"আমি চাইলে ইন্দিরা গান্ধী নাচবেন," কেন বিতর্কিত এই মুখ্যমন্ত্রীকে সম্মান জানিয়েছিল ৩ টি দেশ!
Biju Patnaik: প্রধানমন্ত্রীর আদেশ মতো, একটি পুরনো ডাকোটা প্লেন নিয়ে জাকার্তা পৌঁছন বিজু। এই মিশনে তাঁর সহপাইলট ছিলেন, তাঁর স্ত্রী জ্ঞানদেবী।
আজ এক নেতার গল্প শোনানো যাক। এক নেতা, যিনি ছোট থেকেই অ্যাডভেঞ্চার প্রিয়। অ্যাডভেঞ্চারের নেশাতেই হয়ে যান পাইলট। পাইলট হয়ে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামেও অংশগ্রহণ করলেন। আসলে একটি নয়, দু'টি দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছিলেন তিনি। স্বাধীনতা আন্দোলন চলাকালীন তাঁকে জেলবন্দি করেও রাখা হয়। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, বিমানে করে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের লিফলেট নাকি শহরে শহরে ছড়িয়ে দিতেন তিনি। তবে জেল থেকে ছাড়া পেয়েই কাশ্মীরের ভারতে অন্তর্ভুক্তিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন তিনি। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে রাজনীতিতে সক্রিয় হন এবং দু'বার নিজের রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীও হন। একইসঙ্গে ক্ষমতার শীর্ষে বসে এমন একটি বিতর্কিত মন্তব্য করে বসেন যার কারণে তাঁর রাজপাট চলেও যায়। কথা হচ্ছে ওড়িশার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বিজু পট্টনায়েকের, যার মৃত্যুর সময় তাঁর পার্থিব শরীরের উপর জড়ানো ছিল তিনটি দেশের জাতীয় পতাকা!
১৯১৬ সালে ওড়িশার গঞ্জন গ্রামে জন্ম হয় ‘বিজুবাবু’-র। ওড়িশায় ভালোবেসে তাঁকে এই নামেই ডাকা হয়। ছেলে যে অতিরিক্ত অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় তা ছোটবেলা থেকেই বুঝতে পেরেছিলেন বাবা-মা। না হলে মাত্র ১৩-১৪ বছর বয়সে কটক থেকে সাইকেল চালিয়ে পেশোয়ার পর্যন্ত যাওয়ার সাহস কোনও সাধারণ কিশোরই দেখায় না। ১৮ বছর বয়সে দিল্লির ফ্লাইং স্কুলে তাঁকে ভর্তি করে দেওয়া হয় পাইলটের প্রশিক্ষণের জন্য। এই সময় তাঁর পরিচয় হয় জ্ঞানদেবীর সঙ্গে, পরবর্তীকালে তিনিই হন বিজুর জীবনসঙ্গী। এই ফ্লাইং স্কুলেই প্রথমে তাঁদের পরিচয় এবং বন্ধুত্ব হয়। ধীরে ধীরে বন্ধুত্ব প্রেমের সম্পর্কে গড়ায়। ১৯৩৯ সালে দু'জনে বিয়েও করেন। তাঁদের তিন সন্তান, প্রেম পট্টনায়েক, নবীন পট্টনায়েক এবং স্বনামধন্য লেখিকা গীতা পট্টনায়েক (মেহতা)। পাইলট হিসেবে বিজু পট্টনায়েক নিজের জীবনের প্রথম বড় মিশন করেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। সেই সময় রেঙ্গুনে ব্রিটিশ সেনা এবং জাপান ও আজাদ হিন্দ ফৌজের সেনাদের মধ্যে লড়াই হচ্ছে। বিজুবাবুর উপর দায়িত্ব পড়ল সেখানে আটকে পড়া ভারতীয়দের সুরক্ষিতভাবে বের করে আনার। বাড়িতে নববিবাহিত পত্নীকে রেখে দায়িত্ব পালন করতে বেরিয়ে পড়লেন বিজু। এই মিশনে মোট ৮ বার রেঙ্গুন যাতায়াত করেন তিনি। এর মধ্যে বেশ কয়েকবার তাঁর উপর আক্রমণও হয়। কিন্তু অত্যন্ত কৌশলী পাইলট বিজু খুব সহজেই সেই গোলাগুলির মধ্যে দিয়েও সুরক্ষিতভাবে বের করে আনেন ভারতীয়দের।
আরও পড়ুন- নিজেরই মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে ধর্না-অনশনে বসেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের এই মুখ্যমন্ত্রী! কেন?
