ডিপসিক: শেয়ার বাজারে মোক্ষম ধস নামাতে সক্ষম! কী এই চিনা এআই?

DeepSeek: যেখানে চ‍্যাটজিপিটির মতো জনপ্রিয় সংস্থা মাসিক ১৭০০ টাকায় তাদের সাবস্ক্রিপশন দিচ্ছে, সেখানে ডিপসিক ব্যবহারের খরচ মাত্র ৪২ টাকা।

সপ্তাহ দুয়েক ধরে তিনটি খবর আন্তর্জাতিক অঙ্গন গরম করে রেখেছে. তিনটিই চিনকেন্দ্রিক খবর। প্রথমত, তাঁদের মহাকাশ বিজ্ঞানীরা তিয়ানগং স্পেস স্টেশনে কৃত্রিম উপায়ে সালোকসংশ্লেষ করতে সক্ষম হয়েছেন এবং এর থেকে উৎপন্ন কার্বন ডাই অক্সাইড এবং জল থেকে তাঁরা অক্সিজেন ও তৈরি করে ফেলেছেন, যেটি মহাকাশযানের জ্বালানি হিসাবে ব্যবহার করা যাবে। দ্বিতীয়ত, তাঁদের নিউক্লিয়ার বিজ্ঞানীরা নিয়ন্ত্রিত সংযোজন বিক্রিয়ার মাধ্যমে প্রায় ১৭ মিনিট পর্যন্ত ১০০ মিলিয়ন সেলসিয়াস তাপমাত্রা ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছেন। শক্তি সমস্যায় জর্জরিত বিশ্ববাসীর কাছে এটা একটা আশার আলো। পরিচ্ছন্ন শক্তির (Clean Energy) দিকে আরও এক ধাপ এগিয়ে গেল বিশ্ব। তবে এই দু'টির কোনওটিই আজকের আলোচ্য নয়। গত কয়েকদিন আমেরিকা তথা বিশ্বের শেয়ারবাজারে ধস নেমেছে। নেপথ্যে ডিপসিক (DeepSeek) নামের হাংঝু-ভিত্তিক এই চিনা স্টার্টআপ। হ্যাঁ, এটিই হারাধনের তিন নম্বর সন্তান। কী করে এই অসাধ্য সাধন হলো?

‘OpenAI’, ‘Google’, এবং অন্যান্য মার্কিন কোম্পানিগুলো যেখানে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করেছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার পিছনে (এমনকী এবছর ট্রিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের সম্ভাবনাও ঘুরপাক খাচ্ছে বাজারে), সেখানে মাত্র ৬ মিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগে তৈরি লিয়াং ওয়েনফেং-এর এই ডিপসিক উন্নত বিশ্বকে বলে বলে গোল দিচ্ছে! ভাবা যায়! এর থাবায় জখম হয়েছে এনভিডিয়ারের মতো মার্কিন কম্পিউটার চিপনির্মাতা প্রতিষ্ঠান। একদিনেই তাদের শেয়ারে ধস নেমেছে প্রায় ১৭ শতাংশ।

আরও পড়ুন- এআই প্রয়োগে বাড়ছে সাইবার ক্রাইম: কতটা বিপদের মুখে আপনি?

