আধারের পরে এবার 'অপার'! কেন দেশের পড়ুয়াদের তথ্য পেতে মরিয়া কেন্দ্র?

APAAR ID Card : ‘অপার’ প্রতিটি ছাত্রছাত্রীর জন্য একটা নতুন চিহ্নিতকরণের নম্বর তৈরি করবে, যার সঙ্গে সেই ছাত্র বা ছাত্রীর আধার সংযুক্ত করা থাকবে।

আমাদের দেশের শাসকেরা, দেশের উন্নয়ন বলতে এখন একটাই কথা বোঝেন। দেশকে আরও ডিজিটাল করে তোলা। আর তাঁদের কাছে, ডিজিটাল হয়ে ওঠার একটাই অর্থ, দেশের সমস্ত মানুষের তথ্যকে সংগ্রহ করা। তথ্য সংগ্রহ করে একত্র করা আর সঠিক অর্থে দেশের মানুষকে ডিজিটাল করা বা শিক্ষিত করে তোলা যে এক নয়, তা এদেশের শাসকদের কে বোঝায়? না হলে, প্রতিদিন যখন দেশের নানান প্রান্ত থেকে মানুষের আধার সংযোগ হওয়া ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা চুরি হওয়ার খবর আসছে, তখন সেই আধারকেই একমাত্র চেনার উপায় ধরে নিয়ে, আরও নানা কিছুর সঙ্গে তা সংযোগ করার দাওয়াই কেন দিচ্ছে কেন্দ্রীয় সরকার? যখন খবর পাওয়া যাচ্ছে, কোভিডের সময়ে সরকারের নেওয়া তথ্য ডার্ক ওয়েবে বিক্রি হয়ে যাচ্ছে, তখনও সরকারের হুঁশ নেই। তাই তারা আবারও শুরু করেছে নতুন প্রক্রিয়ায় তথ্য সংগ্রহের, আর এবার তাদের লক্ষ্য সারা দেশের ছাত্রছাত্রীরা।

কোনও আলোচনা নেই, কোনও নির্দেশিকা নেই, কোনও নতুন ওয়েবসাইট তৈরি করার প্রক্রিয়া নেই, কেন্দ্রীয় শিক্ষা মন্ত্রক হঠাৎ একটি চিঠি দিয়ে দিয়েছে বিভিন্ন রাজ্যের মুখ্য সচিবদের। সেই চিঠি সমস্ত সরকারি এবং বেসরকারি বিদ্যালয়গুলোতে পৌঁছে দেওয়ার নিদান দিয়ে বলা হয়েছে দেশের সমস্ত ছাত্রছাত্রীদের আধার তথ্য সংগ্রহ করে একটি কেন্দ্রীয় তথ্য ভাণ্ডার তৈরি করতে হবে। সরকারিভাবে এই তথ্য সংগ্রহের কাজটির একটি নামকরণও হয়েছে। ‘অপার’ অর্থাৎ অটোমেটেড পার্মানেন্ট আকাডেমিক অ্যাকাউন্ট রেজিস্ট্রি, যার কাজ দেশের সমস্ত ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং তাঁদের পড়াশোনার বাইরের পাঠক্রমের অতিরিক্ত কাজ এবং আরও অনেক বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করা, একত্রিত করা এবং কিছু ক্ষেত্রে তা অন্য সরকারি সংস্থার সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া। আরও বলা হয়েছে, ‘অপার’ প্রতিটি ছাত্রছাত্রীর জন্য একটা নতুন চিহ্নিতকরণের নম্বর তৈরি করবে, যার সঙ্গে সেই ছাত্র বা ছাত্রীর আধার সংযুক্ত করা থাকবে।

আরও পড়ুন- প্রশ্ন করলেই রাজরোষ! স্বাধীন মিডিয়াকে কেন ভয় পাচ্ছে মোদি সরকার?

