সব নিয়ম মেনে নিজেকেই বিয়ে, গুজরাতের এই মেয়ে যে পথ দেখাচ্ছেন

চিরাচরিত বিয়ে বিষয়ে বিন্দুর কোনও আগ্রহ না থাকলেও, বিয়ের সামগ্রিক বিষয়টি নিয়ে তাঁর ভালো লাগা অনেকদিনের। তাই সেইমতো, তাঁর বিয়েও অন্যান্য হিন্দু বিয়ের সকল আচার-অনুষ্ঠান মেনে, ধুমধাম করে পালিত হবে।

জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে ক্ষমা বিন্দুর বিয়ে নিয়ে নেটজগৎ রীতিমতো তোলপাড় হয়ে যায়। যাঁরা এখনও জানেন না, ঠিক কী বিষয়ে এই ঝড়ের সূত্রপাত, তাঁদের বলে রাখি, ক্ষমা বিন্দু জানিয়েছেন তিনি নিজেকেই নিজে বিয়ে করতে চলেছেন ১১ জুন। ভারতীয় ইতিহাসে এই বিয়ে এক বিরল ঘটনা। নিজেকে নিজের এই বিবাহকে বলা হয়ে থাকে 'সোলোগ‍্যামি' বা 'অটোগ‍্যামি'।

ক্ষমা বিন্দু কে?

প্রথমেই জেনে নেওয়া যাক, কে এই ক্ষমা বিন্দু? গুজরাতের বরোদা-নিবাসী ক্ষমা একজন সমাজবিজ্ঞানের ছাত্রী এবং তার পাশাপাশি পেশায় একজন ব্লগারও, বয়স মাত্র ২৪ বছর। ক্ষমার বাবা পেশায় দক্ষিণ আফ্রিকায় কর্মরত একজন ইঞ্জিনিয়ার এবং তাঁর মা-ও এলাহাবাদে কর্মরত একজন ইঞ্জিনিয়ার। ক্ষমা জানান, বিয়ে নিয়ে তাঁর কোনওদিনও বিশেষ আগ্রহ ছিল না, এমনকী, তিনি কখনও বৈবাহিক সূত্রে আবদ্ধ হতে চাননি। কিন্তু তাঁর বরাবরের ইচ্ছা ছিল ভারতীয় রীতিনীতি অনুসরণেই লাল র‌ংয়ের পোশাক পরে কনে সাজার। তিনি তাঁর সেই ইচ্ছেকেই পূর্ণতা দিতে চলেছেন ১১ জুন।

বিন্দু আরও বলেছেন, মানুষ স্বাভাবিকভাবে তাঁর ভালবাসার মানুষটিকে বিয়ে করে, এখানে সেই ভালবাসার মানুষটি যেহেতু সে নিজেই, তাই তিনি নিজেকেই বিয়ে করতে চলেছেন। তিনি বলেন, এই বিয়ে আসলে তাঁর নিজের কাছে নিজের গ্রহণযোগ্যতার সবচেয়ে বড় পরীক্ষা এবং সিদ্ধান্তও বটে। তিনি এই বিয়ের মাধ্যমে নিজের ভালো কিম্বা খারাপ, সবটুকুইকেই গ্রহণ করতে চান, ঠিক যেমন আর পাঁচটা সাধারণ দম্পতি করে থাকেন। প্রথম থেকেই বিন্দু সমস্ত বিষয় নিয়ে একটু অন্যভাবে ভাবতে পছন্দ করতেন। মেয়ের এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে তাঁর বাবা-মাও অবগত ছিলেন। তাই হয়তো তাঁর এই সিদ্ধান্তে মা এবং বাবা– দু’জনের কেউই বিরোধিতা করেননি, বরং তাঁর বাবা এবং মা- দু'জনেই এই বিয়ে নিয়ে যথেষ্ট খুশি, মেয়েকে আশীর্বাদ করেছেন দু'-হাত ভরে এবং বলছেন, তাঁরা দু'জনেই ক্ষমার বিয়েতে অন্যান্য বন্ধুদের সঙ্গে উপস্থিত থাকবেন।

