দিনে নায়ক, রাত বাড়লেই নেকড়ে! ভয় ও কমেডির আড়ালে যে বার্তা রয়েছে 'ভেড়িয়া'-তে
Film Review: অমর কৌশিকের 'ভেড়িয়া' (২০২২) ভারতের প্রথম ক্রিয়েচার-কমেডি। কেমন হল এই ছবি?
অমর কৌশিকের 'ভেড়িয়া' (২০২২) ভারতের প্রথম ক্রিয়েচার-কমেডি। এই ছবির আরও একটি পরিচয় আছে অবশ্য। প্রযোজক দীনেশ বিজনের হরর-কমেডি ইউনিভার্সের তৃতীয় ছবি এটি। প্রথম দু'টি যথাক্রমে 'স্ত্রী' (২০১৮) ও 'রুহি' (২০২১)। দু'টি ছবির সঙ্গে তাল বজায় রেখেই 'ভেড়িয়া'-তেও হাস্যরসের মোড়কে সামাজিক বার্তা দেওয়ার প্রচেষ্টা করা হয়েছে এবং ছবিটা সেদিক থেকে সফলও বলা চলে। তবে অন্যান্য দিক থেকে অনেকাংশে দুর্বল।
দিল্লি-নিবাসী ভাস্কর (বরুণ ধাওয়ান) সড়ক নির্মাণের ঠিকাদার কর্মী। কাজের প্রতি অত্যন্ত নিবেদিতপ্রাণ। চিনের সীমান্তবর্তী উত্তর-পূর্ব ভারতের অরুণাচল প্রদেশের ঘন জঙ্গলের মধ্য দিয়ে হাইওয়ে নির্মাণের কনট্র্যাক্ট সুনিশ্চিত করতে সে তার পারিবারিক বাড়ি পর্যন্ত বন্ধক রেখেছে! এই কাজের সূত্রেই তার খুড়তুতো ভাই জনার্দনকে (অভিষেক ব্যানার্জি) নিয়ে অরুণাচল প্রদেশে আসে। সঙ্গী হিসেবে পেয়ে যায় স্থানীয় যুবক জমিন (পালিন কাবাক) ও পাণ্ডা (দীপক ডোবরিয়াল)-কে। তবে ঘন জঙ্গলের মধ্য দিয়ে রাস্তা বানানোর উদ্যোগ নিলেই তো আর হলো না, স্থানীয় গ্রামবাসীদের সঙ্গে কথা বলতে হবে, ভুলিয়ে-ভালিয়ে তাদের থেকে জমির দখল নিতে হবে। গ্রামের প্রবীণরা আপত্তি জানান, অন্যদিকে ভাস্কর যুবকদের এই বলে প্রলোভন দেখায় যে, একবিংশ শতাব্দীর মানুষ আর প্রকৃতি চায় না, পরিবর্তে চায় মল ও নেটফ্লিক্স। স্থানীয় দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের সহায়তায় ভাস্কর নিজের পক্ষে গ্রামবাসীদের অধিকাংশের সম্মতি জোগাড়ও করে ফেলে। সমস্যার সূত্রপাত হয় তখন, যখন ভাস্কর এক রাতে জঙ্গলে বিচরণ করা ভয়ানক এক নেকড়ের কামড় খায়। পশু-চিকিৎসক আনিকা-র (কৃতি শ্যানন) হাতুড়ে চিকিৎসায় সাময়িকভাবে সুস্থ হয়ে উঠলেও ভাস্কর পরদিন সকালে নিজের মধ্যে বেশ কিছু পরিবর্তন টের পায়। যেমন ঘ্রাণ ও শ্রবণশক্তি তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে, মৃত পশুর দুর্গন্ধ তার কাছে সুগন্ধ বলে মনে হয়, পশুপাখিদের কথাবার্তা বোঝার অদ্ভুত ক্ষমতা পেয়ে যায় সে এবং সবথেকে আশ্চর্যের কথা, ভাস্কর নিজের অজান্তেই রাতের বেলায় বিশালকায় নেকড়েতে পরিণত হয় এবং জঙ্গল কাটায় মদত দেওয়া কর্তাব্যক্তিদের আক্রমণ করা শুরু করে।
আরও পড়ুন: সব ধর্মেই লালসার শিকার নারী! রঞ্জন ঘোষের ‘মহিষাসুরমর্দ্দিনী’ যে সত্যি তুলে ধরে
