শান্তিনিকেতন থেকে তিহারের জেল! ইন্দিরা এবং গায়ত্রী দেবীর সম্পর্ক ছিল সাপে-নেউলে

Gayatri Devi’s relationship with Indira Gandhi: এর ফলেই একসময় স্বাধীন পার্টি থেকে ১৯৬২ সালের লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে বিপুল ভোটে জয়ী হওয়া গায়ত্রী দেবী রাজনীতির ময়দান থেকে চিরকালের মতো সরে দাঁড়ান।

সাপে-নেউলের সম্পর্ক বলতে গোটা পৃথিবী মোটামুটি যে সম্পর্কের ঊষ্ণতাকে বোঝে, খানিকটা সেরকম সম্পর্কই হয়তো ছিল আমাদের প্রাক-স্বাধীন ও স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে ভারতবর্ষের দুই খ্যাতিমান নারীর মধ্যে। টাইটেল দেখে সহজেই অনুমান করা যাচ্ছে, এ দু-জন আর কেউ নন— ভারতের প্রাক্তন ও একমাত্র নারী প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এবং জয়পুরের রাজমাতা তথা কোচবিহারের রাজকুমারী গায়ত্রী দেবী।

যদিও তাঁদের দু-জনের মধ্যে ব্যক্তিগত সম্পর্ক কেমন ছিল, তা নিয়ে তাঁরা কখনোই প্রকাশ্যে মুখ খোলেননি। এমনকি গায়ত্রী দেবীও তাঁর আত্মজীবনী 'A Princess Remembers' গ্রন্থে ইন্দিরা গান্ধী সম্পর্কে কেবলই উল্লেখ করেছেন—ইন্দিরার কিছু রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নতুন স্বাধীনতা প্রাপ্ত দেশকে প্রশ্নের মুখোমুখি করেছে এবং বেকায়দায় ফেলেছে ভারতীয় সংবিধানের ‘সমাজতান্ত্রিক, গণতান্ত্রিক’ চেতনাকে। এসব সিদ্ধান্তের তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন গায়ত্রী। তবে এর বাইরে গিয়ে পরস্পর সম্পর্কে বিশেষ কোনো মন্তব্য নেই।

তবুও, ভারতে ইন্দিরা ও গায়ত্রীর দ্বন্দ্ব বহুলচর্চিত একটি বিষয়। যার চূড়ান্ত পরিণতি সম্ভবত হয়েছিল কোচবিহার রাজদুহিতা তথা জয়পুরের রাজমহিমায় মোড়া রানীর প্রায় সাত মাসের তিহার জেলবাসে, ১৯৭৫ সালের এমার্জেন্সি পরিস্থিতিতে। ওই বছরের ১৩ জুলাই তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। ইন্দিরা সরকারের অভিযোগ ছিল মূলত আয়কর আইন ভঙ্গ ও সরকারের তীব্র বিরোধিতা। এর ফলেই একসময় স্বাধীন পার্টি থেকে ১৯৬২ সালের লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে বিপুল ভোটে জয়ী হওয়া গায়ত্রী দেবী রাজনীতির ময়দান থেকে চিরকালের মতো সরে দাঁড়ান।তবে মহারানী গায়ত্রী দেবীর জীবন-গবেষক শান্তারাম রাও-সহ অনেকেই মনে করেন, গায়ত্রীর রাজনীতি ছাড়ার পেছনে তাঁর শারীরিক অসুস্থতার পাশাপাশি দায়ী ছিল ভারতীয় রাজনীতির ইতিহাসের সবচেয়ে অন্ধকার সময়— এমার্জেন্সি।

আরও পড়ুন-  গায়ত্রী স্পিভাকদের নিয়ে আমরা কী করি?

এই দুই নারীর সম্পর্ক আলোচনা করতে গেলে প্রথমেই উঠে আসে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত শান্তিনিকেতনের কথা। বলা হয়ে থাকে, সেখানেই লুকিয়ে আছে তাঁদের বন্ধুত্ব বা বলা ভালো, শত্রুতার শুরুর কাহিনী। ১৮৬৩ সালে রবি ঠাকুরের বাবা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর রায়পুরের জমিদার ভুবন সিংহের কাছ থেকে দুটি ছাতিমগাছ-সহ ২০ একর জমি বার্ষিক ৫০,০০০ টাকায় ইজারায় কিনেছিলেন। পরবর্তীতে সেখানেই রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতন প্রতিষ্ঠা করেন।

