সত্যিই রয়েছে রক্তচোষারা! গলায় কাস্তে বাঁধা মহিলা ‘ভ্যাম্পায়ারের’ কঙ্কাল ঘিরে ঘনাচ্ছে রহস্য
এমনভাবে কাস্তেটি কঙ্কালটির গলার উপর রাখা ছিল যে যদি কেউ ওইভাবে উঠতে যায় নির্ঘাত তাঁর গলা ওই কাস্তেতে কাটবে। এছাড়াও কঙ্কালটির পায়ের বুড়ো আঙুলের সঙ্গে একটি লোহার শেকল বাঁধাও দেখতে পাওয়া যায়।
ভূত, প্রেতাত্মা, পিশাচ ইত্যাদি বিষয়ে না তো বিতর্কের শেষ রয়েছে না তো অন্ত রয়েছে মানুষের আগ্রহের। কখনও এমন প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে যে বিজ্ঞানীরাও হতভম্ব হয়ে মেনে নিয়েছেন অস্বাভাবিক এই বিষয়গুলিকে। আবার কখনও যুক্তি দিয়ে খানখান করেছে ভূত প্রেতের তত্ত্বকে। এত বড় বিশ্বে রহস্যের অভাব নেই। মাঝে মাঝেই এমন ঘটনা প্রকাশ্যে আসে যা আমাদের তথাকথিত বৈজ্ঞানিক চেতনাকে নাড়িয়ে দেয়। সম্প্রতি পোল্যান্ডের পিয়েনে গ্রামের কবরস্থান থেকে এক ‘ভ্যাম্পায়ার’ মহিলার কঙ্কাল উদ্ধার করেছেন প্রত্নতাত্ত্বিকরা। কিন্তু কী কারণে এই কঙ্কালকে ভ্যাম্পায়ার আখ্যা দিয়েছেন তাঁরা? তার পেছনেও অবশ্য কারণ আছে। নিকোলাস কোপারনিকাস বিশ্ববিদ্যালয়য়ের প্রফেসর ড্যারিউস পলিস্কির নেতৃত্বে একটি দল পোল্যান্ডের পিয়েনে গ্রামের একটি কবরস্তানে খোঁড়াখুঁড়ির কাজ করছিল। কাজ চলাকালীন হঠাৎ তাঁরা একটি কঙ্কালের হদিশ পান। প্রথমে সাধারণ কঙ্কালই ভেবেছিলেন সকলে। আরও খুঁড়তে খুঁড়তে তাঁরা বুঝতে পারেন এই কঙ্কাল অন্য কঙ্কালের মতো সাধারণ নয়। কিন্তু কেন?
কঙ্কালটিকে মাটি খুঁড়ে পুরোপুরি বাইরে আনার পর যে জিনিসটা সবার চোখে পড়ে তা হল কঙ্কালটির গলায় একটি কাস্তে। এমনভাবে কাস্তেটি কঙ্কালটির গলার উপর রাখা ছিল যে যদি কেউ ওইভাবে উঠতে যায় নির্ঘাত তাঁর গলা ওই কাস্তেতে কাটবে। এছাড়াও কঙ্কালটির পায়ের বুড়ো আঙুলের সঙ্গে একটি লোহার শেকল বাঁধাও দেখতে পাওয়া যায়। এইসব দেখে যথারীতি চমকে যায় প্রত্নতত্ত্ববিদের দল। কী কারণে একজন মৃত মানুষকে এইভাবে কবর দেওয়া হয়েছে? মৃত ব্যাক্তি কি কখনও জীবিত হয়ে ফিরে আসতে পারে? আমাদের সাধারণ বুদ্ধিতে বলে ‘না’। কিন্তু মধ্য যুগের মানুষদের বিশ্বাস ছিল ভিন্ন রকম। সেই সময়ের মানুষরা মনে করতেন অপঘাতে বা কম বয়সে যাঁরা মারা যান তাঁরা ফিরে আসেন ভ্যাম্পায়ার রূপে অর্থাৎ অশুভ শক্তির প্রতীক হয়ে। কবর থেকে বেরিয়ে এসে তাঁরা জীবিত প্রাণীর রক্ত শোষণ করেন। যাতে তাঁরা কবর থেকে বেরোতে না পারেন সেই জন্যই তখনকার আদিবাসীরা মৃত দেহকে নির্মমভাবে কবর দিত। কখনও হৃদপিণ্ড কেটে আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হত, কখনও মৃত দেহের উপর চাপা দেওয়া হত ভারী পাথর। মাথার খুলি ভেঙে দেওয়া হত, গরম লোহার ছ্যাঁকা পর্যন্ত দেওয়া হত মৃতদেহগুলিকে। লক্ষ্য ছিল একটাই, যেভাবেই হোক মৃতদেরকে কোনও প্রকারেই কবর থেকে উঠে আসতে দেওয়া চলবে না। ভ্যাম্পায়েরদের শক্তি হনন করে নেওয়াই ছিল এই সব প্রক্রিয়ার উদ্দেশ্য।
