জনপ্রিয়তায় ছেদ! ইটালি-সহ একাধিক দেশে কেন নিষিদ্ধ চ্যাটজিপিটি?
ChatGPT Ban: বছর না ঘুরতেই চ্যাটজিপিটির বিপুল জনপ্রিয়তায় ছেদ! এরই মধ্যেই নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হল প্রথম বিশ্বের একাধিক দেশে।
বিশ্বকাপ ফুটবলের দুনিয়ায় ২০২২ সালটা যদি আর্জেন্তিনার হয়, তাহলে প্রযুক্তির দুনিয়ায় নিঃসন্দেহে সালটা চ্যাটজিপিটির। চ্যাটজিপিটি কী? খায় না মাথায় মাখে, এতদিনে এসব সকলেরই জানা। ওপেনএআইয়ের এই জনপ্রিয়তম চ্যাটবট পরিষেবাটি পারে না এমন কাজ নেই। শুধু প্রযুক্তির জগতেই নয়, আধুনিক বিশ্বের সমস্ত হিসেবনিকেশকে কার্যত বদলে দিতে পারে এই চ্যাটজিপিটি। অস্বীকার করার জায়গা নেই, জমানাটাই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার। আর সেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দুনিয়ায় চ্যাটজিপিটি অবশ্যই শো স্টপার।
মাত্র কয়েকদিনের মাথায় দশ লক্ষ ব্যবহারকারী, মাস তিনেক কাটতে না কাটতেই সেই সংখ্যা বেড়ে দশগুণ। চ্যাটজিপিটি মহাগুণী। সে পারে না, এমন কাজ নেই। ঠিক মতো ব্যবহার করতে পারলে গোটা সভ্যতার নকশাই বদলে দিতে পারে এই চ্যাটবট পরিষেবা। কিন্তু বছর না ঘুরতেই চ্যাটজিপিটির বিপুল জনপ্রিয়তায় ছেদ! এরই মধ্যেই নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হল প্রথম বিশ্বের একাধিক দেশে। চ্যাটজিপিটি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে উত্তর কোরিয়া, ইরান, রাশিয়া, চিন-সহ একাধিক রাষ্ট্রও।
আরও পড়ুন: ভারতীয়দের তথ্য হাতিয়ে চড়া দামে বিক্রি! কোন ‘ষড়যন্ত্রের’ আভাস দিচ্ছে চ্যাটজিপিটি?
কিন্তু কেন? গোড়া থেকেই চ্যাটজিপিটির কার্যকারিতা নিয়ে সন্দেহের শেষ ছিল না বিশেষজ্ঞদের একটি মহলের। কেউ বলেছিলেন, অদূর ভবিষ্যতে বহু মানুষেরই চাকরি খেতে চলেছে ওপেনএআইয়ের এই চ্যাটবট পরিষেবা। কেউ বা বলেছেন, মানুষের সৃষ্টিশীলতাকে সম্পূ্র্ণ রূপে নষ্ট করে দিতে চলেছে এটি। চ্যাটজিপিটির মতো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে কাজে লাগিয়ে চলবে দেদার কুম্ভীলকবৃত্তি। পড়াশোনা থেকে হোমওয়ার্ক, সমস্ত ক্ষেত্রে চ্যাটজিপিটিকে কাজে লাগিয়ে দেদার ফাঁকি মারবে পড়ুয়ারা, সেই আশঙ্কাও একেবারে ঝেড়ে ফেলতে পারেননি অভিজ্ঞমহল।
তবে এ সব আশঙ্কার পাশাপাশি ভয়াবহ রূপে দেখা দেয় অন্য এক ধরনের শঙ্কা। খুব বেশি দিন আগের কথা নয়। হঠাৎ করেই জানা যায়, প্রায় ১ লক্ষ চ্যাটজিপিটি ব্যবহারকারীর অ্যাকাউন্ট হ্যাক হয়েছে, এবং সেসব চড়া দামে দেদার বিকিয়েছে ডার্ক ওয়েবে। আসলে কোথায় ব্যবহার হতে চলেছে এক লক্ষ ইউজারের সেসব গোপন তথ্য? বড় কোনও ষড়যন্ত্র, বড় কোনও নাশকতার ছক কষা হচ্ছে না তো সেসব দিয়ে! স্বাভাবিক ভাবেই উঠে গিয়েছিল প্রশ্ন। ওপেনএআইয়ের তরফে গোড়াতেই দাবি করা হয়েছিল, তাদের এই চ্যাটবট পরিষেবাতে হ্যাকার-হানা প্রায় অসম্ভব। তবু হ্যাকার এসেছে, সদর্পে ইউজার তথ্য হাতিয়ে পালিয়েছে তারা। শুধু হাতিয়েই পালাইনি, সেসব ডার্ক ওয়েবে বিক্রি হয়েছে দেদার দামেও।
