বেহুলা থেকে রোহিঙ্গা, মাছে-ভাতে বাঙালিকে ভারত অবহেলা করতে শিখল কবে?
Paresh Rawal Fish Controversy: পরেশ রাওয়াল সম্প্রতি গুজরাতে ভালসাদ শহরে বিজেপির নির্বাচনী সমাবেশে যা বলেছিলেন তার সারমর্ম করলে দাঁড়ায়, দাম আজ বাড়ছে, কাল কমবে, কোনও কিছুই চিরস্থায়ী নয়। যা চিরস্থায়ী তা হল ঘৃণা।
বিবিধের মাঝে যে মহান মিলনের কাহিনি ছোট থেকে শোনানো হয়, তা আদ্যন্ত ও বিশুদ্ধ ঢপবাজি ছাড়া কিস্যু না। ভারত বৈচিত্রময়, সন্দেহ নেই। এই বৈচিত্রের মাঝে ঐক্য রয়েছে, একে অন্যের ঐতিহ্যের প্রতি, আচরণের প্রতি, ভাষার প্রতি সহনশীলতা রয়েছে- এসব যারা বলেন, নেহাতই অভ্যাস ছেড়ে বেরোতে না পারার কুসংস্কারে বলে ফেলেন। ভারতের প্রতি রাজ্যের ভাষা আলাদা, খাদ্যাভ্যাস আলাদা, পোশাক আলাদা, আবহাওয়া আলাদা, প্রেম আলাদা, রক্ষণশীলতাও আলাদা। সুতরাং কাশ্মীরে বসে মুম্বইয়ের রাস্তা চেনা যেমন দুরূহ, গুজরাতে বসে অরুণাচলের ভয় বোঝাও ঠিক ততটাই অসম্ভব। এমনকী খোদ দক্ষিণবঙ্গে বসে উত্তরবঙ্গের অনুভূতি ঠাহর করা যায় না। এমন এক বৈচিত্রের ভারতে দাঁড়িয়ে তিনি বাঙালির খানা-পিনা নিয়ে কথা বলেছেন। তা বলতেই পারেন, ঐক্য না থাক গণতন্ত্রে সকলের কথা কওয়ার অধিকার রয়েছে। কিন্তু অধিকার ফলাতে গিয়ে নেহাত ছেঁদো কথা বলে ফেলেছেন অভিনেতা পরেশ রাওয়াল, যাকে দেশ পরে চিনেছে বিজেপির নেতা হিসেবে। গুজরাতে থেকে তিনি বাংলাকে ঠিক ততটাই চিনেছেন, যতটা বলিউড তাঁকে চিনিয়েছে। রসগুল্লা-মছলি আর মিষ্টি দহির বাইরে এই বাঙালিকে চেনেইনি অন্য প্রদেশ। কিন্তু প্রশ্নটা শুধু মেছো বাঙালির খাদ্য-সেন্টিমেন্ট নিয়ে নয়। প্রশ্ন-উত্তর সবটাই বড় সুষ্পষ্ট এখানে। কোনও ভণিতা নেই, প্রাণও যদি চলে যায় যাক, কিন্তু মুসলমান সহ্য করা যাবে না। দীর্ঘদিন ধরে আস্তে আস্তে পাড়ার চায়ের দোকান, ছোট্ট মুদিখানা, গলির আড্ডা, রাতের খাবার থালায় এভাবেই ঢুকে পড়েছে বিধর্মীদের প্রতি ঘৃণা। বিজেপি বাংলায় কত আসন পেল, এসব বালখিল্যতায় আটকে থাকা নেহাতই অর্বাচীন। গেরুয়াতন্ত্র বহুকাল আগে সম্প্রীতিকে হেরো পার্টি করে ফেলেছে। অত্যন্ত সুচারু কৌশলে ‘র্যাশনাল’ বাঙালির মননেও ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে মুসলিম বিদ্বেষ। পরেশ রাওয়ালের মন্তব্য কটু সত্য মাত্র, কানে লেগেছে বাঙালির- তাই মানে লেগেছে।