'ভেড়িয়া' ছবিতে কমেডি ও থ্রিলারের মোড়কে পরিবেশের আবশ্যিকতা নিয়ে প্রয়োজনীয় যে বার্তা দেওয়া হয়েছে, সেক্ষেত্রে ফাঁকি নেই কোনও। তবে সমস্যা হয়ে গেছে স্ক্রিনপ্লে-তে। অপ্রত্যাশিত চমক থাকলেও, গল্পের দৈর্ঘ্য অকারণে হয়ে দাঁড়িয়েছে আড়াই ঘণ্টার বেশি। অহেতুক বেশ কিছু প্রসঙ্গ যোগ করায় ছবিতে মেদের পরত পড়েছে। দ্বিতীয়ার্ধে ভাস্কর ও আনিকা-র হঠাৎ প্রেমে যেমন কোনও যুক্তি নেই, তেমনই ছবির ক্লাইম্যাক্সে এই বিষয়টিই হয়ে গেছে আরোপিত। অমর কৌশিকের 'স্ত্রী' ছবিটি শুরু থেকে শেষ অবধি অত্যন্ত সুঠাম চালে এগিয়েছিল, ছবির বক্তব্য, ট্রিটমেন্টের সঙ্গে গতির তালমেল বজায় ছিল ভালোভাবেই। ফলত ছবিটা নিজের লক্ষ্যের সাপেক্ষে চূড়ান্ত মাত্রায় সফল। অন্যদিকে হার্দিক মেহতার 'রুহি'-র সামগ্রিক বক্তব্যে জল মেশানো না থাকলেও ছবির গতি একটা সময়ের পরে গিয়ে এমন বেপথে চলে যায় যে, আর সিধে রাস্তায় ফেরত আসতে পারে না। কমেডি, হরর, অপ্রত্যাশিত চমক ও ছন্দ মিলিয়ে যে আঁটোসাঁটো একটা ঘেরাটোপ তৈরি করতে হয়, যার দরুন গোটা ছবিই প্রত্যেক দর্শককে সমানভাবে আবেদন জাগাতে পারে, তা পরিপূর্ণতা পেয়েছিল 'স্ত্রী'-তে, তবে 'রুহি' ও 'ভেড়িয়া'― এই দু'টি ছবির কোনওটিতেই সেই উচ্চতায় পৌঁছনো সম্ভব হয়নি।
উত্তর-পূর্ব ভারতের নাগরিকদের প্রতি ভারতের মূল ভূখণ্ডের চরম উন্নাসিকতাকে একদম স্পষ্টভাবে 'ভেড়িয়া'-তে দেখানো হয়েছে এবং এই নিয়ে কমেডি-ইমোশনের মোড়কে সুস্পষ্ট বার্তাও দেওয়া হয়েছে, যা ভীষণভাবে প্রভাব ফেলতে সক্ষম। যেভাবে আমরা মণিপুর, মেঘালয়, অরুণাচল, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড প্রভৃতি রাজ্যের বাসিন্দাদের সন্দেহের নজরে দেখি, মুখ ভ্যাঙাই, সবসময় মজার ছলে নিই, ভাষাবোধ ও সংস্কৃতি নিয়ে খিল্লি করি, সেসব নিয়ে অসাধারণ কমেন্টারি করা হয়েছে এই ছবিতে। কেবল সঠিকভাবে হিন্দি বলতে পারলেই কেউ ভারতীয় হয়ে যায় না। হিন্দি বলয়ের গা-জোয়ারির প্রতিবাদে মুখর 'ভেড়িয়া' দেখে অনেকের চামড়ায় ফোসকা পড়তে বাধ্য।
একই সিনেম্যাটিক ইউনিভার্সের আওতায় 'স্ত্রী', 'রুহি' ও 'ভেড়িয়া'। উত্তর ও মধ্য ভারতের পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ও সেখানে নারীদের অবস্থান নিয়ে সুচতুর কমেন্টারি রয়েছে 'স্ত্রী'-তে। শহরের সমস্ত পুরুষ ভয়ে আক্রান্ত, কেননা রাতের বেলায় 'স্ত্রী' নামের এক ডাইনি পথেঘাটে ঘুরে বেড়ায় এবং শক্তসমর্থ জোয়ানদের তুলে নিয়ে চলে যায়। এই ভয় থেকে মুক্তি পেতে সবাই তাই নিজেদের বাড়ির বাইরে লিখে রাখে 'ও স্ত্রী, কাল আনা'। পৌরুষের দাপটের বিরুদ্ধে দুর্দান্ত স্টেটমেন্ট এই ছবি, লিঙ্গ-ভিত্তিক 'স্টিরিওটাইপ'-গুলোকে উল্টে-পাল্টে দিয়ে মজার ছলে মজ্জাগত পিতৃতান্ত্রিক মনোভাবের গালে সপাটে থাপ্পড় মেরেছিল 'স্ত্রী'। 