মুম্বইয়ের বস্তি থেকে আন্ডারওয়ার্ল্ডের বাদশা! এখন কোথায় আছে দাউদ ইব্রাহিম?
দাউদ আজও অধরা। মুম্বইয়ের সামান্য বস্তিজীবনে যে ছেলেটির অপরাধে হাতেখড়ি, সে আজ প্রৌঢ়।
শুটিংয়ের সেট। প্রস্তুতি চলছে। লাইটস-ক্যামেরা ঠিকঠাক পোজিশনে দাঁড়িয়ে গেলেই টেক নেওয়া হবে। হঠাৎ নির্দেশকের ফোন বেজে উঠল। চাপা গলায় কথাবার্তা। হঠাৎ মেজাজ হারিয়ে নির্দেশক কড়া গলায় জবাব দিলেন, "আপনাকে কে বলল আমি ওদের গ্লোরিফাই করছি? যা বাস্তব, আমি তাই তুলে ধরছি, ব্যাস।"
সিনেমার নাম? 'সত্যা'। নির্দেশক রামগোপাল বর্মা। সিনেমাটি যে ভারতীয় সিনেজগতে এক নতুন জঁর তৈরি করতে চলেছে, তখনও বোঝেনি কেউ। বহু রাজনৈতিক চাপ, আন্ডারওয়ার্ল্ডের হুমকি পেরিয়ে সিনেমাটি তৈরি হয়েছিল। কিন্তু এর পটভূমি অনেকটা বিস্তৃত। মুম্বইয়ের অন্ধকার জগতের ইতিহাস খুব কমদিনের নয়। মাঝে মাঝে সেখান থেকে ছিটকে আসে এক-দু'টি নাম। আমাদের তখন সেদিকে নজর ফেরে— এইমাত্র। দীর্ঘদিন ধরে সমান্তরাল একটি জগতের যাত্রাই একটি বিশ্বখ্যাত নাম নির্মাণে দায়ী— দাউদ ইব্রাহিম।
দাউদ এমন এক ব্যক্তিত্ব, যাকে হন্যে হয়ে খুঁজছে নাকি আন্তর্জাতিক আধিকারিকরা। সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ তাকে নানা সন্ত্রাসবাদী কাণ্ডকারখানার ফিনান্সার ও ভারতের মোস্ট ওয়ান্টেড গ্যাংস্টারের স্বীকৃতি দিয়েছে। সম্প্রতি এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটকে দেওয়া একটি বয়ানে আলিশা পারকর জানিয়েছেন, এই মুহূর্তে দাউদ ঘাঁটি গেড়েছে করাচিতে। এই বয়ানের ওপর ভিত্তি করে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মামলা পোক্ত করছে ভারত। অভিযোগ গণহত্যাকারী অপরাধীকে আশ্রয় দিচ্ছে প্রতিবেশী দেশটি। এখন কথা হলো, কে এই আলিশা পারকর? কেনই বা তাঁর কথার এতখানি গুরুত্ব প্রশাসনের কাছে? জানলে চমকে উঠবেন। দাউদ ইব্রাহিমের আপন বোনের নাম হাসিনা পারকর। মারা গিয়েছেন। তাঁরই ছেলে এই আলিশা পারকর। আলিশার বয়ান অনুযায়ী, ১৯৮৬ নাগাদ ভারত ছেড়ে অন্যত্র পাড়ি দিয়েছিল দাউদ। "দাউদ যখন করাচি পালিয়ে গেলেন, তখনও আমার জন্ম হয়নি। আমার পরিবারের সঙ্গেও তেমন যোগাযোগ ছিল না। তবে মাঝে মাঝে ইদ, দিওয়ালি— ইত্যাদি উৎসবে মেহজাবিন দাউদ ইব্রাহিম, মামি আর মামা যোগাযোগ করতেন। মূলত আমার স্ত্রী আয়েশা এবং আমার বোনেদের সঙ্গে," আলিশার বক্তব্য থেকে আপাতত জানা গিয়েছে এটুকুই। তবে সাধারণ বস্তির একটি ছেলে, কীভাবে ভারতের সবথেকে ক্ষমতাবান গ্যাংস্টার হয়ে উঠল— এই গল্প সত্যিই লোমহর্ষক। বহু ছবি চিত্রায়িত হয়েছে এই বাস্তব রক্তের দাগ ধরে।
আরও পড়ুন: সাধারণ অটোচালক থেকে নৃশংসতম খুনি, তিলে তিলে যেভাবে ত্রাস হয়ে উঠল অটো শঙ্কর?
