বারুইপুর, যাদবপুর হয়ে দমদম! 'সুদিন' ফেরাতে পারবেন সুজন চক্রবর্তী?

Sujan Chakraborty CPIM: সুজন চক্রবর্তী বারবারই বলেছেন, তৃণমূলের ঘরেই বিজেপির লালন পালন। এ রাজ্যেও তৃণমূলের হাত ধরেই বিজেপির বাড়বাড়ন্ত।

পক্ক কেশ, মুখে হাসি, সাদা জামা! বাংলায় বর্তমান বাম নেতৃত্বের কথা মনে পড়লেই তাঁর এই ছবি ভেসে উঠবেই। ছাত্র রাজনীতি থেকে শুরু করে সাংসদ হয়ে ওঠা। যাদবপুর লোকসভা কেন্দ্র থেকে এবার তিনি সরে গিয়েছেন দমদম কেন্দ্রে। বামনেতা সুজন চক্রবর্তীর এই দীর্ঘ রাজনৈতিক সফরের কাহিনি আজও তরুণ প্রজন্মের কাছে এক উদাহরণ! যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনটি ডিগ্রি রয়েছে তাঁর - স্নাতক, স্নাতকোত্তর এবং পিএইচডি। বহুজাতিক সংস্থা থেকে চাকরির সুযোগ এলেও, সম্পূর্ণ সময়ের রাজনীতির পথই বেছে নিয়েছিলেন সুজন চক্রবর্তী। একটি সাক্ষাৎকারে একবার সুজন বলেছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময় তাগিদ ছিল কত তাড়াতাড়ি পড়াশোনা শেষ করে চাকরি করবেন। কিন্তু ধীরে ধীরে ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। মত পরিবর্তন হয়ে যায় যখন তিনি বুঝতে পারেন, মানুষের হয়ে, সমাজের ও দেশের কাজও গুরুত্বপূর্ণ। এরপরই পার্টির হোলটাইমার হিসেবে যোগদান। এই মুহূর্তে দমদম লোকসভা কেন্দ্রের হয়ে জোরকদমে প্রচারে ব্যস্ত তিনি। ৭০ এর দশক থেকে রাজনীতির ময়দানে সুজন চক্রবর্তীর টিকে থাকার লড়াই ছিল চড়াই-উৎরাইয়ে ভরা?

নবম শ্রেণি‌ থেকেই সুজন চক্রবর্তীর মার্ক্সবাদের প্রতি ঝোঁক। ১৯৮৫ সালে 'স্টুডেন্টস ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়া' বা এসএফআইয়ের দক্ষিণ ২৪ পরগনা ইউনিটের সচিব হন। এরপর থেকেই একে একে রাজনৈতিক পদে কাজ করে গেছেন তিনি। ১৯৮৮ সালে রাজ্য সম্পাদক, ১৯৯৩ সালে সর্বভারতীয় স্তরে এসএফআইয়ের সাধারণ সম্পাদক হন। ১৯৯৪ সালের কিউবা আন্তর্জাতিক সংহতি সম্মেলনেও অংশ নেন সুজন। ১৩ মার্চ ১৯৫৯, দক্ষিণ ২৪ পরগনার কালিকাপুরে এক নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম সুজন চক্রবর্তীর। বাবা কানাইলাল চক্রবর্তী, মা বীণাপাণি চক্রবর্তী। দেশভাগের সময় পূর্ব পাকিস্তান থেকে চলে আসেন তাঁরা। বাবা ছিলেন স্থানীয় বিদ্যালয়ের করণিক। ওপার থেকে চলে আসা ৮ সন্তানের পরিবার চলত বাবারই সামান্য বেতনে। ১৯৭৫ সালে উচ্চ মাধ্যমিক এবং জয়েন্ট এন্ট্রান্সে ভালো ফল করে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে 'ফার্মাসিটিক্যাল টেকনোলজি' বিভাগে ভর্তি হন সুজন। মেধাবী সুজন চক্রবর্তী ফার্স্ট ক্লাস নিয়ে স্নাতক উত্তীর্ণ হন। স্নাতকোত্তর শেষ করে 'ক্যান্সার টার্মিনাল ডিজিজ' নিয়ে গবেষণা করে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। এই গবেষণা নিয়ে নিজের বক্তব্য পেশ করতে ১৯৯৫ সালে গ্রিসের ক্যানসার বিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগদানের আমন্ত্রণ পান তিনি।

আরও পড়ুন- যাদবপুরে সততা বনাম দুর্নীতি! সায়নী ঘোষের বিরুদ্ধে কতটা শক্তিশালী সৃজন ভট্টাচার্য?

