১০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০ বছরের হিসেব পাঁচ মিনিটে! গুগলের মুশকিল আসান উইলো!
Willow Quantum Chip: ২০২৩ সালে গুগল ‘সিকামোর’ নামক ৫৩ কিউবিটের একটি প্রসেসর তৈরি করে। আর উইলো তো সেখানে ১০৫ কিউবিটের চিপ।
সম্প্রতি মার্কিন তথ্য প্রযুক্তি সংস্থা গুগল প্রকাশ্যে এনেছে উইলো। উইলোর কাজ হলো অভাবনীয় গতিতে জটিল কুটিল সমস্যাগুলির সমাধান করা। কত দ্রুত? তার একটা পরিমাপ গুগল আমাদের দিয়েছে। যে সমস্যাগুলো সাধারণ কম্পিউটারের সমাধান করতে দশ সেপ্টিলিয়ন বছর সময় লাগার কথা ছিল, এই উইলোর দৌলতে পাঁচ মিনিটেই মুশকিল আসান! সেপ্টিলিয়ন বছর মানে ১-এর পিঠে ২৫ টা শূন্য, অর্থাৎ মহাবিশ্বের বয়সের চেয়েও বেশি! ভাবা যায়!
‘উইলো’ আসলে একটি কোয়ান্টাম চিপ, যা কোয়ান্টাম মেকানিক্সের নীতি মেনে কাজ করবে। আমাদের চিরপরিচিত ক্লাসিক্যাল কম্পিউটারে এই চিপ লাগবে না। এটি তৈরিই করা হয়েছে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সুপার কম্পিউটার বা কোয়ান্টাম কম্পিউটারের জন্য। এর জন্য সুপার কম্পিউটারগুলি শুধু দ্রুততম গতিতে কাজ করবে তা নয়, দ্রুততার সাহায্যে কাজ করতে গিয়ে যে ভুলভ্রান্তি হবে তা যতটা সম্ভব কমিয়ে আনাই উইলোর উদ্দেশ্য। কীভাবে? তা বুঝতে গেলে আগে কোয়ান্টাম কম্পিউটার কাজ করে কীভাবে তা জানতে হবে।
স্কুল, কলেজ, অফিস, আদালতে আমরা সচরাচর যে কম্পিউটার ব্যবহার করি তা কাজ করে ‘বিট’ আদানপ্রদানের মাধ্যমে। এই ‘বিট’ হয় ০ বা ১ হতে পারে । ০ মানে হ্যাঁ সূচক নির্দেশ আমরা কম্পিউটারকে দিচ্ছি, আর ১ মানে না সূচক। হয় ‘হ্যাঁ’, নয় ‘না’—যেকোনও একটি ভাষা বোঝে আমাদের পরিচিত ক্লাসিক্যাল কম্পিউটার। ওদিকে কোয়ান্টাম কম্পিউটার কাজ করে কোয়ান্টাম বিট বা ‘কিউবিটের’ মাধ্যমে। এই কিউবিট একইসঙ্গে ০ ও ১ দুটোই হতে পারে। কী মজার না ব্যাপারটা? ফলে কম্পিউটারের কাজ করার গতিও বাড়ছে পাল্লা দিয়ে। কীভাবে? একটা উদাহরণ দিলেই ব্যপারটা বোঝা সহজ হবে। এই যে আমরা কম্পিউটারে কত কিছু ছবি, ভিডিও জমা করে রাখি। ধরা যাক, কোনও ফোল্ডারে আমরা ১০০টি দেশের পতাকার ছবি জমিয়ে রেখেছি। কম্পিউটার সেগুলোকে ০০০১, ০০১০, ০০১১… এইভাবে সাজিয়ে রেখেছে, কারণ ও ০ বা ১ ছাড়া আর কিছু বোঝে না। আমি তার মধ্যে থেকে কম্পিউটারকে ভারতের পতাকা খুঁজতে বললাম। তখন ক্লাসিক্যাল কম্পিউটার একটা একটা ছবি খুঁজতে খুঁজতে যাবে কিন্তু কোয়ান্টাম কম্পিউটার একসঙ্গে অনেকগুলো কিউবিট খুঁজতে থাকে, ফলে মুহূর্তেই তার লক্ষ্যে পৌঁছতে পারে। এই কিউবিট যে একসঙ্গে ০ ও ১ হয়, ব্যাপারটা অনুধাবন করতে গেলে আমাদের কোয়ান্টাম বলবিদ্যার শুরুর দিকে ফিরে যেতে হবে।
আরও পড়ুন- সময়ের উল্টোদিকেও রয়েছে ‘পদার্থ’? যে খোঁজ বদলে দিতে পারে আমাদের সব বোঝাপড়া
