গায়ত্রী স্পিভাকদের নিয়ে আমরা কী করি?

গায়ত্রী স্পিভাকদের নিয়ে এই আমরাই নিরলস তর্ক করি। মুক্তির দাবি, আজাদির স্লোগানে অটুট-আস্থা নিজের উত্তেজিত যুবক-মনের সঙ্গে তর্ক করি। বলে বসি, স্লোগান যথেষ্ট নয়।

গায়ত্রী স্পিভাকদের নিয়ে আমরা কী করি?

একবাক্যের উত্তর: একটেরে রাজনীতির শ্লোগানশানিত শাঁখের করাতে মাথা কাটা যাওয়া থেকে বাঁচতে সাহায্য নিই গায়ত্রী স্পিভাকদের থেকে। প্রশ্ন সহজ, উত্তরও জানা হল। এর পরেও ইনস্ক্রিপ্ট-এর যে পাঠকবন্ধুরা লেখার বাকিটুকু পড়ার জন্য এগোচ্ছেন, আপনার কাছে বিনীত আর্জি, অনুগ্রহ করে একটু থমকে দাঁড়ান।

ভেবে বলুন, কেমন লাগল গোড়াতেই এই নির্দেশ থুড়ি আর্জি পড়ে? আমরা কেউ কেউ তো জানি, সংবাদপত্রের সম্পাদকীয় বিভাগের একটি শিক্ষা: পাঠককে এহেন ভঙ্গিতে নির্দেশ দেওয়া ন-বিধি। 
-কেন?
-কারণ, লেখকের হামবড়াইভাব পাঠকের পক্ষে অপমানজনক। 
-কিন্তু অমুক নিরীক্ষামূলক উপন্যাসে তমুক বিপ্লবী লেখক যে …
-না, রাজনৈতিক ভাবেও এটা মেনে নেওয়া যায় না। খবরের কাগজ আমজনতার জন্য। আপনাদের মত পাঁচতারা বিশ্ববিদ্যালয়পুষ্ট ছাড়াও অনেকে তা পড়েন। কর্তৃত্ববাদী লেখক উচ্চতর অবস্থান থেকে নির্দেশ দিয়ে পাঠককে বেঁধে রাখতে পারেন না। এ জিনিস অগণতান্ত্রিক। পাঠকের পাঠ-স্বাধীনতাকে ব্যাহত করা তো স্বৈরাচারের নামান্তর।
-কিন্তু পাঠক মানেই আতুপুতু, স্পর্শকাতর, অবোধ, নাবালক এমনটাই বা কেন ধরে নিচ্ছি আমরা? আর এই যুক্তিতে তো আদৌ লেখালেখি করা থেকে সংবাদপত্র ছাপা সবই অগণতান্ত্রিক। সবকিছুই কোনো না কোনোভাবে পাঠকের নিষ্পাপ মনে দাগ কাটছে। হে সম্পাদক, পাঠকের সম্ভাব্য অভিমানের দুশ্চিন্তায় লেখকের স্বাভিমানকে রাজনৈতিক ভাঁজে কর্তৃত্ববাদী দাগিয়ে দিয়ে সম্পাদকীয় নীতি নির্ধারণ করার পেছনে কুড়ে খায় যে গোপন ভয় তা আসলে কীসের? ব্যবসা হারানোর?

না, “সম্পাদকীয় বেশি বরণীয়, আমাদের ধারণা চেয়ে” শুনুন বা না-শুনুন, শেষের গ্রামভারী বাক্যবন্ধটি বেতনভুক কোনো সংবাদকর্মী চট করে বলে উঠবেন না। এই সংলাপে কে ঠিক, কে ভুল তা যাচাই করতে বসা অবান্তর, নিরর্থক। আপাতত এই নাট্যাংশে কী দেখছি? দেখছি, এমনকী মুক্তিকামী গণতান্ত্রিকতার প্রায়-স্বতঃসিদ্ধ রাজনৈতিক বচনও কীভাবে শাঁখের করাত হয়ে উঠতে পারে। আসতে যেতে মাথা তো কাটবেই, কারুর কারুর বরাতও খুলে দেবে। 

আরও পড়ুন:কেন গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাকের হলবার্গ পুরস্কার প্রাপ্তি এত গুরুত্বপূর্ণ? 