স্বাভাবিক ভাবেই এই ঘটনার পর চ্যাটজিপিটির নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে একাধিক দেশ। আর তার অঙ্গ হিসেবেই সম্প্রতি ইটালিতে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে এই চ্যাটবট পরিষেবাটিকে। ইটালির ডেটা প্রোটেকশন অথোরিটি গ্যারান্টে চ্যাটজিপিটির বিষয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে। এমনকী তারা ওপেনএআইকে এ ব্যাপারে সাফ জানিয়েও দিয়েছে। ইটালীয় ইউজারদের সমস্ত রকম ডেটা প্রসেসিংয়ের উপর নিষেধাজ্ঞা জানিয়েছে গ্যারান্টে। তারা সম্প্রতি জানতে পারে, চ্যাটজিপিটি ব্যবহারকারীরা একে অন্যের চ্যাটবট কথপোকথনের শিরোনাম দেখতে পারে। আর সে ব্যাপারটি নিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করেছে ইটালীয় সংস্থাটি। ইতিমধ্যেই বিষয়টি নিয়ে তদন্তও শুরু হয়েছে। ২০ দিনের মধ্যে সমস্যা সমাধান না-করতে পারলে ১৮০ কোটি টাকা জরিমানা দিতে হতে পারে ওপেনএআই-কে। কিংবা দিতে হতে পারে সারা বছরের আয়ের ৪ শতাংশ। যে অঙ্কটাও স্বাভাবিক ভাবেই কিছু কম চমকপ্রদ নয়।
গোড়া থেকেই গোপনীয়তা প্রসঙ্গে প্রচুর কথাবার্তা বলেছিল সান ফ্রান্সিসকোর এই সংস্থাটি। তবে কিছুটা পথ হাঁটতে না হাঁটতেই নিরাপত্তা নিয়ে একের পর এক হোঁচট খেয়েছে চ্যাটজিপিটি। আরও উন্নত ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল, আরও ভালো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সত্ত্বেও তাই প্রবল জনপ্রিয়তার সিংহাসন থেকে ধীরে ধীরে পড়ছে চ্যাটবটটি। এদিকে তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা থেকে শুরু করে বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রেই কার্যত অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে চ্যাটজিপিটি। কিন্তু তার ভিতরেই সুরক্ষা সংক্রান্ত কাঁটায় জেরবার ওপেনএআইয়ের এই জনপ্রিয়তম পরিষেবাটি।
যদিও প্রতিবারের মতোই ইটালির নিরাপত্তা সংস্থার তোলা প্রশ্নের উত্তরও কার্যত একই ঢঙে দিয়েছে চ্যাটজিপিটি। তারা জানিয়ে দিয়েছে, আরও ভালো ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল তৈরি, আরও ভালো বোঝার ক্ষমতা আয়ত্ত করার জন্যই ইউজারদের ওই ডেটা সংগ্রহ করা হচ্ছিল। পাশাপাশি চ্যাটজিপিটি ব্যবহারের ক্ষেত্রে কোনও বয়সমাত্রা নির্দিষ্ট করা নেই, এ ব্যপারটি নিয়েও আপত্তি রয়েছে গ্যারান্টেদের। তাদের দাবি, বয়স জানানোর ঠিকঠাক জায়গা না থাকায় বহু ক্ষেত্রেই উত্তর সঠিক হওয়া কঠিন হয়ে যায়। আর ইউজারদের নির্ভুল উত্তর পৌঁছে দেওয়ার কাজ ফাঁকি থেকে যায় অনেকটাই।
