ইতিহাসে বারবার পরাজিত! মেসির আর্জেন্টিনাকে কি এবার টেক্কা দেবে হল্যান্ড
World Cup 2022: মেসির আর্জেন্টিনার জেতাই স্বাভাবিক। আর যদি হল্যান্ড জেতে, তা হবে পোয়েটিক জাস্টিস।
১৯৭৮-এ আর্জেন্টিনায় অনুষ্ঠিত ফুটবল বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হয় আর্জেন্টিনা। আয়োজক দেশ হিসেবে গ্যালারির সমর্থন পেয়েছিল আর্জেন্টিনা। যেমন, ১৯৭৪-এর ফাইনালে পশ্চিম জার্মানি পেয়েছিল গ্যালারির সমর্থন। বলা বাহুল্য, দু'বারেই পরাজিত ফাইনালিস্ট নেদারল্যান্ডস। রিনাস মিশেলের টোটাল ফুটবলের তত্ত্বকে মাঠে কার্যকর করার দায়িত্ব ছিল যাদের ওপর, তারা সফল হতে পারেনি।
'৭৪-এ জোহান ক্রুয়েফের ভয়ংকর ফর্ম থেমে যায় ফাইনালে গিয়ে। জোহান ক্রুয়েফ, জোহান নিসকেন্স, রুড ক্রল, আরি হান, জনি রেপ-এর শক্তিশালী হল্যান্ড ফাইনালে সেইপ মেয়ার, ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার, জার্ড মুলারদের পশ্চিম জার্মানির কাছে ১-২-এ পরাজিত হয়। ক্রুয়েফের দেওয়া পেনাল্টি গোলে হল্যান্ড এগিয়ে গেলেও জার্মানি গোল শোধ করে। পরে জার্ড মুলার জয়সূচক গোলটি করে।
'৭৮-এ ভেবেছিলাম ফাইনালে হল্যান্ড আর্জেন্টিনাকে হারাবে। আর্জেন্টিনা দলটি তারকাখচিত হলেও হল্যান্ডও ছিল শক্তিশালী। আর্জেন্টিনার কোচ ছিলেন সিজার লুই মেনোত্তি। লম্বা চুলের এই কোচকে টিভিতে দেখতাম ঘন ঘন চুরুট বা সিগারেট টানতে। সমীহ করার মতো ব্যক্তিত্ব। গোলে উবাল্ডো ফিল্লোল, পাসারেলা, আর্দিলেস, লিওপোল্ড লুকে, ড্যানিয়েল বার্তোনি, মারিও কেম্পেসদের নিয়ে গঠিত আর্জেন্টিনা মেনোত্তির তত্ত্বাবধানে তখন শক্তিশালী টিম। তখনকার চল্লিশ বছরের মেনোত্তি এখন চুরাশি পার করেছেন। বলা বাহুল্য, এখন তিনি আর্জেন্টিনা দলের ডিরেক্টর। স্কালোনি কোচ হলেও মেনোত্তির শ্যেনদৃষ্টি থাকে টিমের খেলার ওপরে।
আরও পড়ুন: জাপানের কাছে ইচ্ছাকৃত হার? স্পেনের পরাজয়ে যে বিতর্ক দানা বাঁধছে বারবার
যা হোক '৭৮-এর হল্যান্ড দলটিও ছিল তারকাখচিত।জোহান নিসকেনস, রুড ক্রল, আরি হান, জনি রেপ, রব রেনসেনব্রিঙ্ক, ডি জং, কারখপ ভাতৃদ্বয়কে নিয়ে তৈরি হল্যান্ড তখন দুর্দান্ত ফর্মে। নিজের দেশে খেলার সুযোগটা পুরোমাত্রায় উশুল করেছিল আর্জেন্টিনা। গ্যালারির সমর্থন ও চিৎকার কাজে লাগানোর জন্য পাঁচ মিনিট পরে মাঠে নামে আর্জেন্টিনা দল। হল্যান্ডকে উত্তেজিত করার একটা কৌশল ছিল হয়তো এটা। মারিও কেম্পেস এই খেলায় দু'টি গোল করে। একটি গোল করে ড্যানিয়েল বার্তোনি। হল্যান্ডের হয়ে একটি গোল শোধ করে ন্যানিঙ্গা। এক্সট্রা টাইমে যাওয়ার আগে খেলার ফলাফল ছিল ১-১। এখানে উল্লেখ্য, নির্ধারিত সময়ের একেবারে শেষ মুহূর্তে হল্যান্ডের ফরোয়ার্ড রব রেনসেনব্রিঙ্কের গোলার মত শট পোস্টে লেগে বাইরে যায়। অতিরিক্ত সময়ে আর্জেন্টিনা আরও দু'টি গোল করে। যদিও মারিও কেম্পেসের করা শেষ গোলটি হল্যান্ডের এক খেলোয়াড়ের পায়ে শেষ মুহূর্তে স্পর্শ করেছিল বলে অনেকে মনে করেন।