আজ নয়, বেশ কয়েক দশক হল ছাত্র থেকে গবেষক –পেশাদার বিদ্যাচর্চা জীবির গোপন বাসনা অ্যাক্টিভিস্টের সিংহচর্ম। তেমনই অ্যাক্টিভিস্টেরও গোপন সাধ গবেষকের গরিমা। সত্যিসত্যিই গোটা দুই বন্দুক নিয়ে মুক্তি আনার চেষ্টা চালান যাঁরা, তাঁদের কুর্নিশ জানানো ছাড়া আর কিছুই বলার নেই আমার। বলার থাকতে পারে না। তাঁদের মাথা শৌখিন শাঁখের করাতে কাটে না, রাষ্ট্রের গিলোটিনে কাটে। কিন্তু গোটা দুই উক্তি, স্লোগান বা বইপত্রের জোরে মুক্তির দাবি করি যারা, পরিবর্তন চাওয়াটুকুই যাদের কাছে বিদ্রোহের সামিল, সেই আমরা ওই শাঁখের করাতের মুখে হরবখত পড়ি। আমরা মানে,কয়েক প্রজন্ম ধরে ঔপনিবেশিক শাসনের সাংস্কৃতিক মুনাফা কমবেশি ঘরে তুলেছি যারা, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে সমাজ, রাজনীতি, সংস্কৃতির ভাবতে পারি যারা, নানা কিসিমের মতবাদের উত্থান বা পতনে বিষণ্ণ বা প্রসন্ন হই যারা। স্লোগানসর্বস্বতার উৎস সন্ধানে উৎসাহী যারা। মূর্ত বাস্তবকে বিমূর্ত তাত্ত্বিক আলোচনার স্তরে নিয়ে যাওয়ার সুবিধে ও ক্ষমতা ভোগ করি যারা। পাল্টে দেওয়ার স্বপ্ন দেখার ফুরসত পাই যারা, স্বপ্নের নিশান সত্যিই বুকে দোলা লাগাল বলে মনে হয় যাদের, আবিল চোখে, প্রত্যয়ী চোয়ালে কোনো এক পক্ষের হয়ে গলা ফাটিয়ে পথে বা আজকাল ফেসবুকে নামি যারা, আবার সেই পক্ষের অনিবার্য স্খলনে প্রতারিত বোধ করি যারা। ক্ষেত্রবিশেষে নিজের আন্তরিকতাকে প্রতিক্রিয়াশীল ঠাউরে সন্দেহ করার মত ভাষাশিক্ষা জুটেছে যাদের কপালে, সেই আমরা তো সত্যিই ভাবি মাঝেমধ্যে, হোয়াট ওয়েন্ট রং? বিপ্লব দীর্ঘজীবী হল না কেন? কেন সেদিনের মুক্তিকামী জনতা আজ রক্তকামী? বা উল্টোটা? কেন আজকের ফিসফাস পাল্টে যেতে পারে আগামীর কোনো প্রচণ্ড চিৎকারে? কেন আজকের প্রতিবাদী কন্ঠ কাল সর্বংসহা?  

আরও পড়ুন:মমতার ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশংসা! চিঠিতে মুখ্যমন্ত্রীকে যা লিখলেন গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক

গায়ত্রীর স্পিভাকদের নিয়ে এই আমরাই নিরলস তর্ক করি। মুক্তির দাবি, আজাদির স্লোগানে অটুট-আস্থা নিজের উত্তেজিত যুবক-মনের সঙ্গে তর্ক করি। বলে বসি, স্লোগান যথেষ্ট নয়। স্পষ্ট করেই বলে দিতে পারি: “Revolution did not last in the absence of subjects trained in the practice of freedom”। তর্ক করি সাহিত্যের নিবিষ্ট শিক্ষকের সঙ্গে। তাঁকে বলতে পারি, “literature as such cannot open doors”। সাহিত্য এককভাবে আমাদের কিছুই বলে না। বলি, মানবিকীবিদ্যা কী শেখায়? অপরের অবস্থান থেকে বিচার করতে শেখায়। প্রাণবিজ্ঞান বা প্রকৃতিবিজ্ঞান এই শিক্ষায় দেয় না। কিন্তু তাই বলে বিখ্যাত মনীষীর সঙ্গে তর্ক করি, শিক্ষা অন্তর্নিহিত কিছুর বিকাশ নয়। শিক্ষার নিরিখ “uncoercive rearrangement of desires”। নন্দিত ডিসিপ্লিনের নরকে গিয়ে পড়ে কিছু বস্তাপচা বুলির পুনরুক্তিই একমাত্র ভবিতব্য।

