বস্তার থেকে পঞ্জাব! কেন মোঘায় আন্দোলনে নামছেন হাজার হাজার মানুষ?

Moghai: মোঘার এই সমাবেশ এক জ্বলন্ত সত্যকে সামনে এনেছে। আদিবাসী অঞ্চল থেকে শুরু করে পঞ্জাবের উর্বর কৃষিজমি পর্যন্ত, কর্পোরেট আগ্রাসন সারা দেশকে গ্রাস করতে চাইছে।

যখন রাষ্ট্র তার নিজের নাগরিকদের শোষণের জন্য কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেয়, তখন প্রতিরোধই একমাত্র পথ। সেই প্রতিরোধের আগুন আজ দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছে বস্তারের গভীর জঙ্গল থেকে পঞ্জাবের উন্মুক্ত প্রান্তরে। গত ৮ অগাস্ট পঞ্জাবের মোঘায় হাজার হাজার মানুষ আদিবাসীদের গণহত্যার বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিলেন। তাঁদের স্লোগান ছিল, “জনগণের বিরুদ্ধে নৃশংস যুদ্ধ বন্ধ করুন!” এই জ্বলন্ত ঘোষণাটি একটি নির্মম সত্যকে সামনে এনেছে— দেশের সরকার যেন তার নিজের দেশবাসীর বিরুদ্ধেই এক অঘোষিত যুদ্ধে নেমেছে।

ওই দিন মোঘায় তিন ডজনেরও বেশি গণতান্ত্রিক সংগঠন  আদিবাসীদের উপর চলা নৃশংস গণহত্যার তীব্র নিন্দা জানায়। এই বিশাল সমাবেশ ও প্রতিবাদ মিছিলে প্রতিবাদকারীরা রাষ্ট্রীয় সহিংসতাকে ধিক্কার জানায়। তাঁদের দাবি ছিল, আদিবাসী অঞ্চলে অবিলম্বে ‘অপারেশন কাগার’-সহ সব সামরিক অভিযান বন্ধ করা, ভুয়ো সংঘর্ষ ও হেফাজতে হত্যার অবসান, এবং আদিবাসী এলাকা থেকে পুলিস ও আধা-সামরিক বাহিনী সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাহার করা। এই প্রতিবাদ সমাবেশ প্রকৃত অর্থেই আদিবাসী সংগ্রামের প্রতি সংহতির এক জোরালো প্রকাশ।

তবে এই সমাবেশের মূলে রয়েছে পঞ্জাবের কৃষকদের দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত অসন্তোষ। ভূমি অধিগ্রহণ নীতি, স্মার্ট ইলেকট্রিক মিটার স্থাপন এবং কেন্দ্রীয় সরকারের বিতর্কিত কৃষি আইনের বিরুদ্ধে কৃষকদের মধ্যে ক্ষোভ তীব্র ছিল। প্রতিবাদকারীদের মতে, সরকারের নীতিগুলি কর্পোরেটদের সুবিধা দিতে এবং কৃষকদের জীবন-জীবিকা কেড়ে নিতে তৈরি করা হচ্ছে। মোঘার এই প্রতিবাদের গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো- এটি আদিবাসী এবং কৃষকদের ইস্যুগুলিকে এক মঞ্চে নিয়ে এসেছে। প্রতিবাদকারীরা মনে করেন, উভয় ক্ষেত্রেই কর্পোরেটদের লোভই মানুষের যন্ত্রণার কারণ।

নিজের অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে জনগণ সংগ্রামের পথ বেছে নিচ্ছে

কর্পোরেট আগ্রাসন ও আদিবাসী উচ্ছেদ

কর্পোরেটদের অদম্য লোভ আর মুনাফার খিদে আজ এতটাই তীব্র যে তা আমাদের সংবিধান, গণতন্ত্র এবং মানবিকতাকে গ্রাস করে নিচ্ছে। বস্তার ও অন্যান্য আদিবাসী অঞ্চলে লক্ষ লক্ষ আধা-সামরিক বাহিনী মোতায়েন করে যে রক্তাক্ত অভিযান চালানো হচ্ছে, তার একটাই উদ্দেশ্য— দেশের জল, বন, জমি ও খনিজ সম্পদ দেশি-বিদেশি বহুজাতিক কর্পোরেশনদের হাতে তুলে দেওয়া। সরকার আদিবাসীদের জীবনের চেয়ে কর্পোরেটদের লাভকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। ভুয়ো সংঘর্ষে আদিবাসীদের হত্যা করা হচ্ছে, আর তথাকথিত ‘উন্নয়নের’ নামে তাঁদের বাস্তুভিটা থেকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে। মোদি সরকারের এই নীতি ফ্যাসিবাদী সন্ত্রাসেরই এক নতুন রূপ। যেখানে গণতন্ত্রের মুখোশের আড়ালে লোভী পুঁজিপতিদের স্বার্থ রক্ষা করা হচ্ছে।

পঞ্জাবের আপ সরকার: কর্পোরেট তোষণের নতুন মুখ?

