকতেই ভালোবাসি।" ছোটকাকু দেখতাম কী সুন্দর পাটভাঙা শার্ট পরেছে, চকচকে জুতো পরেছে, সুন্দর পারফিউম লাগিয়েছে, আমার সাজের আইডিয়ায় যাকে বলে ‘পারফেক্ট’। কিন্তু লোকটাকে কেমন জানি মলিন লাগত। এইসব নিয়ে আমার মনের মধ্যে খচখচ করত। এইসব কারণেই বোধহয় আমার মনে হতো, লোকটাকে দেখতে ভালো না, মানে আমার ‘বাবা’ হিসেবে ঠিক মানায় না। আমার চোখে সুদর্শন ঠেকে এমন কোনও পুরুষ চোখে পড়লে মাকে দেখিয়ে বলতাম, “মা, তুমি এই লোকটাকেও তো বিয়ে করতে পারতে!” মা বলত, “ধুর পাগল!” আমি বলতাম, “ক্যানো মা?” মা বলত, “তোর দাদুরা যে তোর বাবার সঙ্গেই আমার বিয়ে দিল।" আমি মুখ ব্যাজার করে বলতাম, “ধুর! কেঠো!” কে জানে ‘কেঠো’ বিশেষণটা কেন মনের মধ্যে গেঁথে গেছিল লোকটার সম্পর্কে। লোকটাকে তখনও অবধি আমি খালি কঠিন হতেই দেখেছিলাম বলেই হয়তো। লোকটা সবসময় আমাকে সবকিছুতে বেঁধে দিত। এটা করবে না। ওটা করা যাবে না। ভালো হয়েছে, কিন্তু আরও ভালো করতে হবে। সবাইকে প্রণাম করতে হবে। কেউ ভালো বললে ‘থ্যাঙ্ক ইউ’ না বলে প্রণাম করতে হবে। “সে অধম হলে আমি উত্তম হব না কেন” ইত্যাদি হাজারটা ভ্যানতাড়া কানের কাছে পাকিয়ে পাকিয়ে লোকটা আমার কাছে ‘কেঠো’ হয়ে গেছিল।

এই লোকটাই, যাকে কিনা একসময় আমার মতে দেখতে ভালো ছিল না, এই ছবিটা দেখে তাঁর দেখতে ভালো লাগার কথাটাই সবার আগে মনে এল। কারণ? প্রথম কারণ সম্ভবত এই যে, এই বিশেষ ছবিটায় ‘বাবা’ লোকটা হাসছে। বাবার সেই বিনয়ী হাসি, যা আমার স্মৃতিতে গভীরভাবে প্রোথিত হয়ে আছে। ছবিটাতে লোকটাকে দেখে মনে হচ্ছে এই লোকটা, ‘লোকটা’ থেকে কীভাবে জানি এখন বাবা হয়ে গেছে, যাকে আগে আমি বিরক্ত হয়ে ‘লোকটা’ বলতাম, এখন আমি ভালোবেসে ‘লোকটা’ বলি! একই শব্দের ব্যবহারের পিছনের অনুভূতি পাল্টে যাওয়ার জন্য দায়ী এতগুলো বছর। এই বছরগুলোতে আমার বোধের স্রোতপ্রবাহ অনেকখানি পাল্টেছে। আগে বাবার যেসব আদর্শ, আচরণে আমি বিব্রত বোধ করতাম, আজ সেই সব কিছু আমার কাছের গর্বের বিষয়। পরে মনে হয়েছে, এই যে সাদামাটা ভাব, প্রসাধনহীনতা, বাবার ব্যক্তিত্বকে এক অসামান্য দৃপ্ততা দেয়। বাবা কোনওদিন মেকি কোনওকিছুকেই আসলের থেকে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার বিরোধী ছিল, আজও আছে। আজ বুঝতে পারি বাবা কতটা ঠিক। চারদিকের সবকিছুতে যখন আসল আর নকলকে আলাদা করার জন্য পোড় খেতে হয়, অভিজ্ঞ হতে হয়, নাহলে আলাদা করা যায় না, সেখানেই বাবার ‘উজ্জ্বল উপস্থিতি’ আমাকে সারল্যকে অলংকার হিসেবে চেনায়। বাবার বিনয়ের ছিটেফোঁটাও আমি অর্জন করতে পারিনি এবং করতে পারাও খুব কঠিন মনে হয় আমার পক্ষে। বাবা যে কী করে পারে এটা আমার কাছে কখনও না উন্মোচিত হওয়া এক রহস্য। বাবা আজও ছবি তুলে এডিট করে না, কারণ তাতে তার আসল নির্যাস নষ্ট হয়ে যায়। বাবাকে অনেক চেষ্টা করেও বোঝানো যায়নি, এডিটিং কোনও কোনও ছবিকে এনহ্যান্সও করে। বাবা মনে করে, এনহ্যান্সমেন্ট প্রসিডিওরের ভিতরে হয়, প্রডাক্টে এনহ্যান্সমেন্ট করার মানে খামতি লুকোনো, ফিলার দেওয়া, মেকি।