সালটা ১৯৫৫। মুম্বইয়ের কাসকরে জন্ম দাউদের। বেড়ে ওঠা ডোংরিতে। সেন্ট্রাল মুম্বইয়ের এক বিরাট বস্তি। জনসংখ্যা প্রচুর। সুস্থ জীবনধারণের উপায় ততোধিক অমিল। দাউদের বাবা ইব্রাহিমের ছিল পুলিশে চাকরি। কনস্টেবল। তারপরেও ঠাঁই সেই বস্তিতেই। সামান্য কনস্টেবলের আর ক'টাকা মাইনে! বস্তির সেই পরিবেশেই শৈশব কেটেছে। আর ধীরে ধীরে বাবার থেকে দূরে সম্পূর্ণ উল্টোপথে একটু একটু পা বাড়িয়েছে দাউদ। চুরি, ডাকাতি, বাটপাড়ি— শৈশব থেকেই হাত পেকেছে অপরাধে। যখন তার বয়স ১৯, তখন হঠাৎ করেই একটা বড় সুযোগ এসে গেল। তখন মুম্বইয়ে হাজি মস্তানের একছত্র আধিপত্য। সেই মাপের 'ডন' শহরে দ্বিতীয় নেই। তার হয়ে কাজ করতে শুরু করল দাউদ। একটা কুরিয়ার লুঠ করে দুই লাখ ডলার তুলে নিয়ে এল ডেরায়। একসঙ্গে এতগুলো টাকা লুঠ করে হাজি মস্তানের সুনজরে পড়ে যায় সে সহজেই। এদিকে মুম্বই পুলিশও তখন বসে নেই। যেনতেন প্রকারেণ হাজি মস্তানকে ধরার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তারা। দাউদ দলে নতুন। তার ওপর হাজি মস্তানের প্রিয়পাত্র। উচ্চাকাঙ্ক্ষাও কম নয়। এইসব দেখেশুনে মুম্বই পুলিশের এক বড় অফিসার দাউদকে ব্যবহার করার পরিকল্পনা করলেন। দাউদকে দলে টেনে যদি ভাঙন ধরানো যায়, তবে হাজি মস্তানকে গ্রেফতার করা অনেকটাই সহজ হয়ে যায়। অফিসার চরিত্র বুঝতে খুব একটা ভুল করেননি। রাজ্যের লোভ দাউদের ছিল। ফলে পুলিশের আশকারা পেয়ে মস্তানের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণা করল সে। মুম্বইয়ের অন্ধকার জগতে সে এক ভয়ংকর অধ্যায়। এই লড়াই চলেছিল দীর্ঘদিন।
১৯৮১ সাল। দাউদ তার ভাই সাবিরকে নিয়ে একটি গ্যাস স্টেশনে এসেছেন। আচমকা ঘিরে ধরল তিন আততায়ী। গুলির পর গুলি। অতর্কিতে হামলায় সাবির মারা গেল। কোনওরকমে প্রাণ হাতে নিয়ে পালিয়ে এল দাউদ। কিন্তু মাথায় তখন তার খুন চেপে গিয়েছে। ভাতৃহত্যার বদলা সে নেবেই। কিন্তু কারা হামলা করেছিল? মুম্বইয়ের বিশাল জনসমুদ্রে তারা বুদবুদের মতোই মিলিয়ে গিয়েছে। শুরু হল খোঁজ। অন্ধকার জগত তোলপাড় করে ফেলল দাউদ। তিনটি বছর। তিন জন আততায়ীর শেষ চিহ্নটুকুও রইল না। দাউদকে মস্তানের বিরুদ্ধে উসকেছিল মুম্বই পুলিশই। কিন্তু যে হারে রক্তপাত বেড়ে চলেছিল, তা নিয়ন্ত্রণের সাধ্য তাদের ছিল না। ফলে তুলনায় দুর্বল প্রতিপক্ষ দাউদকেই খুনের মামলায় অভিযুক্ত করল পুলিশ। বিপদ বুঝে গা ঢাকা দিল সে। ততদিনে দুবাইয়ে একটি বিরাট বাংলো কিনেছে, নাম রেখেছে 'হোয়াইট হাউজ'। সেখানে গিয়েই বসবাস শুরু করল দাউদ ইব্রাহিম। অপরাধ জগতের বিভিন্ন মাথা থেকে নামকরা অভিনেতা—সবার আনাগোনা ছিল সেই প্রাসাদে। এদিকে তিলে তিলে গড়ে তোলা 'ডি কোম্পানি'-র ভার এসে পড়ল দাউদের অনুচর ছোটা রাজনের ওপর।
