Film Review: নিম্নবর্ণের অধিকার সোচ্চারে আদায় করার ছবি 'কান্তারা'
Film Review: জল-জমি-জঙ্গল কার? এই প্রশ্নকে অন্য চোখে দেখে 'কান্তারা'।
বিগত কয়েক বছর ধরেই দক্ষিণ ভারতের চলচ্চিত্র বলিউডকে প্রায় ধরাশায়ী করে রেখেছে। আঞ্চলিক কনটেন্টও কতটা সর্বজনীন হতে পারে, তা আরেকবার মালুম হলো ঋষভ শেট্টি পরিচালিত ছবি ‘কান্তারা’ দেখতে গিয়ে। রবিবার ছুটির দুপুর; আইনক্স হাউজফুল। একটি রিজিওনাল ছবি দেখার জন্য এত মানুষের ভিড় দেখেই বোঝা যায় যে, শেষ ১৩-১৪ বছরে দক্ষিণী ছবি নিজেদের কোন উচ্চতায় নিয়ে গেছে। এই ছবিটি ইতিমধ্যে IMDB সাইটে সর্বোচ্চ রেটিংপ্রাপ্ত ভারতীয় সিনেমা- ৯.৩ রেটিং ১০-এর মধ্যে। যদিও এই রেটিং ছবির গুণমানের নির্ধারক একেবারেই নয়, তাও মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত আগ্রহ এই ছবি নিয়ে সুস্পষ্ট হয়ে উঠছে।
মূলধারার ছবির সব মালমশলায় ঠাসা- প্রেম-রোমান্স, অ্যাকশন, রিভেঞ্জ সব মজুত। কিন্তু সঙ্গেই উঠে আসছে জাতি-বৈষম্যর রাজনীতি, সামন্ততান্ত্রিক সমাজের প্রতিভূ এক জমির মালিক, অরণ্যের অধিকার ঘিরে স্টেট ও স্থানীয় আদিবাসীদের উত্তেজনা। এখানেই বাকি প্রদেশে নির্মিত ছবিগুলোকে একপাশে ছিটকে দিচ্ছে 'কান্তারা'। দক্ষিণ ভারতের মানুষজন কতটা নিজেদের সংস্কৃতির সঙ্গে একাত্ম বোধ করে, এই ছবিগুলো তার প্রমাণ। একের পর এক দক্ষিণী ছবি প্রান্তিক মানুষের কণ্ঠস্বর হয়ে উঠছে।
কন্নড় ছবি ‘কান্তারা’ নিখুঁত নয়। অনেক জায়গায় সমস্যাজনক। নায়িকার কোমরে চিমটি কেটে প্রেমের দৃশ্য থেকে অনবরত অ্যাকশন ও দ্রুতি এই ছবির পরতে পরতে! কিন্তু এরপরেও তা আড়াই ঘণ্টা চেয়ারে বসিয়ে রাখে। এই সিনেমার কেন্দ্রবিন্দু কর্নাটকের একটি কাল্পনিক গ্রামের লোককথা, সেই আখ্যান ঘিরেই সিনেমা আবর্তিত হয়। কাহিনি তিনটে সময়কাল ঘিরে এগিয়ে চলে। তুখোড় সম্পাদনার ম্যাজিকে অতি দ্রুত লয়ে গল্প তরতর করে এগোয়।
আরও পড়ুন: আজও সেরা ছবির তালিকায় ‘পথের পাঁচালী’, ‘শোলে’! কতটা ক্ষতি হচ্ছে ভারতীয় সিনেমার
সংস্কৃতে 'কান্তারা' অর্থ হলো অরণ্য। প্রায় দেড়শো বছর আগে এক রাজা সেখানকার আদিবাসীদের নিজের মনের শান্তির জন্য অনেকটা জমি দান করেন। এরপর অনেকটা বছর কেটে যাওয়ার পর সেই জমি নিয়ে সমস্যা দেখা দেয়। জল-জমি-জঙ্গল কার? অরণ্যের অধিকার সরকারের না সেখানকার আদিবাসীদের?