বাজারে বিভিন্ন কম দামী জিনিস বোঝাতে "চায়না মাল, বেশি দিন চলবে না", এমন কথা হামেশাই শুনে থাকি আমরা। এই ধারণাটি ভাঙার চেষ্টা করছে চিন। কম খরচেও যে ভালো কিছু তৈরি করা সম্ভব, সেটা চিন ইতিমধ্যেই করে দেখিয়েছে। চিনের দাবি ওপেনএআই, মেটা এবং আলফাবেটের চেয়ে দক্ষতায় কোনও অংশে কম নয় এই চিনা ‘ডিপসিক’।এটি তৈরিতে তারা অন্যদের থেকে তুলনামূলকভাবে কম সংখ্যক মেমোরি কার্ড ব্যবহার করেছে, ফলে উৎপাদন খরচ অনেক কম। যেখানে চ‍্যাটজিপিটির মতো জনপ্রিয় সংস্থা মাসিক ১৭০০ টাকায় তাদের সাবস্ক্রিপশন দিচ্ছে, সেখানে ডিপসিক ব্যবহারের খরচ মাত্র ৪২ টাকা। এনভিডিয়াকে এই ধাক্কা তারা দিতে পেরেছে কারণ মাত্র ২০০০টি এইচ৮০০ মেমোরি কার্ড ব্যাবহার করেছে তারা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মডেলকে প্রশিক্ষণ দিতে। বর্তমান বিশ্বে প্রযুক্তির দুনিয়ায় নিয়ন্ত্রক, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ২০২৩ সালের অক্টোবরের পর থেকে চিনে এই মেমোরি কার্ড রপ্তানি বন্ধ রেখেছে। তা সত্তেও চিন টেক্কা দিয়েছে সিলিকন ভ্যালির দৈত্যদের সঙ্গে।

সাবস্ক্রিপশন ভ্যালু কম বলে কাজ দ্রুত করতে পারছে না, বা ভুল করছে এমনটি নয়, বরং সমানতালে পাল্লা দিচ্ছে চ‍্যাটজিপিটি, গুগল জেমিনির সঙ্গে। উপরন্তু গণিত, রসায়ন, কোডিং, প্রভৃতি গণনা নির্ভর বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় এত দক্ষতার সঙ্গে কাজ করছে ডিপসিক যে অনেক গবেষক ও বিজ্ঞানীরা অভিভূত। গত ২৩ জানুয়ারি, বিশ্ববিখ্যাত নেচার জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রের শিরোনাম, ‘চায়না'জ চিপ ওপেন এআই মডেল, ডিপসিক থ্রিলস সায়েন্টিস্ট’ দেখে সহজেই তা অনুমান করা যায়। সদ্য এর ব্যবহার এতই বেড়েছে যে অ্যাপল অ্যাপ স্টোরে চ্যাটজিপিটিকে পিছনে ফেলে দু'দিনেই পয়লা নম্বরে উঠে এসেছে ডিপসিক।

আরও পড়ুন- AI ২০২৪: কতদূর এগোল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা?

প্রতিযোগিতায় টক্কর দিলেও ডিপসিকের যাত্রা শুরু কোথা থেকে তা কিছুটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে অতি সম্প্রতি এক্স হ্যান্ডেলে এক প্রখ্যাত বাজার বিশেষজ্ঞ কোবেইসির স্ট্যাটাসের লেখা থেকে। তিনি লিখছেন, "ওপেনএআই যাত্রা শুরু করেছিল প্রায় ১০ বছর আগে। তখন তাদের কর্মী ছিল সাড়ে ৪ হাজার। মূলধন জোগাড় হয়েছিল প্রায় ৬৬০ কোটি টাকা। সেখানে ডিপসেক পথচলা শুরু করেছে মাত্র বছর দুয়েক আগে। তাদের কর্মী দুশোর চেয়ে কম"।

বিংশ শতকে সমাজতান্ত্রিক রাশিয়া ও ধনতান্ত্রিক আমেরিকার মধ্যে মহাকাশ দখলের ঠান্ডা লড়াই দেখেছিল বিশ্ববাসী। শুধু মহাকাশই নয়, বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের দ্বৈরথ ছিল দেখার মতো। এরা ‘লেসার’ বানায় তো ওরা ‘মেসার’! বর্তমানে সেরকমই কিছু আঁচ পাচ্ছে বিশ্ববাসী। এখন দেখার, ইন্টারনেট নির্ভর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এই যুগে জয়ের ঝান্ডা শেষমেষ কার হাতে থাকে? চিন ভাগ বসাতে পারবে কিনা তথ্য প্রযুক্তির জগতে একচ্ছত্র মার্কিন আধিপত্যে— তা সময়ই বলবে।

More Articles