১৯৩৪ সালের জুলাই মাসে শান্তিনিকেতনে পড়তে আসেন ১৭ বছরের ইন্দিরা (রবীন্দ্রনাথ ডাকতেন প্রিয়দর্শিনী বলে)। জওহরলাল ও কমলা নেহেরুর একমাত্র কন্যা ইন্দিরা ভর্তি হলেন আই.এ. কোর্সে এবং থাকলেন তৎকালীন একমাত্র ছাত্রীনিবাস ‘শ্রীসদনে’। তাঁর সহপাঠীদের মধ্যে ছিলেন অশোকা সিংহ (প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের ছোট পিসিমা), জয়া আপ্পাস্বামী (স্বাধীনতা সংগ্রামী ও খ্রিষ্টান ধর্মতত্ত্ববিদ জেসুদায়েন আপ্পাস্বামীর বড় বোন), সোমা যোশী (প্রখ্যাত চিকিৎসক আনন্দীবাই যোশীর ননদ) প্রমুখ।

একই বছরই কোচবিহার রাজ্যের তিন রাজকন্যা—ইলা, গায়ত্রী ও মেনকা— এসে ভর্তি হন শান্তিনিকেতনে। তাঁদের ঠাকুমা মহারানী সুনীতি দেবী ছিলেন ব্রাহ্মসমাজ নেতা কেশবচন্দ্র সেনের কন্যা। তাঁদের পরিবারের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ও ঠাকুরবাড়ির সম্পর্ক ছিল নিবিড়। তিন বোন প্রথমে ইউরোপের লসান শহরে পড়াশোনা করলেও পরবর্তীতে দেশীয় সাহিত্য ও শিল্পকলা শিখতে শান্তিনিকেতনে আসেন। তাঁদের জন্যও শ্রীসদনেই ব্যবস্থা হয়— প্রাসাদের বিলাসিতা ছেড়ে, কয়েক বছরের জন্য তাঁদেরও কাটাতে হয়েছিল হোস্টেলের অনাড়ম্বর জীবন।

শ্রীসদনে আবাসিকদের মেঝেতে মাদুর বিছিয়ে ঘুমোতে হত, শীতের দিনেও কুয়োর জল ব্যবহার করে স্নান করতে হত, সাধারণ টয়লেট ভাগাভাগি করতে হত এবং আশ্রম প্রাঙ্গণে চলাফেরা করতে হত খালি পায়ে। গায়ত্রী ছিলেন টমবয় ধরনের—সাইকেল চালিয়ে সারা আশ্রম চষে বেড়াতেন। মেনকা শিখতেন খোয়াইয়ের বাউলশিল্পীদের কাছে গান, আর ইলা ছবি আঁকা শিখতে শুরু করেন নন্দলাল বসুর কাছে। প্রথমদিকে সব ঠিক থাকলেও শিগগিরই গোলমাল বাধে। প্রথমে অনেকে একে কিশোরীবেলার ছেলেমানুষি ভেবেছিলেন। কিন্তু পরে পরিস্থিতি এমন হয় যে, শ্রীসদনের দায়িত্বে থাকা কবিগুরুর স্নেহভাজন রানুচন্দ নিজেই অতিষ্ঠ হয়ে পড়েন। রানুর কবিকে লেখা চিঠি এবং অশোকা সিংহের আত্মজীবনীতে উল্লেখ আছে— প্রথম সংঘাতের সূত্রপাত হয় শিবপুজা নিয়ে।

কোচবিহার রাজপরিবার গোড়া হিন্দু শৈব হলেও, মহারানী সুনীতি দেবী ছিলেন ব্রাহ্মসমাজের কন্যা। ফলে রাজপরিবার ব্রাহ্মধর্মের সঙ্গে যুক্ত হয়। কিন্তু পরবর্তীতে গায়ত্রীর মা মহারানী ইন্দিরা দেবী (বরোদার রাজকুমারী) শিবপুজা বাধ্যতামূলক করেন। প্রতিদিন সকালে তিন রাজকন্যাকে রুপোর থালায় পাথরের শিবলিঙ্গ পুজো করতে হত। রবীন্দ্রনাথ বিষয়টি জানতে পেরে তাঁদের মূর্তিপুজা বন্ধ করতে বলেন। প্রথমে তাঁরা তা মানলেও পরে আবার চালিয়ে যান। আর এই খবর কবিগুরুর কাছে পৌঁছে দেন ইন্দিরা। ফলে মহারানী ইন্দিরা দেবীকে পর্যন্ত ছুটে আসতে হয়েছিল শান্তিনিকেতনে। যদিও রবীন্দ্রনাথের ধৈর্য ও ঔদার্যের কারণে সমস্যা মিটে যায়, তবু সম্পর্কের তিক্ততা রয়ে যায়।