অরণ্যের বাসিন্দারা 'কাম্বালা' নামে এক উৎসব করে। সেই উৎসবের অন্তর্গত কোলা তাদের এক গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় আচার। এই গল্পের নায়ক শিবা-র পরিবারে দেবতা ভর করে ১৯৭০ সালের এক কোলা উৎসবে। রাজার এক বংশধর নিজেদের জমি ফেরত চেয়ে মৃত্যুবরণ করে। এই ঘটনার ২০ বছর পর ফরেস্ট অফিসার মুরলির সঙ্গে শিবার বিরোধ বাধে জমির অধিকার নিয়ে। তারপর নানা মোড় ঘুরে ফিরে পাওয়া অরণ্যের অধিকার, আখ্যানের মূল সুর এটিই।
গল্প সেই চেনা খাত বেয়েই এগিয়ে চলে- অন্যায়ের বিরুদ্ধে অধিকারের জয়! কিন্তু এই সিনেমা দেখার অভিজ্ঞতা অনবদ্য। পরিচালক ঋষভ শেট্টি একই সঙ্গে এখানে ছবির পরিচালক, লেখক ও নায়ক। প্রত্যেকটা বিষয় বেশ দক্ষতার সঙ্গে উতরেছে। মুগ্ধ করে ছবির আবহসংগীত। প্রত্যেকটা দৃশ্যে অসম্ভব যত্নের ছাপ ছবিজুড়ে। সিনেম্যাটোগ্রাফার অরভিন্দ কাশ্যপের কাজ দুর্দান্ত। ফ্রেমে ক্যামেরার জাদুস্পর্শে মায়াবী দৃশ্যের জন্ম দিয়েছেন। জঙ্গলের মধ্যে অ্যাকশন দৃশ্যগুলোর নির্মাণ খুবই উচ্চমানের। ঋষভ শেট্টি যেভাবে নিজেকে চরিত্রের ছাঁচে ঢেলে পুরো ছবিজুড়ে দাদাগিরি করে গেলেন, তা বিস্মিত করে। একটা দৃশ্যের উল্লেখ করতেই হবে- যেখানে নায়ক শিবা জানতে পারে আসল কলকাঠি নাড়ছে সেখানকার বর্তমান রাজার বংশধর। সোজা তার বাড়িতে প্রবেশ করে খাবার টেবিলে মুখোমুখি বসে খাওয়ার দৃশ্য রাজনৈতিক অভিঘাত তৈরি করে। আসলে এতদিন নিম্নজাতি বলে কখনও সেই উচ্চবর্ণের মানুষের বাড়িতে সে পা পর্যন্ত রাখেনি। তাই এই দৃশ্য জাতি-বৈষম্যের বিরুদ্ধে সটান থাপ্পড়ের মতো পর্দায় প্রতিফলিত হয়।
যুক্তি বিসর্জন দিয়ে মুগ্ধ হয়ে উপভোগ করার মাঝেই মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, এই ছবি নিয়ে উত্তেজনার কী আছে! সাউথে প্রত্যেক তিন মাসে এমন এক-একটা ছবি তৈরি হচ্ছে। ঠিক সেই সময় সাক্ষী থাকতে হবে এক অসাধারণ সিনেম্যাটিক অভিজ্ঞতার- শেষের পনেরো মিনিট। ঋষভ শেট্টির অভিনয় এক অসামন্য অভিজ্ঞতার সম্মুখীন করায়। হলে বসে দেখার সময় শরীরে কাঁটা দিয়ে ওঠে। ক্লাইম্যাক্স এই ছবিটিকে অন্য এক উচ্চতায় তুলে নিয়ে যায়। এই অভিজ্ঞতা বাড়িতে ল্যাপটপে বসে পাওয়া অসম্ভব। বড়পর্দায় ছবি দেখার কোনও বিকল্প যে নেই, তা 'কান্তারা’ হলে দেখেই মালুম হয়।
দক্ষিণী ছবি প্রমাণ করে যে, সেখানকার মানুষ নিজেদের ঐতিহ্য নিয়ে কতটা ওয়াকিবহাল। সেখানকার মানুষজন নিজেদের ভাষা, সংস্কৃতি, আচার-আচরণ যত্নে আগলে রেখেছে। আরও একটি বিষয় এক্ষেত্রে উল্লেখ্য অবশ্যই। অরণ্যের সঙ্গে জড়িত পৌরাণিক ভাবনার এমন চলচ্চিত্রায়ন ভারতে আর হয়েছে কি? রিজার্ভ ফরেস্ট, বা সংরক্ষিত অরণ্যের রাজনীতির সঙ্গে মানুষের বসতির সংঘাত, আবার মিলন, এ যেন এক পরম্পরার ইতিহাসকে তুলে ধরছে লহমায়।
ছবি: কান্তারা
পরিচালক: ঋষভ শেট্টি
ক্যামেরা: অরভিন্দ কশ্যপ
অভিনয়: ঋষভ শেট্টি, সপ্তমী, কিশোর, অচ্ছুত কুমার, মানাসি সুধীর, প্রমোদ শেট্টি