মাত্র পাঁচ বছর বয়সেই ডাক্তারির কোচিং! যেভাবে এ সমাজে গেঁড়ে বসলো টিউশন শিল্প
Tution Industry : ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হতেই হবে! ভবিষ্যত সুরক্ষিত করতেই কি এ সমাজে গেঁড়ে বসলো টিউশন শিল্প?
জন্মের পর মাত্র বছর তিনেকের বিরতি, ব্যাস তারপরই শুরু দৌড়। চিরাচরিত এ দৌড়ের সঙ্গী অবশ্য পিঠে চাপানো একখানা ব্যাগ। আর তার মধ্যে ভরে দেওয়া যাবতীয় বইয়ের বোঝা। প্রতিযোগিতার ইঁদুর দৌড়ে পাল্লা দিতে দিতে অদ্ভুত একটা সময়ে এসে দাঁড়িয়েছি আমরা। যেখানে নিজের জন্য অবকাশ একেবারেই নেই। জন্মের পর থেকেই বাবা মা হিসেব কষে ঠিক করে ফেলেন তাঁদের সন্তানের ভবিষ্যত ঠিক কোন খাতে বইবে! ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আই এ এস অফিসার হওয়ার একটা প্রচ্ছন্ন দৌড় শুরু হয়ে যায় শৈশব থেকেই।
অমুক ট্রেনিং, তমুক কোচিংয়ের দাপটে জর্জরিত এ সমাজ। যেখানে শিশুদের জন্য খেলার মাঠ নেই, নেই ছুটির বিকেলও। সর্বক্ষণ কেবল টিউশানের ঘণ্টা। একটা শেষ করেই অন্য একটার দিকে দৌড়। অভিভাবকের ইচ্ছে শক্তির পাল্লাটা এতটাই ভারী হয়ে বসেছে যে তার জেরে শৈশবের সংজ্ঞাটাই বদলাতে বসেছে।
এরকমই একটি উদাহরণ সম্প্রতি সামনে এসেছে। বাচ্চাটির নাম কণিষ্ক। বয়স মাত্র পাঁচ বছর। সবে ৩০ পর্যন্ত গুণতে পারে সে। এমনকী ইংরেজি অক্ষর বলতে গিয়ে Q আসলেই আটকে যায়। একটা ওই বয়সের শিশুর ক্ষেত্রে এটাই তো স্বাভাবিক। অথচ তা মানতে নারাজ অভিবাবক। কণিষ্ক-এর মায়ের ইচ্ছের দৌড় এখনই আকাশ ছুঁয়েছে। তিনি ইতিমধ্যেই ঠিক করে ফেলেছেন ছেলে ডাক্তারকে বানাবেনই। আর এই পাহাড় প্রমাণ ইচ্ছের জোয়ালটা বইছে ছোট্ট শিশুটি। জয়পুরের একটি প্রাইভেট স্কুলে পড়ে সে। এখানেই শেষ নয়, পাঁচ ঘণ্টা ক্লাসের পর নিত্যদিন দুটো করে টিউশনও যেতে হয় তাকে। আর এর রেশ চলবে সেই ডাক্তারি পরীক্ষা পর্যন্ত। ক্রমেই বাড়বে এর ভার।
আরও পড়ুন - ইউনিট টেস্ট আর শুকতারা! পাড়াগাঁয়ের টিউশনই ছিল না-জানা গল্পের ক্লাস
টিউশন সংস্কৃতি যেন অচিরেই হয়ে দাঁড়িয়েছে এক মহামারী। ক্রমশ ভয়াবহ আকার নিয়েছে এই প্রথা। এর থেকে পালানোর যেন কোনও উপায়ই নেই। পাশের জনের সঙ্গে একটা প্রচ্ছন্ন প্রতিযোগিতায় জড়িয়ে পড়েছি আমরা সকলেই। তাই জয়পুরের কনিষ্ক একা নয়। হাজার হাজার লক্ষ্য লক্ষ্য কণিষ্ক ছড়িয়ে সারা দেশ জুড়ে।
'টিউশন রিপাবলিক'- এমন একটি সংস্থা যেখানে প্রতিদিন হাজার হাজার চাপানো ইচ্ছের জন্ম হয়। কিন্তু কীভাবে এই সংস্কৃতি গ্রস করল সমাজকে? আজকের পিতামাতারা কেন জন্মের পর থেকেই একটা চাপিয়ে দেওয়া ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দেন সন্তানদের? এ প্রশ্নের সঠিক জবাব অবধি দেয় বর্তমান চাকরির বাজারের পরিস্থিতিটিই। সামান্য একটা সুরক্ষিত জীবনের জন্য যে পরিমাণ প্রতিযোগিতায় নামতে হয় আজকের প্রজন্মকে তাতে করে এই টিউশন শিল্পই কি ভবিতব্য ছিল না?
