মেশিন লার্নিং! কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে ধারালো করার যে আবিষ্কারে নোবেল জয় বিজ্ঞানীদের
Nobel Physics Prize 2024: একটি যন্ত্রের যদি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তৈরি করতে হয়, তাকে যদি নতুন তথ্য জুগিয়ে কিছু শেখাতে হয়, সেক্ষেত্রে একটি যন্ত্রেরও কিন্তু আমাদের মতো নিউরাল নেটওয়ার্ক দরকার
২০২৪ সালে পদার্থবিদ্যায় নোবেল পেলেন প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির জন হপফিল্ড এবং ইউনিভার্সিটি অফ টোরোন্টোর জফ্রি হিনটন। এ বছরের নোবেল পুরস্কার মেশিন লার্নিং নিয়ে। কৃত্রিম নিউরাল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে মেশিন লার্নিং কীভাবে সম্ভব, সেই আবিষ্কার আর দীর্ঘ গবেষণার ফলস্বরূপ নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হলেন ডঃ হপফিল্ড ও হিনটন।
তাঁদের গবেষণার গভীরে যাওয়ার আগে বুঝতে হবে নিউরাল নেটওয়ার্ক কী? আমাদের কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র অর্থাৎ মস্তিষ্ক ও শিরদাঁড়ায় রয়েছে কোটি কোটি নিউরোন বা নার্ভকোশ। এই নিউরোনগুলি ছড়িয়ে পড়েছে আমাদের সারা শরীর জুড়ে। আমাদের বুদ্ধিমত্তা, নতুন কিছু শেখা, ভাবনাচিন্তা, দৈনন্দিন নানা জটিলতার সমাধান, মানুষের ভাষাকে বোঝা, সেই ভাষায় নিজের ভাবপ্রকাশ করা, সব কিছুর পেছনে এই নিউরোনগুলির ভূমিকা অপরিহার্য। তাছাড়া আমরা নতুন কিছু কীভাবে শিখি, কীভাবে তা শিখে বাস্তবে প্রয়োগ করি এবং যা শিখলাম তা দীর্ঘদিন অবধি মনে রাখতে পারি – এই পুরো পদ্ধতিটাই খুব অবাক করার মতো। এই সবটার পেছনেই কিন্তু নিউরোনের হাত
রয়েছে। নিউরোনগুলি কিন্তু একা কাজ করে না। একটা জটিল কাজকে সুষ্ঠভাবে সারতে যেমন অনেক মানুষের সাহায্য দরকার, তাদের সঙ্গে একটা ‘নেটওয়ার্ক’ তৈরি করা দরকার, ঠিক সেরকমই নেটওয়ার্ক তৈরি করে আমাদের নিউরোন। একে বলে নিউরাল নেটওয়ার্ক।
এখন একটি যন্ত্রের যদি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তৈরি করতে হয়, তাকে যদি নতুন তথ্য জুগিয়ে কিছু শেখাতে হয়, সেক্ষেত্রে একটি যন্ত্রেরও কিন্তু আমাদের মতো নিউরাল নেটওয়ার্ক দরকার। তবে অবশ্যই সেটা কৃত্রিমভাবেই বানানো। কিন্তু মস্তিষ্ক, বিশেষ করে করে আমাদের নিউরাল নেটওয়ার্ক কীভাবে কাজ করে, তার অনেকটাই এখনও অজানা। এখনও এই নিয়ে নিরন্তর গবেষণা চালাচ্ছেন নিউরো এবং কগনিটিভ সায়েন্টিস্টরা। স্বাভাবিকভাবেই একটি যন্ত্রের ভেতরকার কৃত্রিম নিউরাল নেটওয়ার্ক কেমনভাবে তৈরি করা দরকার, সে নিয়ে রহস্যের অন্ত ছিল না।
আরও পড়ুন- বিতাড়িত হয়েছিলেন কর্মক্ষেত্র থেকে, যে আবিষ্কার নোবেল এনে দিল এই বিজ্ঞানীকে
বিজ্ঞানীরা যে কৃত্রিম এই নিউরাল নেটওয়ার্ক বানিয়েছেন, তা মানুষের নিউরাল নেটওয়ার্ক দেখে অনুপ্রাণিত হয়েই। ডঃ হপফিল্ড ও হিনটন এই নেটওয়ার্ক বানাতে সংখ্যাতাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যা বা স্ট্যাটিসটিক্যাল ফিজিক্সের শরণাপন্ন হয়েছিলেন। যার সাহায্যে তাঁরা এমন একটি কৃত্রিম নিউরাল নেটওয়ার্ক বানালেন, যা অ্যাসোসিয়েটিভ মেমোরি হিসেবে কাজ করবে।