১৭ শতকের পোলিশ এই কবরস্তানে উদ্ধার হওয়া এই কঙ্কালটি একটি নারীর বলে জানিয়েছেন গবেষকরা। কিন্তু যে সে সাধারণ নারী নয়, একেবারে ভ্যাম্পায়ার মহিলা। ইতিহাসবিদ পলিস্কির মতে, “কাস্তেটি সমতলভাবে বিছিয়ে দেওয়া হয়নি বরং ঘাড়ে এমনভাবে স্থাপন করা হয়েছিল যে যদি মৃত ব্যাক্তি ওঠার চেষ্টা করত তাহলে তার মাথা কেটে যেত বা আহত হত।” পায়ের বুড়ো আঙুলের সঙ্গে শেকলের এই বন্ধন বিষয়ে পলিস্কি জানান, ১৬০০ দশকে পোল্যান্ডে এইভাবে তালাবন্ধ করে মৃতদেহকে কবর দেওয়া সাধারণত ‘ফিরে আসার অসম্ভবতার’ প্রতীক ছিল। কঙ্কালটির মুখের সামনের দাঁতটি অস্বাভাবিক রকমের বড় যা তার ভ্যাম্পায়ার হওয়ার যুক্তিকে আরও তীব্র করেছে। এছাড়াও কঙ্কালটির মাথায় একটি সিল্কের টুপি ছিল যার থেকে স্পষ্ট হয় যে এই মহিলা উচ্চ সামাজিক মর্যাদা সম্পন্ন মানুষ ছিলেন।
আরও পড়ুন- ৫০০০ গাড়ি চুরি, খুন! তাক লাগাবে ভারতের সবচেয়ে বড় গাড়ি চোরের জীবনযাপন
এবার আসা যাক ‘ভ্যাম্পায়ার’-এর উৎপত্তি বিষয়ে। ১১ শতক থেকে ১৭ শতক পর্যন্ত সময়ের মানুষজন খুবই অস্বাভাবিক ও রোমাঞ্চকর কিছু কুসংস্কার বা ধারণা পোষণ করতেন। বিশেষত মৃত মানুষদের নিয়ে অনেকের কল্প কথা বা চিন্তাধারা ছিল বেশ চিত্তাকর্ষক। তেমনই ইউরোপের কিছু অংশে বিশেষ করে স্লাভদের মধ্যে ভ্যাম্পায়ারদের প্রতি বিশ্বাস এতটাই প্রবল হয়ে গেছিল যে তা প্রায় গণ হিস্টিরিয়ার আকার নিয়েছিল।
বার্টন ট্রেন্ট অঞ্চলে স্টেপান হিলের সেন্ট পিটার্স চার্চের ভাম্পায়ারের গল্প আজও রহস্যে মোড়া। ১০৮৫ সালে একদল কৃষক এই চার্চে আশ্রয় গ্রহণ করে বেশ কয়েকদিন ওই চার্চে বসবাস করার পর হঠাৎ করেই একদিন খেতে খেতে মারা যান। কী কারণে তাঁদের মৃত্যু হয় কেউ তা জানতেও পারে না। যাইহোক, প্রত্যেকের দেহ ওই সেন্ট পিটার্স চার্চেই কবর দেওয়া হয়। এত অবধি ঠিকই ছিল কিন্তু পরিস্থিতি বাঁক নেয় অন্যদিকে। কৃষকদের মৃত্যুর কয়েকদিন পরেই অস্বাভাবিকভাবে গ্রামবাসীরা মারা যেতে থাকেন। আবার কেউ কেউ বলেন, মাঝরাত্রে নাকি তাঁদের নাম নিয়ে কেউ ডাকছে। যারা এই ডাকে সাড়া দিয়ে বাইরে গিয়েছে তাঁদেরকে কিছুদিনের মধ্যেই মৃত্যু গ্রাস করেছে। আবার কেউ কেউ বলেন, তাঁদের নাকি রাতের বেলা দেখা গেছে পিঠে কফিন নিয়ে ঘুরে বেড়াতে। স্বাভাবিকভাবেই আতঙ্ক গ্রাস করে গ্রামবাসীদের, তাঁরা বিশ্বাস করতে শুরু করেন, যাঁরা সেদিন চার্চে মারা গেছেন তাঁরা আসলে মৃত হয়েও জীবিত। মধ্যযুগের ওই সময়ে মানুষ মনে করত, এমন মৃত হয়েও জীবিত থাকেন যারা তারা অশুভ শক্তির উদাহরণ। তারা চাইলে পশু পাখি এমনকি মানুষকেও অসুস্থ করতে পারে বা মৃত্যুর দিকে নিয়ে যেতে পারে।
