তৃষ্ণার্ত পাবে ফ্রিজের ঠান্ডা জল! শহরটা এখনও শুকিয়ে যায়নি, প্রমাণ করলেন এই যুবক
কাঠফাটা রোদ্দুরে জ্বলছে কলকাতা শহর। তারই মধ্যে তৃষ্ণার্থ মানুষ রাস্তায় বসানো ফ্রিজ থেকে বের করে নিচ্ছেন ঠান্ডা জলের বোতল। এমন চিত্রই ধরা পড়ল মধ্য কলকাতার আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে। গরমে বেহাল দশা কলকাতাবাসীর। আবহাওয়া দপ্তর জানাচ্ছে এখুনি বৃষ্টির সম্ভবনা নেই। এ অবস্থায় পথচারীদের তৃষ্ণা মেটাতে রাস্তার ধারে ফ্রিজ বসালেন মোহম্মদ তৌসিফ রহমান নামে এক যুবক। গরমে জলসত্র খোলার রীতি কলকাতায় নতুন নয়। গ্রীষ্ম এলেই এ শহরের বহু মানুষ পাড়ায় পাড়ায় জলসত্র খোলার উদ্যোগ নেন। তৃষ্ণার্থ পথিক সেখানে পান এক গ্লাস জল আর গোটা দুই গুড়ের বাতাসা। শুধু কলকাতা কেন, শহরের বাইরেও বহু যুগ ধরে গরমে জলসত্র খোলার রীতি বজায় রয়েছে। এই জলসত্রকে কেন্দ্র করেই বিভূতিভূষণ রচনা করেছিলেন এক ছোটগল্প। কিন্তু এই কাঠফাটা রোদে কলকাত্তাইয়া যুবক যা ভেবেছেন বলতেই হয় তা বেশ নতুন রকম।
আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের জনবহুল রাস্তা ধরে সোজা এগোলে দেখা মিলবে প্র্যাট মেমোরিয়াল বা সেন্ট জেমসের মতো স্কুলের। দুপুর রোদে তার সামনে গাড়ি দাঁড় করিয়ে চোখেমুখে ঠান্ডা জল ছিটিয়ে খানিক জিরিয়ে নেন অটোচালকেরা। আর সেই রাস্তার উপরেই তৌসিফ বসিয়েছেন একটা ফ্রিজ। স্থানীয়দের ভাষায় ‘কমিউনিটি ফ্রিজ’।
আরও পড়ুন-পালকি চেপে যুদ্ধ- ময়দানে যেতেন মুঘল রমণীরাও, হারিয়ে যাওয়া সেই যানের গল্প…
এ কাজে অবশ্য তিনি একা নন। তাঁর সঙ্গে রয়েছে মুদার পথেরিয়া নামক এক সমাজকর্মীও। বেশ কিছুদিন আগে মুদারের কন্যা কামিলা কাতারে যান। সেখানেই তিনি এমন ব্যবস্থার কথা প্রথম জানতে পারেন। কাতারের বহু মানুষ গরমকালে তাঁদের সহনাগরিকদের তৃষ্ণা মেটাতে রাস্তার ধারে এমন ফ্রিজ বসান। পথচারীরা ইচ্ছেমতো ফ্রিজ থেকে জলের বোতল বের করে তা পান করেন। এর জন্যে কোনোরকম পয়সা দিতে হয়না তাঁদের।
কামিলা কাতারের এই কমিউনিটি ফ্রিজের ছবি তুলে এনে উৎসাহ নিয়ে তাঁর বাবা কে দেখান। মুদার সে সমস্ত ছবি দেখে কিছুটা আশ্চর্য হন। সত্যিই তো, এমন বহু মানুষ রয়েছেন যাঁদের ফ্রিজ কেনার পয়সা নেই। তাঁরা কি প্রবল গরমে ঠান্ডা জলটুকুও পাবেন না। তিনি তাঁর পুরনো বন্ধু তৌসিফের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তাঁদের নিজেদের পাড়াতেও এমন একটা ব্যবস্থা করা যায় কিনা সে বিষয়ে দুজনে আলোচনা করেন। ইতিপূর্বে সমাজকর্মী হিসেবে তৌসিফ নিজের এলেকায় বেশ কিছুটা খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের স্থানীয় মানুষজন বলেন, তিনি এর আগে দীর্ঘ সময় জুড়ে এলাকার দরিদ্র মানুষজনের বিনামূল্যে খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন।