কেন্দ্রীয় দলনেতা সুজন চক্রবর্তী বারুইপুর কেন্দ্র থেকে ১৯৯৮ সালে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর ২০০৪ সালে আবার যাদবপুর বিধানসভা কেন্দ্রের সাংসদ হন। ২০১৬ সালে যাদবপুর বিধানসভায় সুজন চক্রবর্তী ১৪ হাজার ৯৪২ টি ভোটে, মণীশ গুপ্তকে পরাজিত করেছিলেন। ২০২১ সালে আবার পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে সর্বভারতীয় তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী দেবব্রত মজুমদার সুজন চক্রবর্তীকে ৩৮ হাজার ৮৬৯ ভোটে পরাজিত করেন। বারুইপুর, যাদবপুরের পর এবার দমদমের প্রার্থী সুজন।

সুজন চক্রবর্তী বারবারই বলেছেন, তৃণমূলের ঘরেই বিজেপির লালন পালন। এ রাজ্যেও তৃণমূলের হাত ধরেই বিজেপির বাড়বাড়ন্ত। তৃণমূলের প্রার্থী তালিকা ঘোষণার পরে সুজন চক্রবর্তী কটাক্ষ করে বলেছিলেন, "বিজেপি যেমন সংবিধান মানে না, জোর করে সরকার গড়তে চায় তেমনই বিজেপির পদাঙ্ক অনুসরণ করে তৃণমূল প্রার্থী তালিকা করেছে। বিজেপির বিধায়কদের বিধানসভায় ইস্তফা না দিয়ে তৃণমূল প্রার্থী করেছে। আসলে মোদিজির সঙ্গে আলোচনা করেই তৃণমূল প্রার্থী করেছে।" জেলা তৃণমূলের চেয়ারম্যান আশিস বন্দ্যোপাধ্যায় পাল্টা জবাব দেন, "আসলে ওদের প্রতি বুথে ভোট, প্রার্থী সংখ্যা হাতেগোনা। জনসমর্থন নেই। পায়ের তলায় মাটি হারিয়ে ওদের এখন কুৎসা রটনাই সম্বল হয়ে দাঁড়িয়েছে।"

২০২১ সালে বিধানসভায় দেখা হয়ে যায় সুজন চক্রবর্তী আর বঙ্গ বিজেপির প্রধান মুখ শুভেন্দু অধিকারীর। কফির আসরে আলাপচারিতাও হয়। শুভেন্দু অধিকারী সহ অনেকেই এই কাকতালীয় ঘটনাকে 'সৌজন্য' বলেছিলেন বটে কিন্তু তৎকালীন তৃণমূল নেতা তাপস রায় বলেছিলেন, "বাংলায় সৌজন্য ছিল এবং তাকে আলাদা মর্যাদায় রক্ষা করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। গোটা পরিবেশকে বরং কুলষিত করেছে বিজেপিই!" রাজনৈতিক মহলের মন্তব্য ছিল, রামে-বামে মিলে গেছে।

রাজ্যের এবং কেন্দ্রের দুর্নীতির বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন সুজন। তাঁকে দেখা গেছে, শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি, দেউচা পাঁচামি, কৃষক আন্দোলন, মূল্যবৃদ্ধি, সিএএ-র মতো নানা আন্দোলনগুলিতে। রাজনৈতিক মহল প্রশ্ন তুলেছিল, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র স্বপ্নদীপের অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনায়, এক সময়ের বাম ছাত্রনেতা সুজন চক্রবর্তীর ক্ষীণ প্রতিবাদের ভূমিকা নিয়ে। তাঁর বিরুদ্ধেও রাজনৈতিক সচেতনতার অভাবের অভিযোগ উঠেছে বারংবার। রাজনৈতিক মহলের একাংশের দাবি, তাঁদের দল রাস্তায় নামলেও তা ফলপ্রসূ হয় না। দলের দুর্বল পরিকল্পনা, সাংগঠনিক নেতৃত্বের অভাব নিয়ে চর্চা হয়। সুজন চক্রবর্তীদের মতো বর্ষীয়ান বাম নেতাদের উপস্থিতি সত্ত্বেও দলের এই হাল কেন, প্রশ্ন তোলেন বিশেষজ্ঞরা। রাজ্যের মন্ত্রী উদয়ন গুহ সুজন চক্রবর্তীকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে, ফেসবুকে একবার লিখেছিলেন, "সুজনবাবু কোটায় চাকরি হতো না? তবে এরা কী করে চাকরি পেয়েছিল? অঞ্জলি সেন, শুক্লা সরকার, বুদ্ধদেব রায়, বিশ্বনাথ রায়, মলয় রায়!" তিনি পরপর ফেসবুক পোস্ট করে দাবি করে গেছেন, যোগ্যতা ছাড়াই নাকি চাকরি পাওয়া ১০০ জনের তালিকা তিনি দেখাতে পারবেন।

