পর্দায় প্রথম চুম্বনদৃশ্য, অভিনয়ে মুগ্ধ হয়েছিলেন নেহরু || আজীবন বিতর্কিত ছিলেন দেবিকা রানি
বম্বে টকিজ যখন তার সবচেয়ে সেরা অভিনেত্রীর অপেক্ষায় প্রহর গুনছে, তখনই একটি চিরকুট এসেছিল। তাতে লেখা ছিল, ‘বিদায়...'
২০১২ সালে ভারতীয় চলচ্চিত্রের একশো বছর পূর্ণ হওয়ার পুণ্যলগ্নে খবরের কাগজে ছড়িয়ে পড়তে থাকে একটি খবর– ৫৪ বছর পর 'বম্বে টকিজ' পুনরায় আত্মপ্রকাশ করতে চলেছে। ভারতীয় চলচ্চিত্র নিয়ে যাঁরা খানিক হলেও চর্চা করেন, তাঁরা অবশ্যই এই প্রোডাকশন হাউজটির নাম শুনে থাকবেন। এককথায় বলা যায়, এই বম্বে টকিজ না থাকলে, আজ বলিউডকে আমরা এই চেহারায় কখনওই পেতাম না।
এই বম্বে টকিজ যে দু'জন মানুষের হাত ধরে গড়ে উঠেছিল, তাঁরা ছিলেন দেবিকা রানি এবং হিমাংশু রায়। বম্বে টকিজ-এর সঙ্গে দু'জনের নাম জড়িত থাকলেও, এই প্রোডাকশন হাউজের মূল প্রাণদাত্রী ছিলেন দেবিকা রানি এবং তিনিই ছিলেন ভারতীয় চলচ্চিত্রের প্রথম অভিনেত্রী।
ব্যক্তিগত জীবন
দেবিকা রানির জন্ম ১৯০৮ সালে ওয়ালটাওয়ার-এ, যা বর্তমানের বিশাখাপত্তনম। পিতা মন্মথনাথ চৌধুরী ছিলেন মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির প্রথম ভারতীয় সার্জেন্ট জেনারেল এবং মা ছিলেন নীলাদেবী চৌধুরী। হয়তো জানলে অবাক হবেন, এই দেবিকা রানি ছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাতনি। মাত্র নয় বছর বয়সে পড়াশোনার জন্য লন্ডনের এক বেসরকারি স্কুলে ভর্তি হন দেবিকা রানি এবং ১৬ বছর বয়সে রয়্যাল অ্যাকাডেমি থেকে অভিনয় বিষয়ে পড়াশোনার জন্য তিনি স্কলারশিপও পেয়েছিলেন। অভিনয় ছাড়াও তিনি সংগীত, নৃত্যকলা এবং ফ্যাশন ডিজাইনিং নিয়ে শিক্ষা লাভ করেন। ১৯২৮ সালে লন্ডনে হিমাংশু রায়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ হওয়ার পর দেবিকার জীবনের সবকিছুই বদলে যায়। হিমাংশু রায় তখন ইন্দো-ইউরোপীয় যৌথ উদ্যোগে নির্মিত ছবিতে কাজ করছিলেন। সাক্ষাতের একবছর পরেই, অর্থাৎ ১৯২৯ সালেই হিমাংশু রায়ের সঙ্গে দেবিকা রানি বৈবাহিক সূত্রে আবদ্ধ হন এবং বিবাহের পর এই নবদম্পতি বার্লিনে চলে যান চলচ্চিত্র-বিষয়ক উন্নত শিক্ষা গ্রহণের উদ্দেশ্যে। একদিকে হিমাংশু চলচ্চিত্র প্রযোজনার কাজে যুক্ত হন এবং অন্যদিকে দেবিকা ছবি নির্মাণের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে শিক্ষা লাভ করতে থাকেন।
আরও পড়ুন: চুলে ফুলের মালা, পরনে সুইম স্যুট, কেমন ছিলেন সেকালের ‘মিস ইন্ডিয়া’?