মধ্যপ্রদেশ থেকে মহারাষ্ট্র, বিহার থেকে কেরালা, ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছে এর শাখা। করোনা পরিস্থিতির জেরে অফলাইনের পাশাপাশি অনলাইনেও জাঁকিয়ে বসেছে এই সংস্কৃতি। ডিজিটাল জগতেও দেদার চলছে কোচিং ক্লাসগুলি। সমীক্ষার দিকে তাকালে দেখা যায়, ২০০৬ সালে জাতীয় নমুনায় প্রকাশিত তথ্য অনুসারে, ৭.১ কোটি শিক্ষার্থী টিউশনে নথিভুক্ত হয়েছে।
আরও পড়ুন - উচ্চমাধ্যমিকের পরেই সরকারি চাকরি! SSC-র CHSL পরীক্ষায় বসতে গেলে মাথায় রাখতে হবে যা
এটা তো অস্বীকার করার অবকাশ নেই যে, এটি মূলধারার শিক্ষার সম্পূর্ণ ব্যর্থতা যা অভিভাবকদের এই বাজারের দিকে নিয়ে গেছে। শিক্ষা মন্ত্রক (তৎকালীন কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক) দ্বারা গঠিত একটি বিশেষজ্ঞ কমিটির ২০১৫ সালের অনুমান অনুসারে কোচিং ইনস্টিটিউটগুলির বার্ষিক আয় ছিল ২৪,০০০ কোটি টাকা। আবার পুনের একটি পরামর্শদাতা সংস্থা ইনফিনিয়াম গ্লোবাল রিসার্চ অনুসারে, ভারতে কোচিং শিল্পের বর্তমান বাজারে আয় প্রায় ৫৮,০০৮ কোটি টাকা। শুধু তাই নয়, ভারতীয় কোচিং শিল্পের প্রবৃদ্ধি ২০২৮ সালের মধ্যে ১,৩৩,৯৯৫ কোটি টাকায় পৌঁছাতে পারে বলেও অনুমান করা হয়েছে।
মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, এর প্রভাবে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে নিখাদ শৈশব। যার প্রভাব বিয়ে বেড়াতে হচ্ছে আজীবন। তবে এই সমাজের কনিষ্কের মা প্রিয়াঙ্কা মোটেই ব্যতিক্রম নন। সমাজের পরিকাঠামো, সরকারি শিক্ষায় গাফিলতি এবং সর্বোপরি চাকরির এই দারুণ সংকট আমাদের টেনে নিয়ে যাচ্ছে এমন আযাচিত অন্ধকারের দিকে। খোদ বাংলার চিত্রটার দিকে তাকালেও কি মেলে না এর পিছনে লুকিয়ে থাকা অজস্র কারণ। যখন দিনের পির দিন চাকরি মেলে না এ সমাজে, যখন শিক্ষক হওয়ার জন্য অনশন করে দস্তুর হয়ে দাঁড়ায় তখন কোন ভবিষ্যতের আশায় এ কোচিং শিল্পকে অস্বীকার করবে সমাজ?