শুধু ইটালিই নয়, একাধিক দেশ চ্যাটজিপিটি ব্যবহার নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সেই তালিকা দীর্ঘ। রয়েছে চিন, উত্তর কোরিয়া, রাশিয়া, ইরান-সহ অনেকেই। চ্যাটজিপিটির বিরুদ্ধে ভুয়ো তথ্য ছড়ানো ও চিনকে আন্তর্জাতিক মহলে বদনাম করার চেষ্টার অভিযোগ করা হয়েছে। এমনকী আমেরিকা চিন দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কেও বাধ সাধার চেষ্টা করেছে চ্যাটজিপিটি, এমনই দাবি করে চ্যাটজিপিটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে চিন।
একই পথের শরিক রাশিয়া। চ্যাটজিপিটির মতো এআই জেনারেটেড প্ল্যাটফর্মের অপব্যবহার কতটা ক্ষতিকর হতে পারে, সে সম্পর্কে ভালোই জানে মস্কো। ফলে আন্তর্জাতিক মহলে ইউক্রেন যুদ্ধ ঘিরে কোণঠাসা রাশিয়া তাই আর ঝুঁকি নিতে চাইছে না। ইতিমধ্যেই তারা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে চ্যাটজিপিটিকে। অন্য দিকে, একই ঘটনা ইরানেও। এমনিতেই জনগণের ইন্টারনেট ব্যবহার, বিভিন্ন ওয়েবসাইটে আনাগোনা-সহ একাধিক ব্যপার নিয়ন্ত্রণ করে ইরানের রক্ষণশীল সরকার। এদিকে আবার প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানের সঙ্গে নিউক্লিয়ার চুক্তি থেকে সরে আসার পর আরও অবনতি হতে দু'দেশের সম্পর্কের। স্বাভাবিক ভাবেই মার্কিন এই চ্যাটবট পরিষেবাটি মিলবে না ইরানে।
উত্তর কোরিয়ার ক্ষেত্রেও ব্যাপারটি আরও এক ধাপ এগিয়ে। সেখানে ইন্টারনেট ব্যবহারের মতো একাধিক বিষয় নিয়ে আপত্তি রয়েছে সেখানকার স্বৈরাচারী রাজা কিম জং উনের। ফলে সেখানে যে চ্যাটজিপিটি ব্যবহারও নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হবে, তাতে আর আশ্চর্য কী! শুধু উত্তর কোরিয়া নয়, সিরিয়া, কিউবা-র মতো আরও বেশ কিছু দেশে নিষিদ্ধ এই চ্যাটবট পরিষেবা।
আরও পড়ুন: এবার ছবিতেও চলবে কথা, হুবহু মানুষের মতোই হয়ে উঠছে চ্যাটজিপিটির নতুন মডেল?
সব মিলিয়ে জন্মলগ্নে যে আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তার মুখোমুখি হয়েছিল চ্যাটজিপিটি, তাতে কোথাও না কোথাও ছেদ তো পড়েছেই। রাশিয়া, ইটালির মতো প্রযুক্তি ও শিল্পে এগিয়ে থাকা প্রথম বিশ্বের দেশগুলো যেভাবে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে এই চ্যাটবট পরিষেবার দিক থেকে, তা ওপেনএআইয়ের জন্য যথেষ্ট দুশ্চিন্তার তো বটেই। পাশাপাশি সামগ্রিক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অস্তিত্বের উপরেই কড়া সওয়াল বলা যেতে পারে এই নিষেধাজ্ঞা। আদৌ কি সমস্ত নিষেধের বেড়াজাল কাটিয়ে নিজমূর্তিতে ফিরতে পারবে চ্যাটজিপিটি? নাকি একটু হেঁটেই ফুরোবে সুপার স্মার্ট প্রযুক্তির রাস্তা? সেটাই এখন দেখার।