১৯৪৭ সালের ১৫ অগাস্ট স্বাধীন গেল ভারতবর্ষ। একদিন আগেই স্বাধীন হলো পাকিস্তান। কিন্তু কাশ্মীর কারও সঙ্গেই জুড়তে অস্বীকার করে এবং স্বাধীন হয়েই থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। এক মাস গড়াতে না গড়াতেই পরিস্থিতি হাতের বাইরে বেরিয়ে যায়। পাকিস্তানি হানাদাররা ঢুকে পড়ে কাশ্মীরে এবং কাশ্মীরের রাজা হরি সিং ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুকে অনুরোধ করেন সাহায্যের জন্য। একই সঙ্গে তিনি আশ্বস্ত করেন কাশ্মীর ভারতের সঙ্গেই জুড়বে। বিমানবাহিনী পাঠানো হয় কাশ্মীরে। কিন্তু দলের নেতৃত্ব দেবে কে? জওহরলাল নেহরুর নজর পড়ে রেঙ্গুনের নায়ক বিজু পট্টনায়েকের উপর। এরপর সেপ্টেম্বর ১৯৪৭-এ বিজু পট্টনায়েকের নেতৃত্বে কাশ্মীরে ঢুকে পড়ে ভারতীয় বায়ুসেনা। ২৭ অক্টোবর ১৯৪৭ সরকারিভাবে ভারতের অংশ হয় কাশ্মীর।
ভারতের স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে, সারা বিশ্বে ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অন্যতম মুখ হয়ে উঠেছিলেন পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু। ইন্দোনেশিয়ার স্বাধীনতা সংগ্রামী এবং সেই দেশের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট সুকর্ণ ছিলেন নেহরুর বন্ধু। ১৯৪৬ সালের শেষ ভাগ আসতে আসতে ডাচদের হাত থেকে ইন্দোনেশিয়ার অধিকাংশ অংশ ছাড়িয়ে এনেছিলেন তিনি। কিন্তু ১৯৪৮ সালের গোড়ার দিকে ফের ইন্দোনেশিয়া আক্রমণ করে ডাচরা। এই সময় সুকর্ণ নিজের বন্ধু নেহরুকে অনুরোধ করেন, ইন্দোনেশিয়ার প্রথম সারির নেতা এবং তাঁদের পরিবারকে ভারতে আশ্রয় দেওয়ার জন্য। নেহরু রাজি হয়ে যান। সুকর্ণ-সহ অন্যান্য নেতা এবং তাঁদের পরিবারকে যুদ্ধবিধ্বস্ত ইন্দোনেশিয়া থেকে নিরাপদে ভারতে আনার দায়িত্ব পড়ে বিজু পট্টনায়েকের উপর। বছর দু'য়েক আগেও ডাচদের বিরুদ্ধে লড়াইতে সুকর্ণর পাশে ছিলেন বিজু। প্রধানমন্ত্রীর আদেশ মতো, একটি পুরনো ডাকোটা প্লেন নিয়ে জাকার্তা পৌঁছন বিজু। এই মিশনে তাঁর সহপাইলট ছিলেন, তাঁর স্ত্রী জ্ঞানদেবী। শোনা যায়, জাকার্তায় অবতরণের আগে বারবার ডাচেদের মিসাইল ধেয়ে আসছিল তাঁদের দিকে। কোনওভাবে সেগুলি বাঁচিয়ে জাকার্তায় নামেন তাঁরা। টপ গান সিনেমায় টম ক্রুজ যা পর্দায় করেছিলেন, তাই বাস্তবে করে দেখিয়েছিলেন বিজু পট্টনায়েক। জাকার্তায় অবতরণ করে অত্যন্ত সন্তর্পণে সুকর্ণ-সহ অন্যান্য রাজনেতা এবং তাঁদের পরিবারকে নিয়ে দিল্লি ফিরে আসেন বিজু। সেই থেকে সুকর্ণর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব হয়ে যায় বিজুর। এমনকী সুকর্ণের কন্যা মেঘবতী সুকর্ণপুত্রীর নামকরণও করেছিলেন বিজু। বর্তমানে দিল্লির ইন্দোনেশিয়া এম্ব্যাসির একটি ঘর বরাদ্দ করা বিজু পট্টনায়েকের নামেই।