বাবার এই ছবিটা দেখে মনে পড়ে যায় লাজুক কোনও ছেলের কথা, যার মতো কোনও ছেলের সঙ্গে আমার কোনওদিন প্রেম হয়নি কিন্তু আমি প্রেম করতে চাই। আশ্চর্য কোনও এক জিনগত পরম্পরা মেনেই হয়তো, মহিলারা অনেকসময় সচেতন বা অসচেতনভাবে বাবার মতো জীবনসঙ্গী পেতে চান। অস্বীকার করতে পারি না আমার ক্ষেত্রেও এই পরম্পরার খুব একটা অন্যথা হয়নি। আমার বাবা আমার কাছে আদর্শ প্রেমিক ও পুরুষ। বাবার বিনয়ই সম্ভবত বাবাকে কোনওদিন লাউড হতে দেয়নি। বাবার কাছে মাকে প্রেম জানানো মানে ছিল ভাঙা ও বেসুরো গলায় “আমি যামিনী তুমি শশী হে” গাওয়া। বাবার বন্ধুমহলে এই খবরটা পাচার করে দেওয়ার পরের ঠাট্টা আর টিটকিরিতে বাবা-মা দু'জনকেই লজ্জায় লাল হয়ে যেতে দেখে এবং আমাকে আড়ালে নিয়ে গিয়ে মায়ের ঠোনা খেয়ে বুঝেছিলাম কিছু একটা সমস্যা তৈরি করেছিলাম। সমস্যাটা যে কী তখন বুঝিনি, ফলত ঠোনা খাওয়ার আফসোসটুকু থেকে গেছিল। আজ সে আফসোস ভালোলাগার রেশ বয়ে আনে। লাজুক বাঙালি ছেলেটা, যে মুখ ফুটে ‘ভালোবাসি’ শব্দটা উচ্চারণ করতে গেলে গলার কাছে আবেগ দলা পেকে যায়, যে অল্প মাইনেয় টেনেটুনে সংসার চালালেও মাসে একবার স্ত্রীর জন্য কিছু একটা উপহার নিয়ে আসে, যে গান গেয়ে বা ছলে-বলে-কৌশলে বোঝাতে চায় মনের কথা, তার অপেক্ষা মনের মধ্যে জাগিয়ে দিয়েছে লোকটা। লোকটা হয়তো জানবে না, কিন্তু লোকটার এইসব অসম্ভব আশা মেয়ের মনে পুঁতে দেওয়ার জন্যই লোকটার মেয়েকে হয়তো আজীবন সঙ্গীহীন থেকে যেতে হবে। তবুও, মেয়ে চায় আর কিছু থাক বা না থাক, মেয়ের অন্তত ‘লোকটা’ থাক, শেষ পর্যন্ত।

 

More Articles