ছোটবেলায় পাঠ্যপুস্তকে পরমাণুর গঠন পড়ার সময় দেখেছি ইলেকট্রনগুলো পরমাণুর নিউক্লিয়াসকে কেন্দ্র করে নির্দিষ্ট ব্যাসার্ধের বৃত্তাকার কক্ষপথে ঘুরপাক খায়। বড় হয়ে আমরা জানতে পারি, এটি পুরোপুরি সঠিক নয়। দ্বৈতসত্তার কারণে ইলেকট্রনটি কক্ষপথের যেকোনও জায়গায় থাকতে পারে, তার মানে কোনও ইলেকট্রনের অবস্থান স্পষ্ট করে মাপার আগে পর্যন্ত সেটি কক্ষপথের যেকোনও জায়গায় থাকতে পারে। একটু কঠিন ও সূক্ষভাবে বললে কক্ষপথের যেকোনও জায়গায় ইলেকট্রনটির থাকার সম্ভাবনা সমান। কোয়ান্টাম পদার্থবিদরা এই অবস্থাকে বলেন কোয়ান্টাম সুপারপজিশন। নোবেলজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী রিচার্ড ফাইনম্যান সর্বপ্রথম ১৯৮০ সালে এই ধারণা কম্পিউটারে প্রয়োগ করার ব্যাপারে উদ্যোগী হন ।
এই ব্যাপারটা বোধগম্যের জন্য পদার্থবিজ্ঞানীরা বিখ্যাত ‘ক্যাট এক্সপেরিমেন্টের’ উদাহরণ প্রায়শই দেন। সেখানে বন্ধ ঘরে বিষাক্ত খাবার রেখে একটা বিড়ালকে ছেড়ে দেওয়া হয়। যতক্ষণ দরজা না খোলা হচ্ছে, ততক্ষণ বিড়ালটি জীবিত বা মৃত, যেকোনও অবস্থায় থাকতে পারে। কোয়ান্টাম বলবিদ্যার ভাষায় বিড়ালটি অর্ধেক জীবিত ও অর্ধেক মৃত। অর্থাৎ তার বেঁচে থাকার সম্ভাবনা ৫০%। বিষয়টা খানিক কয়েন টস করার মতো। কয়েনটি শূন্যে ভাসমান অবস্থায় হেড বা টেল দুটোরই সম্ভাবনা সমান। আসলে কোয়ান্টাম বলবিজ্ঞান সম্ভাবনাময়। আর সেই ডানায় ভর করেই কিউবিটগুলো ০, ১, ০১, ১০, ১১ যা খুশি হতে পারে। সেজন্যই লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে কোয়ান্টাম কম্পিউটারগুলির গণনা করার ক্ষমতা। কীভাবে?
ধরা যাক, বাজারে চোর ধরার একটা 'গেম' খেলছি আমরা। শুরুর দিকে প্রথমে দশটা গলিওয়ালা বাজার পেলাম, যেগুলির প্রতিটি এলোমেলো। সাধারণ কম্পিউটার একটা একটা করে গলি চেক করতে করতে যাবে কিন্তু কোয়ান্টাম কম্পিউটার কিউবিটের কল্যাণে নিজের অনেকগুলো ডামি তৈরি করতে সক্ষম, যারা একসঙ্গে খুঁজতে বেরিয়ে যাবে চোর কোন গলিতে আছে? ফলে মুহূর্তেই কেল্লাফতে! সেজন্য বিশ্বের তাবড় তাবড় তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা, যেমন গুগল, মাইক্রোসফট, আইবিএমের মতো সংস্থাগুলি এই কোয়ান্টাম কম্পিউটার তৈরির প্রতিযোগিতায় সামিল। আর অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে তথ্য আদানপ্রদানের জন্য ভুল হওয়ার সম্ভাবনাও প্রচুর। দেখা যায়, কিউবিটের সংখ্যা যত বাড়ে, ভুলের সংখ্যা তত বাড়তে থাকে। গত তিন দশক ধরে এই সমস্যার সঙ্গে লড়াই করে আসছেন বিজ্ঞানীরা। এখানেই জাদুকাঠি নিয়ে হাজির হয়েছে গুগল, বিশ্বের সবচেয়ে বড় তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা। সেই জাদুদণ্ডের নাম ‘উইলো’।
সদ্য প্রকাশিত নেচার পত্রিকায় সেকথা ঘোষণা করেছে গুগল। তাদের ট্যাগ লাইন— ‘বিলো থ্রেশোলড’। কেবল তাত্ত্বিকভাবে নয়, পরীক্ষামূলকভাবে তারা দেখিয়েছে, কিউবিটের সংখ্যা যত বাড়ছে, ভুলের পরিমাণ সেই অনুপাতে কমছে। 3x3, 5x5, 7x7 এনকোডেড গ্রিডের ক্ষেত্রে এই ‘উইলো’ ব্যবহার করে দেখা গেছে ভুলের পরিমাণ কমছে সূচকীয় হারে। সেজন্যই গুগল দাবি করেছে ‘এরর কারেকশন বিলো থ্রেশোলড’।
আরও পড়ুন- মহাবিশ্বে লুকিয়ে থাকা গুপ্ত পদার্থ! কী দিয়ে তৈরি এই ডার্ক ম্যাটার?