অ্যাসোসিয়েটিভ মেমোরি কী? নানারকম জিনিস বা বিষয়ের মধ্যে যে জটিল, পারস্পরিক সম্পর্ক রয়েছে, যেমন ধরুন, বৃষ্টি শব্দটা বললেই যে শব্দগুলো কানে ভেসে উঠবে, যে গন্ধটা কয়েক মুহূর্তের জন্য হলেও মনে করতে পারবেন কিংবা বৃষ্টির সঙ্গে জড়িয়ে থাকা যে স্মৃতি সেগুলো যেভাবে মনের পর্দায় ভাসবে, এই পুরোটাকেই সহজভাবে অ্যাসোসিয়েটিভ মেমোরি বলা যেতে পারে।
ডঃ হপফিল্ড এভাবেই ১৯৮২ সালে যন্ত্রের মধ্যে অ্যাসোসিয়েটিভ মেমোরি তৈরি করেছিলেন কৃত্রিম নিউরাল নেটওয়ার্ককে কাজে লাগিয়ে। তিনি এই নেটওয়ার্কের নাম দিয়েছিলেন ‘হপফিল্ড নেটওয়ার্ক’। বিজ্ঞানীরা যন্ত্রের ক্ষেত্রে এই নেটওয়ার্ক তৈরি করেন ‘নোড’ দিয়ে। এখানে আমরা যন্ত্রের নোডকে দু'টি নিউরোনের সংযোগস্থলের সঙ্গে তুলনা করতে পারি। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ক্ষেত্রে ‘নোড’-কে
দু'টি সংখ্যা দিয়েই বোঝানো হয় – একটি সংখ্যা হল এক, আর দ্বিতীয়টি শূন্য। বিজ্ঞানীরা যন্ত্রের এই স্মৃতির মধ্যে এনার্জি অর্থাৎ শক্তিকেও কাজে লাগাতে পেরেছিলেন। যা কাজে লাগিয়ে একটি যন্ত্র, তার মধ্যে সঞ্চিত হওয়া কোটি কোটি ডেটা থেকে একটি ধাঁচ বা ‘প্যাটার্ন’ খুঁজে নিতে পারে।
মানুষ যেমন প্রকৃতির মধ্যে, আলপনার মধ্যে, গানের মধ্যে কিংবা মানুষের মধ্যে একটা ‘প্যাটার্ন’ বা ধাঁচ খুঁজে বেড়ায়। আশেপাশে নানা জিনিসে কিছু বৈশিষ্ট্য খুঁজে পেলেই, মানুষ তার বুদ্ধিমত্তা দিয়ে বুঝে ফেলে সেই জিনিসটির ধাঁচ কীরকম হতে পারে, ঠিক তেমনই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন একটি যন্ত্রকে, কোটি কোটি ডেটা দিলে সে-ও সেখানে একটা প্যাটার্ন বা ধাঁচ খোঁজার চেষ্টা করে এবং সেই ডেটাকে ছানবিন করে ধীরে ধীরে বুঝতে পারে সেখান থেকে কী গল্প বা ঘটনা তৈরি হতে পারে, বা ঘটনাপ্রবাহ কোন দিকে যেতে পারে।
আমাদের প্রত্যেকটি কাজের নেপথ্যে রয়েছে একাধিক নিউরাল নেটওয়ার্ক। ধরুন, আপনি পিয়ানো বাজান, তার নেপথ্যে রয়েছে একটি নিউরাল নেটওয়ার্ক। আপনি যত বেশি অনুশীলন করবেন, তত পারদর্শী হয়ে উঠবেন। আপনার পারদর্শিতার কারণ এই নিউরাল নেটওয়ার্কের আরও শক্তিশালী, আরও বিস্তৃত হয়ে ওঠা এবং সেখানে আরও অনেক নতুন নার্ভকোশের জন্ম নেওয়া।
কিন্তু যন্ত্রের নিউরাল নেটওয়ার্কে তো আর নতুন নার্ভকোশ তৈরি হবে না। তাহলে তাদের নেটওয়ার্ককে কীভাবে আরও শক্তিশালী করে তোলা যায়? এক্ষেত্রে মনস্তত্ত্ববিদ ডোনাল্ড হেবের টেনিং হাইপোথেসিসকে কাজে লাগানো হয়েছে। সেই হাইপোথিসিস আজও কাজে লাগিয়ে যন্ত্রকে ট্রেনিং অর্থাৎ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। ফলে যন্ত্রটি সহজে অসম্পূর্ণ কিছু ডেটা থেকে বুঝে যায় ঘটনাপ্রবাহ কী হতে চলেছে। যন্ত্র আসলে তার মধ্যে সঞ্চিত রাখা সমস্ত তথ্য থেকে একটা প্যাটার্ন বা ধাঁচ খুঁজে নিতে শিখেছে। তাই প্রশিক্ষণ পাওয়া একটি নেটওয়ার্কের কাছে অসম্পূর্ণ একটি তথ্যের ভাণ্ডার বা একটি অসম্পূর্ণ ধাঁচ এনে হাজির করলেই, সে ধীরে ধীরে নিজের ‘মেমোরি’ থেকে একইরকম একটি ধাঁচ খুঁজে নেয়। এই ‘মেমোরি’ সে লাভ করেছে তাকে বারেবারে দেওয়া ট্রেনিংয়ের ফলে।