'রুহি'-তে দেখানো হয়, ডাইনি তথা 'অন্যরকম' নারীদের নিয়ে এই সমাজের গতে বাঁধা ধ্যান-ধারণা এবং কীভাবে একজন সরল নারী তার 'ডাইনি' স্বরূপকে শেষমেশ আপন করে নেওয়ার মাধ্যমে সমস্ত বাধাকে অতিক্রম করে। ছবিটায় ফেমিনিস্ট টাচ থাকা সত্ত্বেও মনে হতে পারে, এ যেন নিজ সত্ত্বাকে আপন করে নিয়ে নিজের ছন্দে বাঁচতে চাওয়ার গল্প। নিজস্ব সুবিধার জন্য পুরুষদের তৈরি করা 'ডাইনি' কনসেপ্টকেই আক্রমণ করা হয় এই ছবির মাধ্যমে। তেমনভাবে 'ভেড়িয়া'-তে পরিবেশ ও মানুষের লড়াই এবং নর্থ-ইস্টের প্রতি আমাদের অকারণ ঘৃণাকে একহাত নেওয়া হয়েছে।
তবে কেবল বক্তব্য জানালেই তো আর হবে না, ছবিকে ছবির স্বার্থেই সুঠাম, মেদহীন ও সর্বোপরি মনোমুগ্ধকর হতে হবে। হরর, হরর-কমেডি ইত্যাদি জঁরের নিজস্ব গতিবিধি ও ব্যাকরণ আছে। সেসবকে স্বীকৃতি না দিলে এই ধরনের ছবি স্বার্থক হতে পারে না। দীনেশ বিজনের বানানো ইউনিভার্সের আগামী ছবিগুলোতে এই ব্যাপারগুলো স্মরণে রাখলে ভালো।
বরুণ ধাওয়ানের অভিনয় প্রতিভা মন্দ নয়, সেটা তিনি সুজিত সরকারের 'অক্টোবর' (২০১৮) ও শ্রীরাম রাঘবনের 'বদলাপুর' (২০১৫) ছবিতে প্রমাণ করে দেখিয়ে দিয়েছেন। 'ভেড়িয়া'-তেও ক্ষেত্রবিশেষে ভালো অভিনয় করেছেন। কৃতি শ্যাননের চরিত্রটিতে গভীরতা কম, আরও লেয়ার যোগ করা হলে ভালো হত। তার অভিনয়ও সামান্য উচ্চকিত। তবে এ-ছবিকে যিনি নিজের কাঁধে চাপিয়ে একার দমে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন, তিনি হলেন অভিষেক ব্যানার্জি। যেরকম অভিনয় প্রতিভা, তেমনই দুর্দান্ত কমিক টাইমিং, ডায়লগ ডেলিভারি ও মেদহীন এক্সপ্রেশন। অভিষেককে এর আগে আমরা 'আজ্জি', 'পাতাল লোক', 'স্ত্রী', 'ড্রিমগার্ল' ইত্যাদি ফিল্ম ও সিরিজে দেখেছি। এত চমৎকার 'আনপ্রেডিক্টেবেল' প্রতিভার অধিকারী চরিত্রাভিনেতাকে কেবলই একইরকম লোক হাসানোর চরিত্র দিয়ে যাওয়া হচ্ছে, যা একেবারেই উচিত নয়। তিনি ডার্ক ক্যারেক্টারও যে কতটা সুনিপুণভাবে করে দেখাতে পারেন, তার প্রমাণ 'আজ্জি' ও 'পাতাল লোক'। এর বাইরে নবাগত পালিন কাবাক এবং বহুদিনের অভিজ্ঞ ও সুখ্যাত দীপক ডোবরিয়াল এই ছবির অন্য দুই প্রাণভোমরা। অভিষেক, পালিন ও দীপক― এই তিনজনের মিশ্রণেই 'ভেড়িয়া' একটানে বসে দেখে ফেলা যায়। একটুও নিরাশ হতে দেয় না।
আগামীতে 'স্ত্রী'-কে কেন্দ্র করেই পরপর দু'টি ছবি আসতে চলেছে। একটি স্ত্রী'-এর সিক্যুয়েল 'স্ত্রী ২' এবং অন্যটি প্রিকোয়েল 'মুঞ্ঝা'। 'ভেড়িয়া'-র মিড ক্রেডিট সিনটি খুব জরুরি, কেননা এখানে 'স্ত্রী ২'-এর বীজ বোনা হয়েছে সুন্দরভাবে।