এই ‘উইলোর’ ক্ষেত্রে ‘সুপারকন্ডাকটিং কোয়ান্টাম সিস্টেম রিয়েল-টাইম এরর কারেকশন’ প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। অর্থাৎ অতিপরিবাহী দিয়ে তৈরি কোয়ান্টাম সিস্টেমে গণনার সময় কোনও গণ্ডগোল ধরা পড়লে, তা তাৎক্ষণিক সংশোধন করে নেওয়া সম্ভব। শুধু দ্রুত গণনা নয়, দ্রুততার সঙ্গে ভুল সংশোধন না করতে পারলে সিস্টেমে ভুল জমতে জমতে একসময় ভুলের পাহাড় হয়ে যাবে, তখন সিস্টেম মুখ থুবড়ে পড়বে। উইলোর কাছে এটা একটা বিরাট চ্যালেঞ্জ ছিল। সেই আশঙ্কাই ফুটে উঠছিল গুগল কোয়ান্টাম এআই-এর প্রতিষ্ঠাতা নেভিনের কণ্ঠে, "…আপনি যদি ত্রুটিগুলি যথেষ্ট দ্রুত সংশোধন করতে না পারেন তবে এটি সম্পন্ন হওয়ার আগেই তারা আপনার গণনাকে নষ্ট করে দেবে।" সে আশঙ্কা অবশ্য নিমেষে উড়িয়ে দিয়েছে উইলো।
সাধারণত বিশেষ একধরনের সার্কিটে ইলেকট্রন, ফোটন, এইসব সাব অ্যাটমিক পার্টিকেল বসিয়ে কিউবিট তৈরি করা হয়। এক্ষেত্রে বিজ্ঞানীদের খেয়াল রাখতে হয়, কোনওভাবেই যেন সাব অ্যাটমিক পার্টিকেলের সুপারপজিশন ঘেঁটে না যায়। কারণ তাপমাত্রার সামান্য পরিবর্তন হলে বা তড়িৎ চুম্বক ক্ষেত্রের মানের সামান্য পরিবর্তনের কারণে এই সুপারপজিশন দশা নষ্ট হয়ে যেতে পারে। ফলে কিউবিটের সার্কিটটি তৈরির পর এটিকে লিকুইড হিলিয়ামের মাধ্যমে পরমশূন্য তাপমাত্রার নীচে রাখা হয়। সেজন্য নিম্ন তাপমাত্রার পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে সর্বদা কাজ করে চলেছেন গুগলের একদল গবেষক।
কী পরিমাণ তথ্য সংরক্ষণ করতে পারে এই কিউবিট? মাত্র দশটি কিউবিট দিয়ে যে পরিমাণ তথ্য ধরে রাখা যায়, বিট ব্যবহার করলে লাগবে ষোলো হাজার বিট মানে ষোলো হাজার ট্রানজিসটার। ক্লাসিক্যাল কম্পিউটার তো এই ট্রানজিসটার দিয়েই তৈরি। ২০২৩ সালে গুগল ‘সিকামোর’ নামক ৫৩ কিউবিটের একটি প্রসেসর তৈরি করে। আর উইলো তো সেখানে ১০৫ কিউবিটের চিপ। তাহলে কত ডেটার কারবার হবে ভাবা যায়!
আমাদের দৈনন্দিন জীবনের যে সব ক্ষেত্রে অসংখ্য তথ্য বা ডেটা নিয়ে কাজ করতে হয়, বিশেষত আবহাওয়া বিজ্ঞান, মহাকাশ গবেষণা, ড্রাগ অ্যনালিসিস— এসব ক্ষেত্রে ‘উইলো’ অদূর ভবিষ্যতে নতুন আশার আলো নিয়ে আসবে, তথ্য বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলীদের এমনটাই বিশ্বাস।