তৃণমূলের সাংসদ মহুয়া মৈত্রর সাংসদ পদ খারিজের সময় কেন্দ্রর বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতেও দেখা যায় বাম বর্ষীয়ান নেতাকে। বিরোধী দলের সাংসদকে সমর্থন জানিয়ে এথিক্স কমিটির সমালোচনার মুখেও পড়েন সুজন। অপরদিকে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতির বিরোধিতায় 'বঙ্গবিভূষণ' ও 'বঙ্গভূষণ' প্রাপকদের পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করারও আবেদন জানিয়েছিলেন কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তী। তৃণমূল নেতা কুণাল ঘোষ, সিপিএমকে আক্রমণ করে বলেছিলেন, "এটা অত্যন্ত কুরুচিকর মনোভাব। সিপিএম কখনই শিক্ষা, শিল্প, সংস্কৃতি জগতের মানুষদের সম্মান দেয়নি। কোনও ঘটনাকেই রাজ্যের কর্মসূচির সঙ্গে যুক্ত করা যায় না। প্রয়াত উত্তম কুমারের প্রতিও শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেনি। সিপিএম কোনওদিনই এসব বোঝে না।"

আরও পড়ুন- কোটি কোটি টাকা বন্ডের নামে রাজনৈতিক দলের বেইমানি এখনও সহ্য করে যাবেন?

আবার, নিয়োগ দুর্নীতির বিরুদ্ধে সুর চড়ানো সুজন চক্রবর্তীর স্ত্রীর বিরুদ্ধে, তৃণমূল নেতা কুণাল ঘোষ অভিযোগ তুলেছিলেন, তাঁর স্ত্রী মিলি নাকি চাকরির পরীক্ষা না দিয়েই কলেজে চাকরি পেয়েছিলেন। যদিও মিলি চক্রবর্তী অভিযোগ নাকচ করে বলেছিলেন তিনি পরীক্ষায় প্রথম হয়েছিলেন, যারা অভিযোগ তুলেছে প্রমাণ পেশ করুক তারা। মিলি চক্রবর্তীর দাবি ছিল, "আমার পার্সোনাল ফাইল থেকে জয়েনিং লেটার বের করেছেন। এটা বের করা যায় না। তবু মেনে নিলাম। কিন্তু সেখানে যে ইন্টারভিউ বোর্ড ছিল, যে পরীক্ষা হয়েছে, তার ফলও প্রকাশ্যে আনা হোক।" সুজন চক্রবর্তীও এই অভিযোগ অস্বীকার করেন। দাবি করেন, বামফ্রন্ট আমলে কোনও দুর্নীতি হয়নি। সম্প্রতি বামেদের এক জনসভায় জেলবন্দি দাপুটে নেতা অনুব্রত মণ্ডলকে ইঙ্গিত করে সুজন বলেন, "সন্ত্রাসের আঁতুড়ঘর বীরভূম। উন্নয়নে দাঁড়িয়ে ছিল রাস্তায়। যে মানুষ দাঁড়িয়েছিল, সে এখন তিহাড় জেলে গিয়ে শুয়ে পড়েছে।" তৃণমূলের পাল্টা হুঁশিয়ারি, "শূন্য হয়ে যাওয়ায় সিপিএম কুৎসা করছে"। বামেদের এই 'শূন্য' আসন নিয়ে অগুনতি আক্রমণ করেছে বিরোধীরা। 

আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে দমদম থেকে সুজন চক্রবর্তীর বিরোধী প্রার্থী তৃণমূলের নেতা সৌগত রায়। বিজেপি এখনও এই আসনে প্রার্থী ঘোষণা করেনি। গতবার তৃণমূলই এই আসনে জয়লাভ করেছিল। শোনা যায়, এই অংশ রাজ্য সকারের গড়। সৌগত রায়ও ১৫ বছরের সংসদ। যদিও বিরোধীরা মনে করেন, জনগণের ভোট কেন্দ্রে পৌঁছনোর আগেই নাকি 'গড়'- এর সিদ্ধান্ত হয়ে যায়। বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, বামেদের অস্তিত্বের লড়াইয়ে যে প্রয়াস দরকার তা এখনও দেখা যাচ্ছে না। দমদমে ভোট একদম শেষ দফায়। ফলত, এই আসনে সব রাজনৈতিক দলই ভোটের প্রচারে সময় পাবে। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেহেতু শেষ দফাতেই সন্দেশখালিরও ভোট, গেরুয়া শিবির কেন্দ্রীয় মহিলা নেতৃত্বদের নিয়ে জোর কদমে প্রচারে নামবে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, শেষ দফা মানে ৬ দফায় বুথগুলোর পরিস্থিতি এবং রাজনৈতিক ব্যাক্তিদের পর্যবেক্ষণ সবটাই জনগণের চোখের সামনে থাকবে। বামেদের পরিকল্পনা কোন দিকে যায় এবং তাঁদের পরিকল্পনা আসনে অদল বদল ঘটায় কিনা তাই এখন দেখার। দেখার, 'শূন্য'-র জবাব সুজন চক্রবর্তী দিতে পারেন কিনা।

More Articles