এই কর্পোরেট আগ্রাসন কেবল কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। পঞ্জাবে আম আদমি পার্টির (আপ) সরকারও একই পথে হাঁটছে বলে অভিযোগ উঠছে। যে আপ জনগণের স্বার্থে কাজ করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল, সেই সরকার যখন কৃষি ও শিল্পক্ষেত্রে কর্পোরেটদের সুবিধা দিতে শুরু করে, তখন জনগণের মনে তীব্র হতাশা ও ক্ষোভের জন্ম দেয়। এটিই স্বাভাবিক। পঞ্জাবের ভূমি, কৃষি এবং সম্পদের উপর কর্পোরেটদের নজর দিন দিন বাড়ছে। নিজের অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে জনগণ সংগ্রামের পথ বেছে নিচ্ছে। জনগণের সংগ্রাম যত তীব্র হচ্ছে, পাল্লা ততই বাড়ছে রাষ্ট্রীয় দমনের মাত্রা। গণতান্ত্রিক অধিকার লঙ্ঘন এবং ভিন্নমতের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রবণতা পঞ্জাবেও লক্ষণীয়। মোঘার প্রতিবাদ সমাবেশ থেকে সেই আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে, যা মোটেই অমূলক নয়। আদিবাসীদের বিরুদ্ধে চলা এই যুদ্ধ আজ রুখে দেওয়া না গেলে, কাল তা পঞ্জাবের সমস্ত ক্ষেত্রকে গ্রাস করবে। তাই পঞ্জাবে আপ সরকারের ভূমিকা আজ জনগণের কড়া নজরে রয়েছে।

আরও পড়ুন-অর্ধেক মাওনেতা নিকেশ! বাস্তারের মাওবাদী আন্দোলন শেষের মুখে? 

আইনের অপব্যবহার এবং গণতন্ত্রের মৃত্যু

প্রতিবাদকারীদের দাবিগুলি আমাদের বিচারব্যবস্থা এবং গণতান্ত্রিক কাঠামোর ভাঙন স্পষ্ট করে তোলে। 'ইউএপিএ' ও 'এএফএসপিএ'-এর মতো কঠোর আইন বাতিল, এনআইএ-এর বিলুপ্তি এবং মিথ্যা মামলায় আটক সকল গণতান্ত্রিক অধিকার কর্মীর নিঃশর্ত মুক্তি—এই দাবিগুলি প্রমাণ করে যে রাষ্ট্র ভিন্নমত দমনে এই ধরনের আইনকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে, যা আইনের অপব্যবহার। জনদরদী লেখক, বুদ্ধিজীবী এবং মানবাধিকার কর্মীদের মিথ্যা অভিযোগে জেলে ভরা হচ্ছে, কারণ তারা সরকারের জনবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে কথা বলেন। এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং এটি রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে জনগণের বিরুদ্ধে পরিকল্পিত দমন-পীড়নের একটি অংশ।