অভিনেতা এবং ভারতীয় জনতা পার্টির নেতা পরেশ রাওয়াল সম্প্রতি গুজরাতে ভালসাদ শহরে বিজেপির নির্বাচনী সমাবেশে যা বলেছিলেন তার সারমর্ম করলে দাঁড়ায়, দাম আজ বাড়ছে, কাল কমবে, কোনও কিছুই চিরস্থায়ী নয়। যা চিরস্থায়ী তা হল ঘৃণা। বাড়ির পাশে যদি রোহিঙ্গা মুসলিম এসে বসতি স্থাপন করে তাহলে আর এই দেহ-মন-কায়া-মায়া-গ্যাস-পেট্রোল লইয়া তুমি কী করিবে ভারতবাসী? গুজরাতবাসী আসলেই ভারতবাসীরই রেপ্লিকা। রাজ্যের বাসিন্দারা সেখানে মুদ্রাস্ফীতি সহ্য করে নিলেও নিতে পারে, কিন্তু মোল্লা প্রতিবেশী? নৈব নৈব চ! আহমেদাবাদ পূর্ব আসনের প্রাক্তন বিজেপি সাংসদ পরেশ বলেছেন, পাড়ায় রোহিঙ্গা মুসলিম উঠে এলে বাড়িতে আর গ্যাস সংযোগ নিয়ে হবেটাই বা কী? “বাঙালিদের জন্য মাছ রান্না করবেন”? এইবার কথাটা হল, মাছ তো বাঙালির খাদ্য। রোহিঙ্গা বাংলাদেশেও মাছ খায়, বাঙালি বাঁকুড়াতেও মাছ খায়, এমনকী সুমেরু টুমেরুতে গেলেও পারলে মাছ নিয়েই যায়। গুজরাতবাসী বাঙালিরাও দিব্য কাঁটা বেছে খান (আবাসনে অনেকে চুপি চুপি কাঁটা ফেলেন, ঝামেলা এড়াতে)। তাহলে মাছের সঙ্গে হঠাৎ ‘মুসলিম’ জুড়ে গেল কীভাবে? খাদ্য বিষয়ে আরেকটা উদাহরণ দিলেই মৎসের
মুসলিম যোগ বোঝা যাবে। আম আদমি পার্টির প্রধানকে ব্যাঙ্গ করে পরেশের অভিযোগ, কেজরিওয়াল "শাহিনবাগে বিরিয়ানি বিতরণ” করতে যেতেন। উল্লেখ্য, ২০১৯ এবং ২০২০-র গোড়ার দিকে দিল্লির শাহিনবাগ এলাকাটি ছিল নাগরিকত্ব (সংশোধনী) আইনের বিরুদ্ধে দেশের বৃহৎ বিক্ষোভের স্থান। আর বিক্ষোভকারীদের একটি বড় অংশই ছিলেন মুসলিম মহিলারা।
সুতরাং বাংলাদেশ-বাঙালি-রোহিঙ্গা-মাছ বলতে পরেশ আখেরে যা বোঝেন ও বোঝান তা হলো বিশেষ সম্প্রদায়। ঠিক যেভাবে লুঙ্গি এককালে হয়ে উঠেছিল সন্ত্রাসবাদী চিহ্নিতকরণের ১০ টি উপায়ের অন্যতম। পরে ক্ষমা চেয়েছেন পরেশ। ক্ষমা চাইতে গিয়ে আত্মঘাতী গোলও করেছেন। পরেশ বলছেন, "অবশ্যই মাছ সমস্যা নয় কারণ গুজরাতিরা মাছ রান্না করে খায়, তবে, বাঙালি বলতে আমি অবৈধ বাংলাদেশি এবং রোহিঙ্গাদের বোঝাতে চেয়েছি।” রাজনীতি করছেন অথচ বাংলাদেশি-বাঙালি-রোহিঙ্গা ইত্যাদি সম্পর্কে এত দুর্বল জ্ঞান? এ কেমন হলো? নাকি জানেন সবই, পরেশের লক্ষ্য ছিল ক্রিস্পি কথায় তাড়াতাড়ি নিজের ‘হেট-স্পিচ’ উপস্থাপনা। মেছো বাঙালিকে বাকি ভারত, বিশেষ করে আর্য ভারত কোন দিক দিয়ে দেখে তা বহু আগেই স্পষ্ট করে জানিয়েছিলেন নীহাররঞ্জন রায়,