আরও পড়ুন: প্রেমের চেয়ে বড় বন্ধুতা? বলিউডে না হলেও বাংলা সাহিত্যে

কীভাবে সম্পন্ন হবে এই বিয়ে

চিরাচরিত বিয়ে বিষয়ে বিন্দুর কোনও আগ্রহ না থাকলেও, বিয়ের সামগ্রিক বিষয়টি নিয়ে তাঁর ভালো লাগা অনেকদিনের। তাই সেইমতো, তাঁর বিয়েও অন্যান্য হিন্দু বিয়ের সকল আচার-অনুষ্ঠান মেনে, ধুমধাম করে পালিত হবে। বিয়ের স্থান ইতিমধ্যেই ঠিক করে ফেলেছেন তিনি, এবং বিয়ের দু'দিন আগে থেকেই বাকি বিয়ের মতোই সমস্ত নিয়ম মেনে হলদি, মেহেন্দি এবং সংগীত-এর অনুষ্ঠানগুলি পালিত হবে। বাকি হিন্দু বিয়ের মতো মন্দিরেই বিয়ে সারবেন তিনি, পরনে থাকবে লাল শাড়ি এবং মন্দিরে পৌঁছনোর আগেই মাথায় থাকবে লাল রঙের সিঁদুর। বিন্দু আরও জানিয়েছেন, বিয়ের পর তিনি দু’সপ্তাহের জন্য অন্যান্য নবদম্পতিদের মতোই হানিমুন কাটাতে গোয়া সফরে যাবেন, সে ব্যবস্থাও ইতিমধ্যেই সেরে ফেলেছেন তিনি। যদিও ইতিমধ্যেই গুজরাতের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল বিজেপির একাংশ এই বিয়ে নিয়ে ঘোরতর প্রতিবাদ জানিয়েছে। তাঁরা দাবি করেছেন, যেহেতু এই বিয়েতে কোনও পাত্র নেই, তাই ক্ষমার এই বিয়ে হিন্দুধর্মের ভাবাদর্শে আঘাত হেনেছে এবং সেই কারণেই গুজরাতের কোনও মন্দিরে এই বিয়ে সম্পন্ন হতে পারে না।

ক্ষমা বিন্দুই কি প্রথম?

এই ধরনের বিয়ে কি ক্ষমা বিন্দুই প্রথম করছেন?এককথায় উত্তর দিতে হলে বলতে হয়, না। সোলোগ‍্যামি বা নিজেকে বিয়ে করার এই প্রথা পশ্চিমের দেশগুলিতে অনেকদিন ধরেই রয়েছে। এই আত্মবিবাহের প্রথম উদাহরণ খুঁজতে গেলে বেশ খানিকটা সময় পিছিয়ে যেতে হয় বইকি! ১৯৯৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অধিবাসী লিন্ডা বেকার এই আত্মবিবাহে প্রথম আবদ্ধ হয়েছিলেন। তিনি পেশায় ছিলেন একজন ডেন্টাল হাইজিনিস্ট। আজ থেকে প্রায় তিন দশক আগে ৭৫ জন বন্ধু এবং পরিবারের উপস্থিতিতে তিনি, তাঁর বিবাহ সম্পন্ন করেছিলেন। শুধু বিয়েই কেন? গত বছর সোলোগামির বিবাহ-বিচ্ছেদের কথাও সামনে আসে। ক্রিস গালেরা নামে একজন ব্রাজিলিয়ান মডেল নিরানব্বই দিনের মাথায় তাঁর এই বৈবাহিক সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে এসেছেন, অন্য একজনকে ভালবাসার কারণে। বর্তমানে পশ্চিমের দেশগুলিতে হু হু করে বাড়ছে এই একক বিবাহের দৃষ্টান্ত। আপনারা হয়তো জানলে অবাক হবেন, ভারতীয় সাহিত্যেও কিন্তু এই এই ধরনের ভালবাসার উল্লেখ আছে। ‘পদ্মাবতী' কাব্যে দেখা যায়, নিজের রূপের ছটায় নিজেই বিভোর হয়ে গিয়েছিলেন পদ্মাবতী:

আপনা রূপের ভাবে আপে হইল লিন

আপনা হেরিতে হৈল আপ হোতে ভিন।।

শুধু সাহিত্য নয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনপ্রিয় দুই টেলিভিশন শো ‘গ্লি’ এবং ‘সেক্স অ্যান্ড দ্য সিটি’-র মূল থিম ছিল এই সোলোগ‍্যামি বা আত্মপ্রেম।

সোলোগ‍্যামির সংখ্যা সমাজে ক্রমশ বাড়ছে কেন?

