আজও দু'চাকাতেই গড়াচ্ছে দেশ, গরিব ভারত ভোটে জেতাল স্কুটারকে
National Family Health Survey: ২০২২ সালের 'ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভে' অনুসারে, ৮ শতাংশ ভারতীয় পরিবারের নিজস্ব চারচাকা গাড়ি রয়েছে।
অভিভাবকরা বলতেন, 'লেখাপড়া করে যে, গাড়িঘোড়া চড়ে সে'। কিন্তু সেই স্বপ্নপূরণে ব্যর্থ অধিকাংশ ভারতীয় নাগরিকই। ১৩৯ কোটির জনসংখ্যার দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ কোনও রকমে কষ্টেসৃষ্টে দিনযাপন করছেন। চারচাকার মালিক হওয়ার স্বপ্ন ওঁদের কাছে আদার ব্যাপারী হয়ে জাহাজের স্বপ্ন দেখার মতোই।
২০২২ সালের 'ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভে' অনুসারে, ৮ শতাংশ ভারতীয় পরিবারের নিজস্ব চারচাকা গাড়ি রয়েছে। ৫০ শতাংশ বেশি ভারতীয় নাগরিকের ভরসা মোটরসাইকেল, স্কুটার কিংবা স্রেফ সাইকেল। এঁরা পর্যাপ্ত লেখাপড়া না করাতেই চারচাকা যানের মালিক হতে পারলেন কি না, সেই তথ্য যদিও সমীক্ষায় নেই।
তবে 'ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভে'-র সমীক্ষায় একথাও জানা গিয়েছে, ভারতীয় নাগরিকদের মাথাপিছু বার্ষিক আয় ২ হাজার ডলারের কম। এদিকে একটি মারুতি অল্টোর দাম ৫ হাজার থেকে ৬ হাজার ডলার। ফলে চারচাকা কেনাটা অধিকাংশ ভারতীয় নাগরিকের কাছে হু হু করে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যবৃদ্ধির বাজারে আকাশকুসুম স্বপ্নই থেকে গিয়েছে।
আরও পড়ুন: রাজনীতিতে ভরসা নেই যুবসমাজের, বিস্ফোরক তথ্য উঠে এল সমীক্ষায়
অন্যদিকে, মোটরবাইক, স্কুটার যাঁরা ব্যবহার করেন, পেট্রোল-ডিজেলের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধির ফলে তাঁদের পক্ষেও চারচাকায় উন্নীত হওয়া সম্ভব হচ্ছে না। কারণ চারচাকা ব্যবহার করলে বাইক অথবা স্কুটারের চেয়ে জ্বালানির খরচ পড়বেল বেশ খানিকটা বেশি।
গত কয়েক দশকে ভারতীয় পরিবারগুলিতে চারচাকা গাড়ি, মোটরবাইক-স্কুটার ব্যবহারের হার কেন্দ্রীয় সরকারের পেশ করা পরিসংখ্যান অনুযায়ী অনেকই বেড়েছে। যেমন, ১৯৯৮-৯৯ সালে মোটে ১ দশমিক ৬ শতাংশ ভারতীয় পরিবারের নিজস্ব চারচাকা গাড়ি ছিল। তবে সেই সময়ে চারচাকা গাড়ির হরেক মডেলও বাজারে আসেনি। তাছাড়া চারচাকা গাড়ি কেনার জন্যে ব্যাঙ্ক ঋণের সুবিধাও এখনকার মতো সহজলভ্য ছিল না।