এক দশকের মধ্যে ভারতের অর্থনীতি বদলে গেল। উদারনীতিবাদের কল্যাণে বিদেশি পুঁজি ঢুকে পড়ল দেদার। বিদেশি জিনিস বাজারে এমনিই পাওয়া যায়। জাপান থেকে আসা টিভি, চিনা রেডিও লোকে আর ব্ল্যাকে কেনে না। দাউদের বিদেশ থেকে পাচার করা মালের আনাগোনা মুম্বইয়ের ডকেই সীমিত হয়ে পড়ল। ফলে অপরাধের ধরণ বদলাল। অন্ধকার জগৎ আরও মরিয়া। ১৯৯১-এই মুম্বই পুলিশ এবং ডি কোম্পানির মধ্যে খণ্ডযুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। প্রচুর গুলিগোলা চলল। ভারতের সমস্ত সংবাদমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ল খবর। এরপরে ধর্মের জিগিরে ব্যবসার গন্ধ পেল দাউদ। '৯২ সালে উন্মত্ত হিন্দু দাঙ্গাবাজরা বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলল। পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে মুম্বইয়ে ১৩ খানা বিস্ফোরণে জবাব দিল দাউদ। হতাহতর সংখ্যা প্রায় ২৫০। হিন্দু-মুসলিম মেরুকরণ আরও জোরদার হলো। লাভের গুড় খেল বিজেপি-আরএসএস। এদিকে এফবিআই এবং ইন্টারপোল দাউদকে হন্যে হয়ে খুঁজছে। তাদের মোস্ট ওয়ান্টেড লিস্টে জায়গা করে নিয়েছে সে। দুবাই ছেড়ে করাচিতে এসে গা ঢাকা দিল দাউদ।
সেখানে হাফিজ সঈদদের লস্কর-এ-তইবা সন্ত্রাসবাদী দলের সঙ্গে যুক্ত হলো সে। করাচি থেকেই বিশ্বের নানান জায়গায় সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ চলল। ২০০৩ নাগাদ ভারত এবং আমেরিকা তাকে গ্লোবাল টেররিস্ট আখ্যা দিল। দাউদের মাথার দাম তখন ২৫ মিলিয়ন ডলার, অর্থাৎ বর্তমানের নিরিখে প্রায় ২০০ কোটি টাকা। ২০০৮ নাগাদ পাকিস্তান সরকার লস্কর-এ-তইবাকে অবৈধ ঘোষণা করল। কিন্তু তাতে লাভ হলো না কিছু। এরপরেও তাজ হোটেলে হামলা চলল, এল ২৬/১১-র সেই কুখ্যাত অধ্যায়। ২০১৩ নাগাদ জানা গিয়েছিল আইপিএল-এ একটি বিরাট জুয়াচক্র চালাচ্ছিল দাউদ। গোটা বিশ্বে এই ব্যবসার প্রায় তিন ভাগের দুই ভাগই তারা নিয়ন্ত্রণ করত।
বছরদুয়েকের মধ্যে ইন্দোনেশিয়ার বালি থেকে ছোটা রাজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। কিন্তু দাউদ আজও অধরা। মুম্বইয়ের সামান্য বস্তিজীবনে যে ছেলেটির অপরাধে হাতেখড়ি, সে আজ প্রৌঢ়। পৃথিবীর সমস্ত প্রশাসন এড়িয়ে, অন্ধকারে থেকে আন্তর্জাতিক অপরাধচক্র চালনা করছে নির্বিঘ্নে। এতখানি জীবন গরাদের বাইরে মুক্ত বাতাসে শ্বাস নিয়েই কাটিয়ে দিল দাউদ ইব্রাহিম, অপরাধজগতে এ এক দৃষ্টান্ত বইকি!