কথা হচ্ছে, রব রেনসেনব্রিঙ্কের গোলমুখী শটটা পোস্টের ভেতরের অংশে লাগলে অবধারিত গোল হত। খেলা তাহলে তো গড়াতই না অতিরিক্ত সময়ে। এখানেই হল্যান্ড ভাগ্যের হাতে মার খায়। রিনাস মিশেলের টিম পরপর দু'বার ব্যর্থ হওয়ায় হল্যান্ডের কাগজগুলিই ব্যঙ্গ করে লেখে, 'ফুরিয়ে গেল কমলালেবুর ঝুড়ি'। সেবার আর্জেন্টিনার কোচ ছিলেন সিজার লুই মেনোত্তি। এবার তিনি আর্জেন্টিনা ফুটবল টিমের ডিরেক্টর। কাগজে-কলমে কোচ লিওনেল স্কালোনি হলেও চানক্য মেনোত্তির মাথা থেকেই স্ট্র্যাটেজিগুলো বেরোচ্ছে। মেসিকে বেশি ড্রিবল করতে দেখা যায় না। অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে প্রিকোয়ার্টার ফাইনালে গোল তো করলই, কয়েকবার অনবদ্য ড্রিবলিংয়ে অস্ট্রেলিয়ার রক্ষণকে ফালাফালা করে দিল। দিয়েগো আর্মান্দো মারাদোনাকে মনে পড়াল মেসির এই সোলো ড্রিবলিংগুলো। ১৯৭৮-এ মারিও কেম্পেসকেও এইরকম ড্রিবলিং করতে দেখা গিয়েছিল।
সিজার লুই মেনোত্তি আর্জেন্টিনার জাতীয় দলেও খেলেছিলেন। ক্লাব ফুটবলে তিনি রোজারিও সেন্ট্রাল, বোকা জুনিয়রস, স্যান্টোস ক্লাবে খেলেছিলন। ১৯৬৩-১৯৬৮ পর্যন্ত আর্জেন্টিনার জাতীয় দলে খেলে ১১ গোল করেছিলেন। ফরওয়ার্ড পজিশনে খেলতেন। ছিপছিপে চেহারার জন্যে তাঁর ডাকনাম ছিল এল ফ্ল্যাকো। পেলের সঙ্গে স্যান্টোসে একসঙ্গে খেলার অভিজ্ঞতা তাঁর আছে। পেলের বিপক্ষেও খেলেছেন বিভিন্ন ক্লাবের হয়ে। পেলের প্রতি তিনি ছিলেন অসম্ভব শ্রদ্ধাশীল। একটি লেখায় তিনি লিখেছেন 'ডি স্টিফানো, ক্রুয়েফ, মারাদোনার সংমিশ্রণ হল পেলে। তিনি ছিলেন অতিমানব। দু'পায়ে ফ্রি-কিক নিতে পারতেন। কয়েক ফুট লাফিয়ে বুক দিয়ে বল নামাতে পারতেন। হেডে ৩৫ গজ দূর থেকে গোল করতে পারতেন।' আর্জেন্টিনার খেলোয়াড় হয়েও তিনি মুগ্ধ হয়ে পেলের খেলা দেখতেন। পেলের জীবনের এই সঙ্কটমুহূর্তে মেনোত্তির কথাগুলো মনে পড়বেই। কোচিংজীবনে তিনি বার্সিলোনা এফসি-রও কোচিং করিয়েছিলেন এক বছর। এছাড়া হারাকানস, বোকা জুনিয়র্স, রিভার প্লেট, অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ, পেনারোল প্রভৃতি দলের কোচ ছিলেন কোনও না কোনও সময়। ১৯৭৪ বিশ্বকাপের পর থেকে ১৯৮৩ পর্যন্ত তিনি আর্জেন্টিনার কোচিংয়ের দায়িত্বে ছিলেন।
১৯৭৮-এ মেনোত্তি ছিলেন আর্জেন্টিনা ফুটবল টিমের হেড কোচ। ভাগ্যের সহায়তা না পেলে সেবার ফাইনালে হল্যান্ডের হাতে হারতে হতো তাঁকে নির্ধারিত ৯০ মিনিটেই। রব রেনসেনব্রিঙ্কের শট পোস্টে লেগে বাইরে না গিয়ে গোলের মধ্যে ঢুকলে নির্ঘাত হারত আর্জেন্টিনা। এবার কাতার বিশ্বকাপে তিনি আর্জেন্টিনা দলের ডিরেক্টর। তিনি খেলা দেখছেন নিশ্চয়। হল্যান্ড তথা নেদারল্যান্ডসকে হারিয়েছিলেন '৭৮-এর ফাইনালে। এবার কোয়ার্টার ফাইনাল কি পারবেন মরিয়া হল্যান্ডকে হারাতে? স্কালোনি কোচ হলেও চাণক্য তো তিনিই। পঁচাশি বছরেও বুড়ো হাড়ে ভেলকি দেখাচ্ছেন। ৪৪ বছরের ব্যবধানে ইতিহাসের চাকা কি ঘুরতে চলেছে? যদি মেসির আর্জেন্টিনা জেতে, তবে সেটা হবে স্বাভাবিক ব্যাপার। আর যদি হল্যান্ড জেতে সেটা হবে পোয়েটিক জাস্টিস। রব রেনসেনব্রিঙ্কের সেই অভিশপ্ত শটের প্রায়শ্চিত্ত করবে হল্যান্ড।