পরে এই সম্পর্কিত সুযোগ-সুবিধা বেড়েছে নতুন যুগের তালে তাল মিলিয়ে। চারচাকা গাড়ি কেনার জন্যে ব্যাঙ্কঋণও সহজলভ্য হয়েছে। এছাড়া বিজ্ঞাপনের দৌলতে নিত্যনতুন গাড়ির মডেল চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে। ফলে চারচাকা গাড়ির ক্রেতা বেড়েছে। যদি এখনও মোটে ৮ শতাংশ ভারতীয় পরিবারের নিজস্ব চারচাকা গাড়ি রয়েছে। বাকিরা গাড়ি কিনতে পারেননি, বলাবাহুল্য আর্থিক সংগতিটা না থাকায়।
'ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভে'-র ওই রিপোর্ট অনুসারে, ২০০৫-২০০৬ সাল থেকে ভারতে চারচাকা গাড়িওয়ালা নাগরিকের সংখ্যা বেড়েছে। ২০০৫-২০০৬ সালে ভারতে নিজস্ব চারচাকা গাড়িওয়ালা নাগরিকের হার ছিল ২ দশমিক ৮ শতাংশ। আর তখন ৫৬ শতাংশের বেশি ভারতীয় পরিবারের চলাচলের বাহন হিসেবে সাইকেলই ছিল ভরসা।
'ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভে'-র প্রকাশিত রিপোর্ট অনুসারে, চারচাকা গাড়ি ব্যবহার করেন যে পরিবারগুলো এঁদের ভিতর ১৪ শতাংশই শহরের বাসিন্দা। চারচাকা গাড়ির মালিকদের ভিতর মাত্র ৪ শতাংশ গ্রামাঞ্চলের বাসিন্দা।
এছাড়া নীতি আয়োগ জানিয়েছে, বিশ্বের কিছু উন্নত দেশের তুলনায় চারচাকা গাড়ির মালিকানাধীনের ক্ষেত্রে ভারতের অবস্থান বর্তমানে ঠিক কোন পর্যায়ে। যেমন, প্রতি এক হাজার ভারতবাসীর মধ্যে ২২জনের নিজস্ব মালিকানার একটি চারচাকা গাড়ি রয়েছে। অন্যদিকে, জাপান, কানাডা ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এর হার কয়েক গুণ বেশি। যদিও ১৯৯৮ সাল থেকে ভারতের বাজারে মোটরবাইক, স্কুটারের বিক্রি পরিমাণে বাড়ছে।
সমীক্ষা অনুসারে, মোটে ৮ ভারতীয় পরিবারের নিজস্ব চারচাকা গাড়ি থাকলেও মোটরসাইকেল, স্কুটারের বিক্রি উত্তরোত্তরভাবে বেড়েছে বলা যেতে পারে। এখন ৪৯ শতাংশের বেশি ভারতীয় পরিবারের নিজস্ব মোটরবাইক বা স্কুটার আছে। ২০১৫ সাল নাগাদও এই হার ছিল ৪০ শতাংশের মতো।
দেশের কোন রাজ্যের বাসিন্দারা বাহন হিসেবে চারচাকা গাড়ি ব্যবহার করছেন তা নিয়ে আগ্রহ রয়েছে অনেকেরই। সরকারি সূত্রের খবর, সারা দেশের নিরিখে গোয়াতে চারচাকাধারী সর্বাধিক সংখ্যক মানুষের বসবাস। গোয়ার বাসিন্দাদের মধ্যে ৪৫ শতা্ংশের বেশি পরিবারের নিজস্ব মালিকানাধীন চারচাকা গাড়ি রয়েছে। এছাড়া ৮৬ দশমিক ৭ শতাংশ পরিবারের আছে মোটরবাইক, স্কুটার।
এর ফলে গোয়াতে যে সমস্যা প্রকট হয়েছে, তা হলো লাগাতার চলতে থাকা যানজট। পরিস্থিতি মোকাবিলায় রাজ্য সরকার সম্প্রতি সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যাঁরা নতুন গাড়ি কিনবেন রেজিস্ট্রেশন দেওয়ার ব্যাপারে কড়া নিয়ম-কানুন চালু করা হচ্ছে। গোয়াতে চারচাকা এবং দ্বিচক্রযানের সংখ্যা এতই বেড়েছে যে গাড়িগুলো পার্কিং করার মতো জায়গা মিলছে না। সমস্যা গুরুতর।