এমনিতেই আমাদের দেশে হরেক পরিচয়পত্র, সেই নিয়ে আমরা নাজেহাল। তার সঙ্গে মাঝে মধ্যেই কেন্দ্রীয় সরকারের নতুন নতুন ফরমান, এই পরিচয়পত্রের সঙ্গে আধার যুক্ত করতে হবে! না হলে সেই প্রাথমিক পরিচয়পত্র যা দেখিয়ে হয়তো কোনও ব্যক্তি আধার পেয়েছিলেন, সেটিই বাতিল হয়ে যাবে। তার মধ্যে আবার যদি এই নতুন ফরমান আসে, তখন ছাত্রছাত্রীরা সেই সংযোগ করানোর পিছনে ছুটবেন না কি শিক্ষায় মনোনিবেশ করবেন? শোনা যাচ্ছে, নতুন জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০-তেই এই প্রস্তাব ছিল। অনেকেই বলতে পারেন, এটা তো বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাজ, এখানে ছাত্রছাত্রীদের বিশেষ কিছু করণীয় নেই। কিন্তু একটু খোঁজ নিলেই দেখা যাবে, এই ‘অপার’ প্রকল্প আসলে কত অসার। দেশের প্রতিটি বিদ্যালয়ে কি যথেষ্ট পরিমাণে শিক্ষক শিক্ষিকা আছেন বা এই ধরনের তথ্য সংগ্রহ এবং তাকে সঠিকভাবে তালিকাভুক্ত করার জন্য করণিক আছেন? যদি না থাকেন, তাহলে এই কাজে মূলত কারা নিযুক্ত হবেন? শিক্ষক শিক্ষিকাদেরই এই কাজটি করতে হবে। এই বিপুল পরিমাণ তথ্য সংগ্রহ এবং একত্রিত করা এবং তারপরে সেই অনুযায়ী প্রতিটি ছাত্রছাত্রীর জন্য একটি ‘অনন্য’ নম্বর তৈরি করা তো একদিনের কাজ নয়, ফলে স্বাভাবিক প্রক্রিয়াতেই পঠনপাঠনের ক্ষতি হবে।

আশ্চর্যের বিষয়, শিক্ষা বিষয়টি সংবিধানের যৌথ তালিকাভুক্ত হওয়া সত্ত্বেও, কোনও রাজ্য সরকারের সঙ্গেই এই বিষয়ে কেন্দ্রীয় শিক্ষা মন্ত্রকের কেউ আলোচনা করেনি। ফলত রাজ্য সরকারের শিক্ষা দফতরগুলো এই বিষয়ে কী করতে হবে তা নিয়ে অন্ধকারে। বিরোধী যে সরকার আছে, তারা কীভাবে এই অপারের বিরোধিতা করবে কিংবা আদৌ বিরোধ করবে কি না, তা তারাই ঠিক করবে। যদি বিরোধিতা না হয়, তাহলে ধীরে ধীরে শিক্ষা যে যৌথ তালিকা থেকে আরও কেন্দ্রীয় বিষয় হয়ে উঠবে, তা সহজেই অনুমেয়। ধীরে ধীরে পাঠ্যসূচি থেকে সংস্কৃতি সবটাই কেন্দ্রীয়ভাবে নির্ধারিত হবে। ভাষা থেকে শুরু করে সমস্ত জায়গাতেই, সঙ্ঘ পরিবার যে নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা নেবে তা এই অপারের জন্য তথ্য সংগ্রহের মধ্যে দিয়েই বেশ বোঝা যাচ্ছে।

যখন জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০ পাশ করানো হয়েছিল, সময়টা ছিল কোভিডের। সংসদকে এড়িয়ে সেদিন ওই জাতীয় শিক্ষানীতি এবং তিনটি কৃষি বিল পাশ হয়েছিল, তখন কিন্তু বহু মানুষ তার বিরোধিতা করেছিলেন। কৃষকেরা সেদিন কোভিডের বিধি নিষেধ না শুনে কৃষি বিলের বিরোধিতা করে রাস্তায় বসে পড়েছিলেন এবং কেন্দ্রীয় সরকার সেই বিল ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছিল। ছাত্রছাত্রীরা, যারা এই জাতীয় শিক্ষানীতিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে শোনা গিয়েছিল এবং যা হয়তো সত্যিও, তারা কিন্তু অনলাইন ক্লাস বা সেমিনারেই আবদ্ধ ছিল, ফলে তার কোনও বিরোধিতা হয়নি। আজকে যখন ওই শিক্ষা নীতিরই অংশ হিসেবে ‘অপার’ আনা হচ্ছে, ছাত্রছাত্রীরা এবং শিক্ষকরা যে দিশেহারা হবেন, তা বলাই বাহুল্য।