নিউ ইয়র্কের শিল্পী গ্যাব্রিয়েল পেনাবাজ তাঁর অভিজ্ঞতা থেকে বলেছেন, এই ধরনের বিয়েতে প্রায় ৮০ শতাংশ মহিলাই অশ্রুসজল চোখে নিজেকে ভালবাসার শপথ নিয়ে থাকেন এবং প্রতিজ্ঞা করেন, নিজেদের আর কুৎসিত না ভাবার।

ডমিনিক ইউখেহপাজ নামে এক ব্যক্তি ২০১১ সালে একক বিবাহে আবদ্ধ হন এবং তখন থেকেই তিনি একটি কনসালটেন্সি ব্যবস্থা চালু করেছেন। এই কনসালটেন্সি চালানোর সময় তিনি দেখেছেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যে-সকল মহিলা নিজেদের বিবাহিত জীবনে লাঞ্ছনা এবং গঞ্জনার শিকার হয়েছিলেন, তাঁরাই বেশিরভাগ এই বিয়েতে এগিয়ে এসেছেন। তিনি আরও বলেছেন, এই বিয়ের পর অনেক ক্ষেত্রেই মহিলারা নিজেদের কাজে অনেক বেশি করে নিমগ্ন থাকতে পারেন। আবার নিজেকে বিয়ে করার পরেও অনেক সময়েই মহিলারা তাঁদের প্রিয়জনের কাছে ফিরে যান।

OECD-র ( organization for ecomonic co-operation and development) মতে, যখন উন্নত অর্থনৈতিক দেশগুলিতে অবিবাহিত মানুষের সংখ্যা সমস্ত রেকর্ড ভেঙে এগিয়ে চলেছে, সেই সঙ্গে তাল মিলিয়েই বেড়ে চলেছে মানুষের সোলোগ‍্যামির প্রতি আকর্ষণ।

লস এঞ্জেলেস-এর গহনা-নকশা প্রস্তুতকারী ড্যাং মোরান বলেছেন, যাঁরা সোলোগ‍্যামি পছন্দ করছেন, তাঁরা অধিকাংশই শিক্ষিত, আর্থিকভাবে স্বচ্ছল এবং শহরের বাসিন্দা। এঁদের অনেকেই পূর্বে কোনও না কোনও বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ হয়েছিলেন। তাঁর কথায়, বর্তমানে এই ধরনের বিয়ের পরিমাণ এতই বেড়ে চলেছে যে, আগামিদিনে বিবাহ-আয়োজক সংস্থাগুলিকে সোলোগ‍্যামির কথা মাথায় রেখেই পরিকল্পনা প্রস্তুত রাখতে হবে।

ইংল্যান্ডের সোফি ট্যানার, ২০১৫ সালে এই আত্মবিবাহে আবদ্ধ হয়েছিলেন। এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছেন, আত্মবিবাহ তাঁর জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠান, তিনি যে তাঁর ভাবাবেগের কাছে আবদ্ধ– তারই প্রকাশরূপ।

নিউজিল্যান্ডবাসী ক্যারেন নিমো, একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ জানিয়েছেন, নিজেকে নিজের অপচ্ছন্দ করা অনেক মানসিক রোগের প্রধান কারণ। সোলোগ‍্যামি অনেক সময় এই ধরনের ট্রমায় উপশমের কাজ করে। অনেক সময় সম্পর্কজনিত সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে এই ধরনের বিবাহ কার্যকর হতে পারে। তবে তিনি সোলোগ‍্যামি প্রসঙ্গে একটি সাবধানতার বার্তাও জারি করেছেন। তিনি বলেছেন, খেয়াল রাখতে হবে এই আত্মপ্রেম যেন কখনওই নার্সিজিমে পরিণত না হয়, তাহলে সারাজীবন সমাজ-বহির্ভূত জীবনযাপন করতে হবে।

সবশেষে বলতে হয়, এই একক বিবাহ বা সোলোগ‍্যামি এখনও পর্যন্ত কোনও দেশেই আইনসম্মত নয়, তবে এই বিবাহে আজ অবধিও কাউকে আইনি বাধার সম্মুখীন হতে হয়নি। এখন দেখার, ভারতে এই একক বিবাহ আদৌ কতখানি গ্রহণযোগ্যতা লাভ করতে সক্ষম হয়।

 

 

 

More Articles