যন্ত্রের এই প্যাটার্ন খোঁজার সঙ্গে বিপুলভাবে এনার্জি বা শক্তির সম্পর্ক রয়েছে। পাহাড়ের উঁচুতে একটা বল রাখলে, সেই বল নীচে গড়িয়ে যেতে থাকে এবং ততক্ষণ অবধি থামে না, যতক্ষণ সে একটা গর্তে গিয়ে পড়ছে। পাহাড়ের উঁচু জায়গাটাকে ধরা যাক বেশি এনার্জি, আর
নিচুর দিকের গর্তটিকে কল্পনা করা যাক কম এনার্জির সঙ্গে। আর ধরে নেওয়া যাক, এই বলটা আসলে অসম্পূর্ণ কিছু ডেটা কিংবা একটি আধাখেঁচড়া প্যাটার্ন। হপফিল্ড দেখলেন, কৃত্রিম নিউরাল নেটওয়ার্কও বেশি থেকে কম এনার্জির দিকে যেতে যেতে একটা সম্পূর্ণ প্যাটার্ন খুঁজে নেয়।
আরও পড়ুন- জিনঘটিত রোগের মুশকিল আসান! যে আবিষ্কার নোবেল এনে দিল বিজ্ঞানীদের
মানুষের নিউরাল নেটওয়ার্কের গঠনের যেমন অনেকগুলো স্তর আছে, তেমনই তাদের কার্যগত স্তরও রয়েছে অনেকগুলো। ১৯৮৩ থেকে ১৯৮৫ সাল নাগাদ ডঃ হিনটন বোঝার চেষ্টা করছিলেন কৃত্রিম নিউরাল নেটওয়ার্কের যে স্তরগুলিকে বা নোডগুলিকে আমরা দেখতে পাই না বাইরে থেকে, তারা কীভাবে কাজ করছে। তিনি তখন সংখ্যাতত্ত্ব প্রয়োগ করে বুঝতে চেষ্টা করছিলেন কৃত্রিম নিউরাল নেটওয়ার্ক কীরকম প্যাটার্ন খুঁজে পেতে পারে। আমাদের চারপাশে তো রকমারি প্যাটার্ন দেখা যায়। কৃত্রিম নিউরাল নেটওয়ার্কেও কি তাই? সেই উত্তরের সন্ধানে ছিলেন হিনটন। তিনি পাশাপাশি তৈরি করলেন ‘জেনারেটিভ মডেল'। যাতে কৃত্রিম নিউরাল নেটওয়ার্ককে বারেবারে প্রশিক্ষণ দিলে, সে নিজেই লক্ষ লক্ষ নতুন ডেটা থেকে নানারকম প্যাটার্ন বা ধাঁচ তৈরি করতে পারবে।
হিনটন অনুকরণ করলেন বোলৎজম্যান ডিস্ট্রিবিউশন মডেলের। সেই মডেলকে অনুসরণ করে তিনি বানান বোলৎজম্যান মেশিন। এই মেশিনে কিছু দৃশ্যমান নোডের পাশাপাশি, অনেক অদৃশ্যমান নোডও রয়েছে। অদৃশ্যমান নোড মেশিন লার্নিংয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিন্তু হিনটনের তৈরি বোলৎজম্যান মেশিনের দু'টি মাত্র স্তর। সেখানে দৃশ্যমান নোড দিয়ে তৈরি একটি স্তরে তথ্য জোগান দেওয়া হয় এবং সেই তথ্যকেই পড়া হয়।
হিনটনের তৈরি বোলৎজম্যান মেশিনের কিছু প্রযুক্তিগত ত্রুটি ছিল। তাই এই মেশিনকেই একটু অদল-বদল করে হিনটন বানান রেস্ট্রিকটেড বোলৎজম্যান মেশিন। মজার বিষয় হল, একই লেয়ারে থাকা নোডগুলির মধ্যে কোনও যোগাযোগ নেই। এই মেশিন কাজ করে অনেকটা শৃঙ্খলের মতো। প্রথম তৈরি রেস্ট্রিকটেড বোলৎজম্যান মেশিনকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার পরে, এর লুকিয়ে থাকা অদৃশ্যমান নোডগুলিকে ব্যবহার করা হয়েছিল পরবর্তী মেশিনকে প্রশিক্ষণ দিতে।
বর্তমান সময়ে একাধিক মেশিন লার্নিং মডেল ‘ফীডফরওয়ার্ড নেটওয়ার্ক’-কে অনুসরণ করে, যেখানে তথ্য ‘ইনপুট’ থেকে ‘আউটপুটের’ দিকে ধেয়ে যায়। কিন্তু এই ‘ইনপুট’ ও ‘আউটপুটের’ মাঝেও থাকে অনেক অদৃশ্য নোড, যারা তথ্য সরবরাহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ডঃ হপফিল্ড ও হিনটনের এই আবিষ্কার পদার্থবিদ্যার নানা শাখায় কাজে লাগানো হয়। কাজে লাগানো হয় মানুষের শরীরে রোগ সনাক্ত করার সময়েও। মানুষের মুখ শনাক্তকরণ কিংবা অজানা ভাষাকে নিজের পছন্দের ভাষায় অনুবাদ করার মতো দৈনন্দিন কাজেও অত্যাবশ্যকীয় এই আবিষ্কার।