চুনো পুঁটি থেকে রাঘব বোয়াল, ৫১৬ বছরের এই মেলা মাছপ্রেমীদের কাছে স্বর্গ!
Fish Fair : মাঘের পয়লা তারিখে মাছের মেলা, শীতের আমেজে জমজমাট আয়োজন
শীতকাল মানেই বাংলায় হরেক মেলার পসরা। গ্রাম তো বটেই খোদ কলকাতা শহরেও এই সময় নানা কিছু নিয়ে মেলা চলে। হস্তশিল্প মেলা, সিনেমা মেলা, পিঠে মেলা, বইমেলা এই সবই খুব পরিচিত ঠেকলেও আজ যার কথা বলব তা একেবারেই অন্য স্বাদের। এ মেলার গায়ে কেমন যেন আঁশটে গন্ধ। শুনতে অবাক লাগলেও এটাই সত্যি, জিলিপি, পাঁপড় অথবা নাগরদোলা নয় মেলার মূল আকর্ষণ হরেক রকমের মাছ।
প্রতি বছর মাঘ মাসের পয়লা তারিখ বসে এই মেলা। হুগলি জেলার ব্যান্ডেলের কেষ্টপুর গ্রামের এই মেলার নাম ‘মাছ মেলা’। মাছের মেলায় মাছই মূল উপজীব্য। চুনো পুঁটি থেকে রাঘব বোয়াল সবই থরে থরে সাজানো থাকে। খাল, বিল, পুকুর অথবা সমুদ্রের নোনা জলের মাছ, যেমন পছন্দ তেমনটাই মিলবে এখানে। শুধু তাই নয়, চাইলে মেলাতে মাছ কিনে সেখানেই ভেজে খেয়ে দেখতে পারেন কেমন স্বাদ, সেই ব্যবস্থাও রয়েছে।
রুই, কাতলা, চিতল, চিংড়ি, বেলে, ভোলা, ভেটকি, শোল, পাবদা, ট্যাংরা ইত্যাদি প্রায় ৫০-৬০ রকমের মাছ থাকে মেলা। কোনওটার ওজন মাত্র কয়েক গ্রাম, কোনওটা আবার ৪০-৫০ কেজির সমান। কথায় বলে মাছে-ভাতে বাঙালি। বাঙালিকে চেনার এ এক চিরায়ত সহজ উপায়। ঝালে, ঝোলে, অম্বলে, মাছ বাঙালির চাই-ই চাই। তাই বলে মাছের প্রতি অকৃত্রিম টান যে হেঁশেল থেকে বেরিয়ে সোজা মেলায় এসে জুটবে তা আশা করি সহজ ছিল না। হুগলি এই মৎস্য মেলা ঘিরেও রয়েছে ইতিহাস। ৫১৬ বছরের পুরনো গল্প। কবে কীভাবে শুরু হয় এই মেলা, কোথা থেকেই বা এল এমন আজব নাম, এইসব প্রশ্নের উত্তর মেলে সেই সব গল্পেই।
আরও পড়ুন - দুর্গাপুজোর পর এবার গঙ্গাসাগর! ইউনেসকোর হেরিটেজ তকমার দৌড়ে কতটা এগিয়ে এই মেলা?
ব্যান্ডেলের কেষ্টপুর গ্রাম, খুব কাছেই কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়-এর জন্মস্থান দেবানন্দপুর। তবে এই মেলার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছেন অন্য এক বিশিষ্ট ব্যক্তি। তিনি রঘুনাথ গোস্বামী। শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভুর অন্যতম পারিষদ নিত্যানন্দর একনিষ্ঠ শিষ্য ছিলেন রঘুনাথ। কথিত আছে, তিনি সন্ন্যাস নিয়ে দীর্ঘদিন নিরুদ্দেশ ছিলেন। তারপর হঠাৎই একদিন ফিরে আসেন গ্রামে। ঘর ছাড়া ছেলে বাড়ি ফিরে আসার আনন্দে আত্মহারা হয়ে যান রঘুনাথের বাবা। এই অবস্থায় ছেলে ফেরার খবরে গ্রামবাসীরা আবদার করে বসেন বাবার কাছে যে গোটা গ্রামের মানুষকে খাওয়াতে হবে। আম আর ইলিশ মাছ খাওয়ানোর আবদার। তিনি সেদিন ফেলতে পারেননি সেই আবদার। আজ থেকে ৫১৬ বছর আগের সেই দিনটিও ছিল পয়লা মাঘ। সেই দিনেই পাশের বাগান থেকে আম আর সরোবর থেকে ইলিশ মাছ তুলে সেদিন গ্রামবাসীদের খাওয়ান রঘুনাথ গোস্বামীর বাবা। সেই থেকেই প্রতি বছর ওই দিনে আমবাগানে বসে মাছ খাওয়ার রেওয়াজ শুরু হয়। যদিও এ গল্প, সত্যতা বিচারের দায় পাঠকেরই। নচেৎ মাঘ মাসের এমন ভরা শীতে ইলিশই বা কোথায় আর আমই বা পাকবে কেমন করে! কিন্তু লোকমুখে প্রচারের একটা অদ্ভুত ক্ষমতা আছে, তার জোরও ঢের। তাই সেই থেকেই এই মাছ মেলা চলছে রমরমিয়ে। তার পর সময় এগোয় অনেক অনেকটা পথ, কালক্রমে যুগের হাওয়া লাগে মেলায়। ইলিশ মাছ থেকে ছড়িয়ে পড়ে আজ হরেক রকমের মাছের পসরা এখানে। হুগলি ছাড়াও বর্ধমান, হাওড়া, নদিয়া, উত্তর ২৪ পরগনা,বাঁকুড়া থেকে মাছের মেলায় আসেন মানুষ। কেউ আসেন বেচতে, কেউ কিনতে, কেউ আবার স্রেফ দেখতে ভিড় করেন উত্তরায়ণের দিনে বসা এই মেলায়।
১০০ থেকে শুরু করে ২০০০ টাকা কেজি দরের মাছ মাছ কিনতে ভিড় উপচে পড়ে এখানে। মাছ মেলার জনপ্রিয়তাকে ঘিরে পাশেই বিষয়ে আরো অনেক রকমের খাবার এবং অন্যান্য সামগ্রীর পসরা। শীতের আমেজে মাছের মেলায় গিয়ে পাশের আমবাগানে মাছ ভেজে পিকনিক করেন বহু জন। বাঙালির মাছ-ভাতের সংস্কৃতি যেন মিলেমিশে যায় এখানে। আর বছরের এই একটা দিনকে ঘিরে চলকে ওঠে স্মৃতির ভাঁড়ার।