স্বাধীনতার পর পঞ্চাশের দশকে, কংগ্রেসের হাত ধরে সক্রিয় রাজনীতিতে যোগ দেন বিজু পট্টনায়েক। অল্প সময়ের মধ্যেই তাঁকে ওড়িশা প্রদেশ কংগ্রেসের সভাপতি করে দেওয়া হয়। এরপর ১৯৬১ সালে ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী হন বিজু পট্টনায়েক। ১৯৬৩ পর্যন্ত তিনি মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্বভার সামলে ছিলেন। এরপর তাঁকে সরিয়ে বীরেন মিত্র হন ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী। সেই থেকেই কংগ্রেসের সঙ্গে মনোমালিন্য হতে শুরু করে তাঁর। তবে তখনও ওড়িশায় শেষ কথা ছিলেন বিজু পট্টনায়েকই। কিন্তু তাল কাটল ১৯৬৯ সালে। কোনও কলেজের এক সভায় বক্তৃতা দিতে গিয়ে বিজু বলে বসেন, “আমি চাইলে ইন্দিরা গান্ধী স্টেজে এসে নেচে দিয়ে যাবেন।” স্বভাবতই দেশের প্রধানমন্ত্রী সম্বন্ধে এহেন মন্তব্য বরদাস্ত করেনি দল, তাঁকে বহিস্কার করা হয় কংগ্রেস থেকে। এরপর নিজের নতুন একটি রাজনৈতিক দল উৎকল কংগ্রেস স্থাপন করেন বিজু পট্টনায়েক।
আরও পড়ুন-বাদ পড়ল জাতীয় সঙ্গীতও, যেভাবে ‘একদিনের মুখ্যমন্ত্রী’ হয়েছিলেন জগদম্বিকা পাল
১৯৭৪ সালে উৎকল কংগ্রেসের বিলয় হয়ে যায় চরণ সিংয়ের ভারতীয় লোক দলের সঙ্গে। ১৯৭৫ সালে জরুরি অবস্থার সময় জেলে যান বিজু। ১৯৭৭ সালে জরুরি অবস্থার পরবর্তী সময়ে, দেশে জনতা পার্টির সরকার তৈরি হয়। মোরারজি দেশাই এবং চরণ সিংয়ের সরকারে ইস্পাত এবং খনন মন্ত্রী হন বিজু পট্টনায়েক। বিজুবাবু বরাবরই মিল, কারখানা, বন্দর, বিমানবন্দর গড়ার পক্ষপাতী ছিলেন। পারাদ্বীপ বন্দর তাঁরই দান। ১৯৭৮-৭৯ সালে মারুতি উদ্যোগ লিমিটেড গড়তে সক্রিয় হন সঞ্জয় গান্ধী। এমারজেন্সির সময় সঞ্জয় গান্ধীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার জন্যই জেলে যেতে হয়েছিল বিজু পট্টনায়েককে। তবুও, পরবর্তীকালে এই মারুতি উদ্যোগে সঞ্জয় গান্ধীকে সমর্থন করেছিলেন তিনি। এর ফলে মোরারজি দেশাইয়ের বিরাগভাজন হন তিনি। পরবর্তীকালে জনতা পার্টি দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেলে, চরণ সিংয়ের শিবিরেই যান বিজু। রাজনৈতিক জীবনে খুব কম নেতার সঙ্গেই তাঁর বনিবনা হতো। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নেতাদের সঙ্গে ঝামেলা লেগেই থাকত। রাজনৈতিক মহলে অনেকে উৎকল-ষণ্ড বলতেন বিজুকে।
পরবর্তী সময়ে ১৯৮৯-৯০ নাগাদ দিল্লিতে ভিপি সিংয়ের জনতা দল সরকারেও অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নেতা ছিলেন বিজু পট্টনায়েক। মনে করা হয়, ১৯৮৯ সালে চন্দ্রশেখরকে মাত দিয়ে ভিপি সিংকে প্রধানমন্ত্রী করার ক্ষেত্রে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন বিজু পট্টনায়েক। সেই বিজু পট্টনায়েকই ১৯৯০ সালে মণ্ডল কমিশন লাগু হওয়ার পর খোলাখুলি নিন্দা করেছিলেন ভিপি সিংয়ের। প্রসঙ্গত, ১৯৯০ থেকে ’৯৫ পর্যন্ত দ্বিতীয়বার ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী হন তিনি। ১৯৯৬ সালে বিজু পট্টনায়েককে ইন্দোনেশিয়ার সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মান, বোট্যাং জেহা উতামা (Bintang Jasa Utama) প্রদান করা হয়। ১৯৯৭ সালের ১৭ এপ্রিল, এই ৬ ফুট ২ ইঞ্চির দীর্ঘদেহী মানুষটির মৃত্যু হয়। তাঁর পুত্র নবীন পট্টনায়েক বর্তমানে ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী। বিজুবাবুর প্রয়াণের পর তাঁর দেহের উপর তিনটি দেশের জাতীয় পতাকা রাখা হয় - ভারত, ইন্দোনেশিয়া এবং রাশিয়া (দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রশক্তির হয়ে যুদ্ধ করার জন্য)। তাঁর অসামান্য বীরত্বের জন্য আজও ভারতের পাশাপাশি ইন্দোনেশিয়াতেও তাঁকে সম্মান করা হয়।