নেশা প্রত্নতত্ত্ব, দশ হাজারের বেশি প্রত্নবস্তু দিয়ে সুন্দরবনে সংগ্রহশালা গড়লেন মৎসজীবী
Sundarbans Museum: এই সংগ্রহশালা ঘুরে দেখার জন্য তিনি কোনও অর্থ নেননা। নদী ও সমুদ্রে মাছ ধরে যেটুকু অর্থ উপার্জন হয় তার সবটুকু দিয়েই এই সংগ্রহশালা তৈরি হয়েছে।
পেশায় সুন্দরবনের মৎস্যজীবী হলেও নেশা প্রত্নতাত্ত্বিক জিনিস সংগ্রহ। সুন্দরবনের সুপ্রাচীন ইতিহাসকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরতে একাই লড়াই করছেন সুন্দরবনের প্রত্যন্ত অঞ্চলের এক মৎস্যজীবী বিশ্বজিৎ সাহু। সম্পূর্ণ নিজের উদ্যোগে সুন্দরবনের বিচ্ছিন্ন এক দ্বীপ জি প্লটের গোবর্ধনপুরে গড়ে তুলেছেন সংগ্রহশালা। তাঁর সংগ্রহশালায় রয়েছে দশ হাজারেরও বেশি প্রত্নবস্তু। সুন্দরবনের ছোট্ট দ্বীপ গোবর্ধনপুরের সাগরের ধারে টালির বাড়িতে জন্ম বছর ৫০-এর বিশ্বজিৎ সাহুর। বংশ পরম্পরায় জেলের কাজই করে আসছেন তাঁরা। জন্ম থেকে প্রায় তিরিশটি ভয়ঙ্কর বন্যার সম্মুখীন হয়েছেন তিনি। বারবার তলিয়ে গিয়েছে ভিটেমাটি, হয়েছেন সহায় সম্বলহীন। তবুও ছাড়েননি ভিটে , ছাড়ার কথা ভাবেনওনি। তবে বঙ্গোপসাগরের করাল গ্রাসে বাঁধ ভেঙে জল প্রবেশ করেছিল এলাকায়। বাধ্য হয়ে একসময় তাই জি প্লটে বুড়োবুড়ির তটে চলে আসেন। অভাবের সংসারে পড়াশোনা ছিল বিলাসিতা। তবে ছোট থেকে অজানাকে জানার আগ্রহ ছিল প্রবল। পড়াশোনার বদলে জাল হাতে সংসারের হাল ধরতে হয়েছিল ১৪ বছর বয়স থেকেই। করতে হয়েছে দিনমজুরের কাজও।
গোবিন্দপুরে এক হাজার হেক্টর জমিতে ছড়িয়ে থাকা একটি বন থেকে বিশ্বজিৎ সাহুর সংগ্রহ অভিযানের শুরু। বিরাট জমিটি একসময় সাগরের বুকে ডুবে ছিল। এরপর সাগরে, সুন্দরবনের নদীতে কাজ করতে গিয়ে বিভিন্ন সময়ে অদ্ভুত অদ্ভুত সব পুরোনো দিনের জিনিস চোখে পড়লে সেগুলোকে তুলে এনে নিজের বাড়িতে রাখতেন তিনি। তখনও সেসবের মাহাত্ম্য বোঝার জ্ঞান হয়নি। ১৬ বছর বয়সে আ্যপেনডিসাইটিসের চিকিৎসার জন্য কলকাতার যাওয়ার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। সেখানে তিনি জাদুঘর দেখে প্রত্নতত্ত্বের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করেন। সেই থেকে শুরু হয় তাঁর সংগ্রহশালা তৈরির স্বপ্ন।
আরও পড়ুন- প্রেমেন্দ্র মিত্রের কথায় সুর দিয়েছেন শচীন থেকে সুধীন, তবু অন্তরালেই গীতিকার
দীর্ঘ ৩৪ বছর ধরে তিনি প্রত্নবস্তু সংগ্রহের কাজ করছেন। নিজের বাড়িকেই তিনি সংগ্রহশালায় রূপান্তরিত করেছেন। নাম দিয়েছেন “গোবর্ধনপুর সুন্দরবন প্রত্ন সংগ্রহশালা।” এই সংগ্রহশালা রক্ষণাবেক্ষণ করেন তিনি ও তাঁর স্ত্রী। ধীরে ধীরে তাঁর সংগ্রহশালায় যুক্ত হয়েছে দশ হাজারেরও বেশি প্রত্নবস্তু। জরাজীর্ণ বাড়িতে থরে থরে সাজানো রয়েছে হাজার হাজার বছরের পুরোনো অমূল্য সম্পদ। মৌর্য, গুপ্ত, কুষাণ যুগের বিভিন্ন ধরনের ভাস্কর্য, পাথরের ব্যবহারিক দ্রব্য, পাথরের হাতিয়ার, নানা আকারের ভাঙা আসবাবপত্র, টেরাকোটার দ্রব্য, শত শত নানা ধরনের মূর্তি, মূর্তির ভাঙা অংশ রয়েছে সংগ্রহে। বিভিন্ন হাতিয়ার, পোড়ামাটির বস্তু, সুন্দরবনের বিভিন্ন প্রাণীর হাড়ের সংগ্রহ- সবই তিনি উদ্ধার করেছেন সাগর থেকে।
এই সংগ্রহশালা ঘুরে দেখার জন্য তিনি কোনও অর্থ নেননা। নদী ও সমুদ্রে মাছ ধরে যেটুকু অর্থ উপার্জন হয় তার সবটুকু দিয়েই এই সংগ্রহশালা তৈরি হয়েছে। ইতিমধ্যেই ভারত সরকার পুরাতাত্ত্বিক বিভাগের স্মারক দিয়ে সম্মানিত করেছে তাঁকে। বর্তমানে চরম আর্থিক দুরবস্থার মধ্যেই দিন কাটছে বিশ্বজিৎ সাহুর পরিবারের। স্ত্রী, এক ছেলে, এক মেয়ের সংসার টানতে কলকাতায় পরিযায়ী শ্রমিকের কাজ করে সেই পয়সায় কোনওরকমে চলছে সংসার। বিভিন্ন রোগব্যাধিও বাসা বেঁধেছে শরীরে।
আরও পড়ুন- Karim’s vs Kareem’s: এ বলে আমায় দেখ, ও বলে আমায়! পুজোয় কোথায় কোন বিরিয়ানি সেরা?
বিশ্বজিৎ জানান, বিশ্বের দরবারে সুন্দরবনের ইতিহাসকে তুলে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। কিন্তু অর্থের অভাবে এই সংগ্রহশালার রক্ষণাবেক্ষণের অভাব দেখা দিয়েছে। ভারতের অ্যান্টিক ও শিল্প নিদর্শন আইন ১৯৭২-অনুযায়ী, কোনও প্রাচীন নিদর্শন ব্যক্তিগত সংগ্রহে রাখা যায় না। এর জন্য প্রয়োজন এএসআইয়ের বিশেষ অনুমতির। প্রয়োজন সংগ্রহের সুবিন্যস্ত তালিকা ও সংরক্ষণের নির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুসরণ। যা সম্ভবই নয় বিশ্বজিৎ সাহুর পক্ষে। তাই সরকারি অথবা বেসরকারি সহযোগিতায় এই সংগ্রহশালা রক্ষণাবেক্ষণ করা হলে তাঁর স্বপ্ন সার্থক হবে।