আরও পড়ুন-স্মার্ট-দুর্নীতির দক্ষ খিলাড়ি মোদি সরকার

আমাদের বোঝানো হয়েছে, আধার একটি অনন্য পরিচয়পত্র, যা নকল করা সম্ভব নয়। বোঝানো হয়েছে, প্রতিটি মানুষের হাতের ছাপ অনন্য, যা কোনওদিনই কেউ অপব্যবহার করতে পারবে না। কিন্তু সাম্প্রতিক যে সব ব্যাঙ্ক জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে, তা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই আধার এবং মানুষের হাতের ছাপের নকল করেই হয়েছে, তা তদন্তে প্রকাশ পেয়েছে। সেই সমস্যার সুরাহা করার বদলে সরকার এবং ব্যাঙ্কের তরফ থেকে প্রতিটি নাগরিককে বলা হয়েছে, ‘বায়োমেট্রিক লক’ করে রাখতে। এরপর যদি অপারের ক্ষেত্রে কোনও একজন ছাত্র বা ছাত্রীর ক্ষেত্রে এই রকম কোনও ঘটনা ঘটে, তখনও কি সরকার তার দায় নেবে? না কি তার পরিবর্তে ছাত্রছাত্রীদেরই পরামর্শ দেবে সাবধান হতে? আরও একটা সমস্যা হতে পারে, যা নিয়েও ভাবা প্রয়োজন। যেহেতু আমাদের মতো দেশে এই ধরনের ব্যক্তিগত তথ্যের কোনও সুরক্ষা নেই, তাই যদি কখনও এই তথ্য চুরি হয়ে যায়, তাহলে কারা লাভবান হবে সেই তথ্য হাতে পেয়ে? প্রায় রোজ যখন শোনা যাচ্ছে, ডার্ক ওয়েবে ভারতের আধার তথ্য চুরি হচ্ছে, তখন আবার এই একই ধরনের পরীক্ষানিরীক্ষা কেন?

ছাত্রছাত্রীদের ভবিষ্যৎ এমনিতেই কোভিডের জন্য নষ্ট হয়েছে। তারপরে আবার এই তথ্য সংগ্রহ কি তাঁদের আবার গিনিপিগ বানানো ছাড়া অন্য কিছু?
আধারের ক্ষেত্রে যেমন বলা হয়েছিল, এই নিবন্ধীকরণ কেউ করতেও পারেন আবার নাও করতে পারেন, ‘অপারে’র ক্ষেত্রেও তাই বলা হয়েছে। কিন্তু আজকে সমস্ত কিছুর জন্য আধারকে বাধ্যতামূলক করে দেওয়াতে বহু মানুষকে দৈনন্দিন অসুবিধার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। আগামী দিনে, ‘অপার’ যদি বাধ্যতামূলক হয়, তাহলে সমাজের কোন অংশের ছাত্রছাত্রীরা অসুবিধাতে পড়বেন, তা কি বুঝতে সমস্যা হওয়ার কথা? প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, কেন্দ্রীয় জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০ কিন্তু ধীরে ধীরে শিক্ষাকে আরও বেশি প্রান্তিক ছাত্রছাত্রীদের কাছে পৌঁছনোর বদলে  সংকোচনের প্রস্তাবই দিয়েছে। বিভিন্ন ছাত্র
সংগঠন বা শিক্ষক সংগঠনগুলো কি এই অসুবিধার সত্যতা বুঝতে পারছে?

 

More Articles