“বাংলাদেশের এই মৎস্যপ্রীতি আর্যসভ্যতা ও সংস্কৃতি কোনোদিনই প্রীতির চক্ষে দেখতো না, আজও দেখে না: অবজ্ঞার দৃষ্টিটাই বরং সুস্পষ্ট।”
প্রাচীন বাঙালির খাদ্যাভ্যাস প্রসঙ্গে নীহাররঞ্জন ‘বাঙালির ইতিহাস’ বইইয়ে বলেছিলেন, “ইতিহাসের ঊষাকাল হইতেই ধান যে দেশের প্রথম ও প্রধান উৎপন্ন বস্তু, সে দেশে প্রধান খাদ্যই হইবে ভাত তাহাতে আশ্চর্য হবার কিছু নাই… বারিবহুল, খাল-বিল বহুল, প্রশান্ত সভ্যতা প্রভাবিত এবং আদি অস্ট্রেলীয়মূল বাংলায় মৎস্য অন্যতম প্রধান খাদ্যবস্তুরূপে পরিগণিত হইবে ইহা কিছু আশ্চর্য নয়।” ইতিহাস যে তথ্য আমাদের দেয়, তা অনুযায়ী, ভারতবর্ষে পাওয়া মাছের জীবাশ্মের বয়স ৩০ কোটি বছর। মেহরগড়ে ৭০০০ থেকে ২৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে গড়ে উঠেছিল কৃষিভিত্তিক সভ্যতা। সেখানেই মাটি খুঁড়ে পাঁচটি মাছের ছবি আঁকা একটি পোড়ামাটির থালা পাওয়া মেলে। এই থালাই প্রমাণ করে প্রাচীন সিন্ধু সভ্যতায় মানুষের কাছে জনপ্রিয় খাদ্য ছিল মাছ। আর ভাত? দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে বাংলায় ধানের আমদানি হয়েছিল প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে। ভারতের বিভিন্ন স্থানের প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা অনুযায়ী, ৮৫৫-১৩৮০ এই সময়কালে চালের প্রচলন ছিল। ৩০০০ থেকে ৫০০০ বছর আগে ভাত রান্নাও করা হতো। উত্তরপ্রদেশের লহুরাদেওয়ার কাছে একটি জলাশয়ে আনুমানিক সাত হাজার বছরের পুরনো বুনো ধানের খোঁজ মিলেছে। তবে ইতিহাসে ভারতীয় উপমহাদেশের ভাত আর মাছের কথা যতই বলা হোক, তা প্রাদেশিক খাদ্য হয়েই থেকে গিয়েছে এবং বর্তমানে আবার বিশেষ ‘গোষ্ঠী’ চিহ্নিত করার অস্ত্রও হয়ে উঠেছে।
সেই সব প্রচেষ্টার মুখে ছাই দিয়ে বাঙালির খাবার নিয়ে গর্ব করার রয়েছে ঢের। আসলে বাঙালির খাবার কোনওকালেই স্রেফ খাবার তো ছিল না। খিদে মেটানোর মাপকাঠির চেয়ে ঢের ঊর্ধ্বে গিয়ে ঐতিহ্য, সাহিত্য মিশে তৈরি হওয়া এক সংস্কৃতির নাম ভাত-মাছ। সাহিত্য বলছে, বেহুলার বিয়েতে নাকি ঝোল-ঝাল-ভাজাসহ মাছের ১৮ রকম পদ রান্না হয়েছিল। কবি বিজয় গুপ্ত লিখছেন,