মুদারের প্রস্তাবে তৌসিফও আগ্রহী হলেন। তিনি ঠিক করলেন, নিজের বাড়ির ফ্রিজখানাই রাস্তার ধারে বসাবেন। তার ভেতর রাখা থাকবে অন্তত তিরিশটা ঠান্ডা জলের বোতল। কিন্তু প্রশ্ন হল, খোলা রাস্তার উপর তিনি বিদ্যুৎ পাবেন কোথায়? তৌসিফ তখন একটা বুদ্ধি করলেন। তাঁর নিজের বাড়ির মিটার থেকে তিনি লাইন টেনে নিয়ে এলেন রাস্তার উপর। তারপর তার সঙ্গে জুড়ে দিলেন একটা ‘সিঙ্গেল ডোর’ ফ্রিজ। শহর কলকাতা পেল তার প্রথম ‘কমিউনিটি ফ্রিজ’।
তবে ফ্রিজের ভেতর জলের বোতল ভরে রাখার দায়িত্ব তৌসিফের একার নয়। তাঁর উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়ে এলাকার বাসিন্দারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে সে দায়িত্ব নিয়েছেন। আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের মানুষজন নিজেদের সময় সুযোগ মতো তৌসিফের বসানো ফ্রিজের ভেতর জলের বোতল রেখে যান। কেউ কেউ আবার বিকেলের দিকে শরবতের বোতলও রেখে যান।
তৌসিফ চান জায়গায় জায়গায় এমন উদ্যোগ নিক সাধারণ মানুষ। অরিজিৎ সেন-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছেন, ‘একটা সেকেন্ড হ্যান্ড ফ্রিজ কিনতে লাগে ৪০০০ টাকা। এলাকার মানুষজন ১০০ বা ৫০০ টাকা করে দিলেই জায়গায় জায়গায় এমন ফ্রিজ বসানো যাবে।’ তৌসিফ এবং মুদার দুজনেই মনে করেন, তাঁদের এই উদ্যোগের ফলে সবচেয়ে বেশি উপকৃত হচ্ছেন এলাকার দরিদ্র মানুষজন।
২০১৭ সালে এমনই এক ‘কমিউনিটি ফ্রিজ’ বসানোর উদ্যোগ নিয়েছিলেন ইসা ফতিমা জাসমিন নামে চেন্নাইয়ের জনৈকা চিকিৎসক। চেন্নাইয়ের বসন্ত নগর টেনিস ক্লাবের বাইরে তিনি এই ফ্রিজ স্থাপন করেছিলেন। ইসা অবশ্য জলের বোতলের সঙ্গে ফ্রিজের ভেতর খাবার-দাবারও রাখতেন। চেন্নাইয়ের মানুষজন কে তিনি আবেদন জানিয়েছিলেন, তাঁরা যেন নিজেদের উদ্বৃত্ত খাবারটুকু তাঁর কমিউনিটি ফ্রিজে এসে রেখে যান। এতে করে এলাকার বহু দরিদ্র মানুষকে আর অভুক্ত থাকতে হবে না।
স্রেফ নিজেরটুকু বুঝে নেওয়ার যুগেও তৌসিফ, মুদার বা ইসার মতো মানুষজন নিজেদের সহনাগরিকদের কথা ভাবছেন। তাঁদের সুবিধার্থেই লাভ-লোকসানের সমীকরণের বাইরে গিয়ে তাঁরা ছোট ছোট উদ্যোগ নিচ্ছেন। হতাশাক্লিষ্ট দিনকালে এটুকুই যেন আশার আলো।