গোয়া সরকারের ২০২১-২০২২ সালে 'ইকোনমিক সার্ভে রিপোর্ট' অনুসারে, গোয়ার মোট জনসংখ্যা ১৬ লক্ষ। এদিকে গোয়াতে সরকারিভাবে নথিভুক্ত যানবাহনের সংখ্যা এখন দাঁড়িয়েছে ১৫ লক্ষ ২৭ হাজারে। সহজেই মালুম হওয়ার রাস্তাঘাটে যানজটের জেরে প্রাণান্তকর কী পরিস্থিতি সইতে হচ্ছে নিত্যযাত্রীদের।
সম্প্রতি রাজ্য সরকার যানবাহনের রেজিস্ট্রেশনের ক্ষেত্রে সরকারি নিয়ম-কানুন কঠোর করার সিদ্ধান্ত নিলেও ফিবছর গোয়াতে ৫৭ হাজার যানবাহনের নতুন রেজিস্ট্রি হত।হত। এর মধ্যে ৭০ শতাংশর বেশি আবার মোটরবাইক বা স্কুটার। এছাড়াও ২২ দশমিক ৭৭ শতাংশ ক্ষেত্রে পড়ত জিপ, ট্যাক্সি, ব্যক্তিগত মালিকানাধীন যানবাহন। একটি বাইক বা একটি স্কুটারের মালিক গোয়ার ৮৬ শতাংশর বেশি পরিবার। এদিকে গোয়াতে পথ দুর্ঘটনার সংখ্যা বছর বছর বাড়ছে।
গত বছরের ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভে অনুসারে, চারচাকা গাড়ি মালিকের হিসেবে কেরল দেশের মধ্যে দ্বিতীয় স্থানাধিকারী। কেরলের বাসিন্দা ৪৫ দশমিক ২ শতাংশ পরিবারের চারচাকা গাড়ি রয়েছে। এছাড়া কেরলের ৫৮ দশমিক ২ শতাংশ পরিবারে নিজস্ব মোটরবাইক কিংবা স্কুটার রয়েছে।
অবাক করার মতো তথ্য এই যে, যানবাহনের মালিকানার নিরিখে দেশের মধ্যে তৃতীয় স্থানাধিকারী রাজ্যের নাম জম্মু-কাশ্মীর। জম্মু-কাশ্মীরে ২৩ দশমিক ৭ শতাংশ পরিবারের নিজস্ব চারচাকা গাড়ি রয়েছে। এছাড়া ৩০ শতাংশের বেশি পরিবারে নিজস্ব মালিকানার একটি মোটরবাইক অথবা একটি স্কুটার আছে।
চারচাকা গাড়ি, মোটরসাইকেল, স্কুটারের মালিকানার নিরিথে এরপরই তালিকায় ক্রমানুসারে নাম হিমাচল প্রদেশ, পাঞ্জাব, নাগাল্যান্ড, সিকিম, দিল্লি, অরুণাচল প্রদেশ, মণিপুর, মিজোরাম, হরিয়ানা, মেঘালয়, উত্তরাখণ্ড, গুজরাত, কর্নাটক, মহারাষ্ট্র, রাজস্থান, তামিলনাড়ু, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, তেলেঙ্গানা, ত্রিপুরা, ছত্তিশগড়, ঝাড়খণ্ড, অন্ধ্রপ্রদেশের।
এছাড়া একেবারে শেষ স্থানাধিকারী রাজ্য হলো বিহার। তারপর উড়িষ্যা এবং পশ্চিমঙ্গের স্থান এই তালিকায়। বাংলায় মোটে ২ দশমিক ৮ শতাংশ পরিবারের চারচাকা নিজস্ব গাড়ি রয়েছে। ২৮ দশমিক ৫ শতাংশ পরিবারে বাহন হিসেবে আছে একটি মোটরবাইক অথবা একটি স্কুটার।