এই ঘটনায় যখন বার্টন ট্রেন্ট অঞ্চলের সবাই ভীত, তখনই গ্রামবাসীদের মনে বদ্ধ ধারণা হয় যে ওই মৃত কৃষকরাই এইসবের নেপথ্যে কারণ তাঁরা সকলেই রহস্যজনক ভাবে মারা যান। এরপরই সবাই মিলে একদিন সেই চার্চে গিয়ে একটি কবরকে বাইরে নিয়ে আসেন ও কৌতূহল বশত কফিনের ডালা খুলে ফেলেন। খুলেই আত্মারাম খাঁচাছাড়া হওয়ার জোগাড়। তাঁরা দেখেন মৃতদেহের মুখ খোলা ও সেখান থেকে গড়িয়ে পড়ছে তাজা রক্তের ধারা। ব্যাস! সেখান থেকেই জন্ম নেয় রক্তচোষা দানব বা ভ্যাম্পায়ারের গল্প। এরপরই গ্রামবাসীরা প্রত্যেকটি মৃতদেহকে বার করে তাদের হাত পা কেটে আলাদা করে দেয় ও ভেতরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে জ্বালিয়ে দেয়।
আরও পড়ুন- চিড়িয়াখানার খাঁচায় বন্দি মানুষ! কৃষ্ণাঙ্গ আদিবাসী ওটা বেঙ্গার কাহিনি সভ্যতার লজ্জা
এরপর থেকেই ধীরে ধীরে ভ্যাম্পায়ার বা রক্তচোষা দানবের কথা ছড়িয়ে পড়তে থাকে সারা ইউরোপে। যারাই অস্বাভাবিকভাবে মারা যেত তাদেরই হত এমন নির্মম গতি। একবার মধ্য ইউরোপের গ্রামে এক ব্যাক্তির মৃতদেহকে যখন দুই সপ্তাহ বাদে তুলে আনা হয় তখন নাকি তার মুখেও দেখতে পাওয়া গেছিল রক্তের দাগ। এরপর গ্রামবাসীরা যখন ওই দেহকে কাটতে যায়, সেই মৃতদেহ নাকি চিৎকার করে ওঠে। মৃত্যুর দু’সপ্তাহ পর কীভাবে এমন সম্ভব তা আজও কেউ বুঝতে পারেনি। বিশেষত পশ্চিম ইউরোপে স্লাভদের মধ্যে ভ্যাম্পায়ারদের ভয় ছিল মারাত্মক এবং এই বিংশ শতাব্দীতে এসেও তাদের ভয় এক চুলও কমেনি। আজও ইউরোপের বিভিন্ন স্থান থেকে এমন অদ্ভুত কিছু কঙ্কাল পাওয়া যায় যাদের বেশির ভাগেরই মাথা কাটা নয়, হাত পা বাঁধা। প্রত্নতত্ত্ববিদরা আজ অবধি এমন অনেক অদ্ভুত কঙ্কালের সন্ধান পেয়েছেন যাঁদের কারও উপর চাপা দেওয়া ছিল পাথর তো কারোর মুখে জোর করে গোঁজা হয়েছিল পাথরের টুকরো।
তখনকার মানুষের বিশ্বাস, ভয়, সংস্কার আজ স্থান নিয়েছে বিনোদনের পাতায়। ভ্যাম্পায়ারের সেই ভয়ানক রক্তচোষা কাহিনি আজ লোককথায় পরিণত। ক্রমাগত বিজ্ঞানীরা নানান যুক্তি দিয়ে ভেঙে ফেলছেন সেইসব প্রেত তত্ত্ব কথাকে যা এই সময়ের শিক্ষিত মানুষের কাছেও গ্রহণযোগ্য। কিন্তু কথায় আছে, “যা রটে তা কিছু তো বটে”। আর এত বড় পৃথিবীতে এত রহস্যের সবটাই যে মিথ্যে তাই বা আজ অবধি কে প্রমাণ করতে পেরেছে?