অভিনেত্রী হিসেবে আত্মপ্রকাশ
১৯৩৩ সালে 'কর্ম' নামক একটি ছায়াছবির মাধ্যমে দেবিকা রানি একজন অভিনেত্রী হিসেবে প্রথম আত্মপ্রকাশ করেন। লন্ডনে এই ছবিটি হিন্দি এবং ইংরেজি দুই ভাষাতেই প্রকাশ পায়। মাত্র ২৫ বছর বয়সেই তিনি সেদিন লন্ডনের বিভিন্ন পত্রপত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় নিজের স্থান করে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, 'কর্ম' ছবির পরে তিনি আমেরিকা এবং জার্মানির বিভিন্ন পরিচালকের সঙ্গে কাজ করার সুযোগও পান।
'বম্বে টকিজ'-এর জন্ম
বিদেশে সাফল্য পেলেও স্বদেশের চিন্তা-ভাবনা ও রুচির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছবি করার তাগিদে এই জুটি ভারতে ফিরে আসেন। ভারতে ফিরে এসে ১৯৩২ সালে স্বামী হিমাংশু রায়ের সঙ্গে কাঁধে-কাঁধ মিলিয়েই, দেবিকা রানি সেসময় চলচ্চিত্রজগতের সেরা প্রতিষ্ঠান বম্বে টকিজ গড়ে তোলেন। বিদেশের মাটিতে 'কর্ম' বিপুল সাফল্য পেলেও ১৯৩৬ সালে প্রকাশ পাওয়া 'অচ্ছুৎ কন্যা' ছবিতে তাঁর অভিনয়ের সুবাদে ভারতবাসীর কাছে তিনি রাতারাতি জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। এই ছবির সাফল্যই যেন সেদিন বম্বে টকিজের দূর ভবিষ্যতের কথা বলে দিয়েছিল। এমনকী, সেদিন এই ছবির প্রিমিয়ার শো-তে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু নিজে উপস্থিত ছিলেন। এই ছবিতে মুখ্য ভূমিকায় দেবিকার অভিনয় দেখে তিনি মুগ্ধ হয়েছিলেন। ছবিতে দেবিকা রানির বিপরীতে অভিনয় করেছিলেন অশোক কুমার। এই ছবিতে চলচ্চিত্রের পর্দায় প্রথম চুম্বনদৃশ্য দেখেছিল ভারত, যে দৃশ্যে ছিলেন দেবিকা রানি স্বয়ং।
'অচ্ছুৎ কন্যা'-র পরেও দেবিকা রানি, অশোক কুমারের সঙ্গে একের পর এক হিট ছবি বম্বে টকিজকে উপহার দিয়েছিলেন। দেবিকা চেয়েছিলেন, তাঁর ছবি যেন তৎকালীন সমাজের লাঞ্ছিত, অবহেলিত নারীদের কথা বলে কিংবা মানুষের সামনে সমাজের বাস্তব নগ্ন দিকটি তুলে ধরে। সেইমতোই তাঁর অভিনীত ছবি 'জীবন প্রভাত'-এ (১৯৩৭) তিনি এক হতভাগ্য ব্রাহ্মণ কন্যার, 'নির্মলা'-তে (১৯৩৮) মা হওয়ার জন্য ব্যাকুল এক মহিলার এবং 'দুর্গা'-তে (১৯৩৯) এক অনাথ মেয়ের চরিত্রে অভিনয় করেন। দেবিকা রানির ছবিগুলো ছিল সামাজিক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে এক প্রতিবাদসম।
বম্বে টকিজ-এর দ্রুত খ্যাতির শিখরে উন্মেষের পিছনে দেবিকা রানির ক্যারিশমার ভূমিকা অনস্বীকার্য। বম্বে টকিজের একমাত্র তারকা অভিনেত্রী শুধুমাত্র নন, একই সঙ্গে তিনি দক্ষ ছিলেন বম্বে টকিজের জন্য অর্থলগ্নিকারক খুঁজতেও। অর্থলগ্নিকারীরা অনেকেই নাকি দেবিকা রানির ব্যক্তিত্বের আকর্ষণে টকিজে অর্থলগ্নি করতেন।
কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত অতি স্বল্প সময়ের মধ্যেই বম্বে টকিজের ইন্দ্রপতন ঘটে। ১৯৪০ হিমাংশু রায়ের মৃত্যু হয়। ততদিনে আবার দেবিকা এবং হিমাংশুর সম্পর্কে ফাটল বেশটাই গভীর হয়ে গিয়েছিল। তবুও হিমাংশু রায়ের মৃত্যুর পর বম্বে টকিজের শেয়ার হোল্ডারদের মধ্যে বিবাদ শুরু হলে দেবিকা রানি এই প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
১৯৪৪ সালে ইউসুফ খান নামক একজন যুবক বম্বে টকিজ প্রযোজিত ‘জোয়ার-ভাটা’ নামক ছবিতে অভিনয়ের মাধ্যমে অভিনয় জগতে প্রবেশ করেন। যুবকটির নামটি অপ্রচলিত ঠেকায় দেবিকা রানি তাঁর চলচ্চিত্রজগতের নামকরণ করেন দিলীপ কুমার হিসাবে। আমরা সকলেই ভারতীয় চলচ্চিত্রে দিলীপ কুমারের অবদান সম্পর্কে কম-বেশি অবগত। এভাবেই দেবিকা রানির হাত ধরে শিশু অভিনেত্রী মুমতাজ, মধুবালা নাম নিয়ে অভিনয়জগতে প্রবেশ করেন। দেবিকা রানির নেতৃত্বে বম্বে টকিজ পরবর্তীকালে চলচ্চিত্রজগতে দিকপাল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত শিল্পীদের অভিনয়জগতে প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখলেও প্রতিষ্ঠানের অন্তর্কলহের জন্য ক্রমশ তা ভেতরে ভেতরে রুগ্ন হতে থাকে।
শেষ জীবন
এমতাবস্থায় ১৯৪৩ সালে 'হামারি রাত' ছবিতে অভিনয় করে দেবিকা রানি অভিনয়জগৎ থেকে অবসর নেন। সালটা ১৯৪৫, বম্বে টকিজ যখন তার সবচেয়ে সেরা অভিনেত্রীর অপেক্ষায় প্রহর গুনছে, তখনই একটি চিরকুট এসেছিল। তাতে লেখা ছিল, ‘বিদায়। আজ থেকে আমি টকিজের সঙ্গে সম্পর্কের ইতি টানলাম।’ দীর্ঘ ১০ বছর ধরে চলচ্চিত্রে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে অভিনয় করে, ভারতীয় চলচ্চিত্রের প্রথম মহিলা চলচ্চিত্রজগৎ থেকে এভাবেই সরে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন সেদিন, কারণ ইতিমধ্যেই তাঁকে নিয়ে প্রতিষ্ঠানে অসংখ্য তর্ক-বিতর্কের ঝড় উঠতে শুরু হয়েছিল। তিনি প্রতিষ্ঠানটিকে তাঁর অংশের শেয়ার বিক্রি করে বিখ্যাত রুশ চিত্রকর স্বেতোস্লাভ রোয়ারিখকে বিবাহ করে হিমাচল প্রদেশের মালানিতে চলে যান। নেহরু পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সুবাদে তিনি এই সময় বন্যপ্রাণীদের নিয়ে বেশ কয়েকটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেন। পরবর্তীকালে তিনি অভিনয়জগৎ থেকে অনেক দূরে, বেঙ্গালুরুতে বসবাস শুরু করেন।
স্বেতোস্লাভের ১৯৯৩ সালে মৃত্যু হয়। তার ঠিক পরের বছরেই অর্থাৎ ১৯৯৪ সালে ব্রংকাইটিসে আক্রান্ত হয়ে দেবিকা রানিও মারা যান। দেবিকা রানি যেহেতু নিঃসন্তান ছিলেন, তাই তাঁর মৃত্যুর পর সমস্ত সম্পত্তি ভারত সরকার অধিগ্রহণ করেন।