“মাগুর মৎস্য দিয়া রান্ধে গিমা গাচ গাচ/ ঝাঁজ কটু তৈলে রান্ধে খরসুল মাছ।।
ভিতরে মরিচ-গুঁড়া বাহিরে জড়ায় সুতা/ তেলে পাক করি রান্ধে চিঙড়ির মাথা।।”
সাহিত্যের ছত্রে ছত্রে উঠে এসেছে গাওয়া ঘি দিয়ে ফেনা ওঠা ভাত খাওয়ার কাহিনি। আর তার সঙ্গে ‘সাইড ডিশ’ হিসেবে বারেবারে এসেছে ময়না/মৌরলা মাছেদের কথা। হবে নাই বা কেন, ধানের ক্ষেত আর জলার মাছের যেখানে এত প্রাচুর্য সেখানে মূল খাবার হিসেবে ভাত-মাছই জায়গা করে নেবে একথা বলার অপেক্ষাই রাখে না। ভাত-মাছ বাঙলার খাবার, পদের বাহার আলাদা হতে পারে, কিন্তু আদতে এই খাবারের শ্রেণিবিভেদ নেই। ঈশ্বর গুপ্তকে এখানে ডাকা যেতে পারে, সারবত্তা তিনিই লিখেছেন,
“ভাত-মাছ খেয়ে বাঁচে বাঙালি সকল
ধানে ভরা ভূমি তাই মাছ ভরা জল।”
সুকুমার সেনের মতে, প্রাচীন বাঙালি সমাজে মাছ-মাংসের জনপ্রিয়তা ছিল অব্রাহ্মণদের মধ্যে। এমনকী বৃহদ্ধর্মপুরাণেও মাছের মাহাত্ম্য বর্ণনা রয়েছে। পুরাণের চরিত্রদের মধ্যেও মৎস অনুসঙ্গ রয়েছে অটুট। শিবায়ণ কাব্যে কুঁড়ে শিবকে চাষের কাজে নামাতে গৌরী নাকি বাগদিনীর ছদ্মবেশে শিবের ক্ষেতে মাছ ধরতে এসেছিলেন। তাই দক্ষিণ ২৪ পরগনার মৎসজীবী সম্প্রদায় পুকুরের জল সেঁচে মাছ চাষ শুরুর আগে এখনও মাকাল (মহাকাল) পুজো করে।
পরেশ যে বাঙালিকে চেনেননি, বা যে বাঙালিকে অবজ্ঞা-ঘৃণার পাঠ শেখাতে এসেছেন সেই বিষয়ে এই ছোট্ট গল্পটাই শেষ পাতের সমাপন। ‘ওস্তাদ’ হওয়ার আগে রামপুর দরবারে চার বছর সরোদ বাজানো শিখে ফেলেছেন আলাউদ্দিন খাঁ। তাঁর বাজানো দেখে বন্ধুরাই হিংসে করেন! অবাঙালি বন্ধুরা তাচ্ছিল্য করতেন, "মচ্ছিকে পানি পিনেওয়ালা" বলে। কিছুকাল সহ্য করার পরে একদিন ভীষণ রেগে সতীর্থ জমিরুদ্দিনকে বললেন, "পায়ে ধরে সরোদ বাজাব। শুনবি?...বাঁ হাতে বাজিয়ে শোনাব।" সেই থেকে তিনি বাঁ হাতে তারের যন্ত্র আর ডান হাতে চামড়ার যন্ত্র বাজাতেন। বাঙালি আর মাছের কথা উঠলে ওস্তাদ আলাউদ্দীন খাঁর এই গল্পই মনে পড়ে। এক ‘মাছখোর’ বাঙালির কাছে সরোদ বাজানোও ছিল বাঁ হাতের খেলা।