গণসংগঠনের ঐক্য এবং প্রতিরোধের দাবি

মোঘার ঐতিহাসিক সমাবেশে বিভিন্ন গণসংগঠনের ঐক্যবদ্ধ কণ্ঠস্বর শোনা গিয়েছে। বিকেইউ একতা-উগ্রহান-এর রাজ্য সভাপতি যোগিন্দর সিং উগ্রহান, ইন্ডিয়ান ফেডারেশন অফ ট্রেড ইউনিয়নস-এর রাজ্য সভাপতি কুলবিন্দর সিং ওয়ারাইচ, পঞ্জাব খেত মজদুর ইউনিয়ন-এর সাধারণ সম্পাদক লাখমান সিং সেওয়েওয়ালা, অ্যান্টি-অপারেশন গ্রিন হান্ট ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের আহ্বায়ক ডঃ পারমিন্দর, এবং ভারতীয় কিষাণ ইউনিয়ন (ডাকোন্দা)-এর সাধারণ সম্পাদক হারনেক সিং মেহিমা-সহ বহু বিশিষ্ট নেতা-নেত্রী এতে বক্তব্য রাখেন। কৃষক, শ্রমিক, যুবক, ছাত্র, মহিলা, যুক্তিবাদী, গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষাকারী, প্রগতিশীল লেখক, শিল্পী এবং সাংস্কৃতিক কর্মীরা এই আন্দোলনে শামিল হন। এছাড়াও, দলিত ও মজদুর মুক্তি মোর্চা, অটো রিকশা ইউনিয়ন এবং অন্যান্য গণসংগঠনগুলোর অংশগ্রহণ প্রমাণ করে যে এই আন্দোলন কতটা গভীর ও ব্যাপক।

প্রতিবাদকারীরা প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের গণতান্ত্রিক অধিকার পুনরুদ্ধারের দাবি জানান এবং জনগণের সংগঠন ও আন্দোলনের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার কথা বলেন। তাঁদের জোরালো বার্তা—রাষ্ট্রকে তার নিজের জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ বন্ধ করতে হবে এবং সকল নাগরিকের সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা করতে হবে।

পঞ্জাবের মোঘায় হাজার হাজার মানুষ আদিবাসীদের গণহত্যার বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছেন

এই সমাবেশের এক জোরালো সুর শোনা যায় যখন লেখক, অনুবাদক এবং গণতান্ত্রিক কর্মী বুটা সিং মেহমুদপুর কয়েকটি প্রস্তাব উত্থাপন করেন, যা সর্বসম্মতিক্রমে পাস হয়।  প্রস্তাবে যে দাবিগুলি ছিল তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য —আদিবাসী অঞ্চলে অবিলম্বে ‘অপারেশন কাগার’ এবং অন্যান্য সমস্ত আধা-সামরিক অভিযান বন্ধ করতে হবে, আদিবাসী ও মাওবাদীদের ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করা যাবে না। এছাড়া দরিদ্রদের ক্ষতির বিনিময়ে কর্পোরেট লোভ পূরণের জন্য তৈরি জনবিরোধী আর্থিক নীতিগুলি অবিলম্বে বাতিল করতে হবে।

বিশ্বজুড়ে সংহতি, প্রতিরোধের ডাক

মোঘার এই সমাবেশ কেবল আঞ্চলিক দাবির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং এটি বিশ্বজুড়ে সংহতির এক নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। গাজায় ফিলিস্তিনি জনগণের উপর চলা নির্মম গণহত্যার নিন্দা করে এই সমাবেশে একটি বিশেষ প্রস্তাব পাস করা হয়েছে। এর থেকে প্রমাণ হয়, কর্পোরেট পুঁজি এবং রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সংগ্রামের কোনো ভৌগোলিক সীমানা নেই। এই সংহতি এক বৃহত্তর আন্দোলনের জন্ম দিচ্ছে, যা বিশ্বজুড়ে শোষিত ও নিপীড়িত জনগণের কণ্ঠস্বরকে এক করছে।

প্রতিরোধের এটাই সঠিক সময়

মোঘার এই সমাবেশ এক জ্বলন্ত সত্যকে সামনে এনেছে। আদিবাসী অঞ্চল থেকে শুরু করে পঞ্জাবের উর্বর কৃষিজমি পর্যন্ত, কর্পোরেট আগ্রাসন সারা দেশকে গ্রাস করতে চাইছে। আদিবাসীদের উপর যে যুদ্ধ চলছে, তা পঞ্জাবের কৃষকদের জীবন-জীবিকার উপর চলা আগ্রাসনেরই আরেক রূপ। ভারতের শ্রমজীবী মানুষ ও কৃষকরা যদি এই মুহূর্তে ঐক্যবদ্ধ হয়ে রুখে না দাঁড়ায়, তবে এই লোভের আগুন দ্রুতই প্রতিটি রাজ্যকে গ্রাস করবে। মোঘার প্রতিবাদ সভার ঐতিহাসিক বার্তা—যখন রাষ্ট্র তার নিজের জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে, তখন প্রতিরোধের আগুন জ্বলে ওঠা অনিবার্য। আর সেই প্রতিরোধের সঠিক সময় 'কাল' নয়, বরং 'আজ'-ই।

More Articles