আরেকবার বড় গোল বাঁধে খাওয়ার নিয়ে। ইন্দিরা অভ্যস্ত ছিলেন ইউরোপীয় ধাঁচের প্রাতরাশে (বিব্রাউন ব্রেড, মাখন, টাটকা ফল)। কিন্তু শান্তিনিকেতনে মিলত ডাল-পুরি কিংবা চিঁড়ে-দই-কলা। ইন্দিরা বাবাকে চিঠিতে অভিযোগ করলে জওহরলাল তাঁকে বোঝান, আশ্রমিক অনাড়ম্বর জীবন ভবিষ্যতে তাঁকে কর্মনিষ্ঠ ও পরিশ্রমী করে তুলবে। তবু ইন্দিরা সর্বসমক্ষে খাবারের দৈন্যতা নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করতেন, এমনকি কর্তৃপক্ষকে অপমান করতেন বলেও অভিযোগ ওঠে। অন্যদিকে, তিন রাজকন্যা প্রায়ই অর্ধাহারে দিন কাটাতেন। স্থানীয় অভিভাবিকা বিমলা রায় কবিগুরুকে চিঠিতে উল্লেখ করেন, দৈনন্দিন খাবারের ঘাটতি ও অপচয়ের জন্য দায়ী ছিলেন জাতীয় কংগ্রেসের এক প্রভাবশালী নেতার কন্যা—পরোক্ষে ইঙ্গিত ছিল ইন্দিরার দিকেই।

আরও পড়ুন- নিজেকে নস্যাৎ করতে শেখান গায়ত্রী

তৃতীয় ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংঘাতের কথা উঠে আসে মহারানী নিরুপমা দেবীর স্মৃতিচারণা থেকে। তিনি লেখেন, ১৯৩৪ সালের প্রথম বর্ষের পরীক্ষায় গায়ত্রী ইতিহাস ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানে চমৎকার ফল করলে, ইন্দিরা ও তাঁর কিছু সহপাঠী খোলাখুলি অসন্তোষ প্রকাশ করেন। এতে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন গায়ত্রী। পরবর্তীতে সাংবাদিক খুশবন্ত সিং মন্তব্য করেন—

“ইন্দিরা গান্ধী সমসাময়িক নারীদের মধ্যে অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠতে চাইতেন এবং প্রয়োজনে অত্যন্ত ঘৃণ্য পথও অবলম্বন করতেন।”

যদিও A Princess Remembers গ্রন্থে শান্তিনিকেতনের দিনগুলো গায়ত্রী দেবী বেশ সুখের স্মৃতিতেই বর্ণনা করেছেন। কিন্তু বাস্তবে সেই সময় থেকেই তাঁদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়।

ইন্দিরা পড়াশোনা শেষ হওয়ার আগেই বাবার চিঠি অনুযায়ী অসুস্থ মায়ের চিকিৎসার জন্য বিলেতে যান। বিদায়ের সময় রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন—

“It is with a heavy heart that we bid farewell to Indira. She has been such an asset to our organization.”

অন্যদিকে পড়াশোনা শেষে গায়ত্রীর বিয়ে হয় জয়পুরের রাজা সাওয়াই মান সিংহ (দ্বিতীয়)-এর সঙ্গে। ফলে দু-জনেই শান্তিনিকেতন থেকে দূরে চলে যান। কিন্তু ভাগ্য তাঁদের ফের মিলিয়েছিল রাজনীতির মঞ্চে। সেখানে তাঁরা মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিলেন প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে। একদিকে রাষ্ট্রক্ষমতার শীর্ষে ইন্দিরা গান্ধী, অন্যদিকে বিরোধীদলের জনপ্রিয় সাংসদ গায়ত্রী দেবী। তখন তাঁদের সম্পর্কের মধ্যে উষ্ণতা বা পুরোনো দিনের স্মৃতিচারণ ছিল না— ছিল কেবল রাজনৈতিক আদর্শের তীব্র সংঘাত।

একসময়কার শান্তিনিকেতনের এই দুই সহপাঠিনী নারী ভারতের ইতিহাসে রয়ে গেছেন একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবেই— শুরুর জায়গা একই হলেও, শেষের জায়গা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন।

More Articles