কলেজের জেনারেল বডি মিটিংয়ে প্রথমবার অংশ নিয়ে তৃপ্ত জুনিয়রের ভাবাবেগে ঠেস দিয়ে বলি, “everybody talks about politics, but sometimes I feel like asking Shakespeare's question: When you call spirits from the vasty deep, will they come? That’s the problem with literary folks who want to be political”. তেমনি, ডিকলোনিয়াল উল্কিতে একে অপরকে চেনা কমরেডদের ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থার বিরুদ্ধে তোলা স্লোগানের সঙ্গে তর্ক করি, জোর গলায় সওয়াল করি “training the imagination for epistemological performance”-এর পক্ষে। ভেঙে ভেঙে বলি affirmative sabotage-এর কথা। মনে রাখি, অভিজ্ঞতা বিশুদ্ধ, অপাপবিদ্ধ নয়। মনে রাখি, অহং নিরঙ্কুশ, নিরালম্ব নয়। মনে রাখি ডিসিপ্লিন সত্য নয়। নানাবিধ আইডেন্টিটির ধুঁয়ো তুলে রাজনৈতিক উচ্চাসন দাবী করেন যাঁরা, তাঁদের কলার ধরে মনে করাই, “trying to step beyond identity is what keeps politics ethical”। রাষ্ট্রীয় ন্যায়বিচারের দাবীতে মুখর সহনাগরিকের শত্রু হয়ে যাই, যেই বলি “it is just that there be law, law alone is not justice”। বিনির্মাণ না অবিনির্মাণ - উপসর্গ সংক্রান্ত তর্কে লিটল ম্যাগাজিনের তরজা চালানো তৎসম বিশারদদের এড়িয়ে গিয়ে মনে মনে আউরে নিই  “in order to know you have to be trained in how to construct an object of knowledge”। মনে রাখি গণতান্ত্রিক পাঠের আসল শক্তি আসলে ভাষার স্বাতন্ত্র্যের অধিকারে নয়, লেখকের সঙ্গে একাত্মবোধ করাতেও নয়। নিজেকে নিলম্বিত (suspend) করে উদ্দিষ্ট পাঠকের অবস্থান কল্পনা করাই সম্ভবত গণতান্ত্রিক পাঠের ভিত্তি। ভাবতে বসি, অপরাশক্তির অর্থ কী?

সমর সেন প্রতিষ্ঠিত, তিমির বসু সম্পাদনায় কলকাতা থেকে প্রকাশিত নিতান্ত সাদামাটা, কৃশতনু ফ্রন্টিয়ার পত্রিকায় গায়ত্রী স্পিভাকের নিরন্তর তিন দশকের বেশি সময় ধরে প্রকাশিত নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধগুলি পড়ে এইসব চিন্তা করি আমরা। এ ছাড়া কী করি? তাঁর সঙ্গে আলাপ-পরিচয় করার চেষ্টা করি। সদ্ব্যবহার আশা করি। মনে করি, সদ্ব্যবহারই তাঁর পরিচয়। বা পরিচয়েই তাঁর সদ্ব্যবহার। আরও অনেক কিছু করি। তাঁর প্রসঙ্গ উঠলে ক্যান দ্য সাবঅল্টার্ন ….. ফিল ইন দ্য ব্ল্যাঙ্ক খেলি, কলকাতাবাসী হলে তৎক্ষণাৎ বিনয়াবনত হয়ে পড়ি। দিল্লীবাসী হলে তাঁর ব্রাহ্মণ্যবাদ নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়া গরম করি। টুইটারে খোঁজ নিই, কোন রাজনৈতিক প্রসঙ্গে তিনি কবে চুপ ছিলেন। মুখ্যমন্ত্রীর থেকে তিনি ঠিক কী চান তা নিয়ে চিন্তিত হই। অন্তত হোলবার্গ পুরস্কার কেন ঠিক নোবেলের সঙ্গে তুলনীয় নয় তা নিয়ে ফেসবুকে মন্তব্যটুকু অবশ্যই করি। আমরা এসব করি। ঠিকই করি। কেন করব না? দেশের জন্য গায়ত্রী কী করেছেন বা হিন্দুদের স্বার্থের কী হল ইত্যাদি প্রশ্ন তো তুলি না। আমরা অন্তত ওদের মত নই!

More Articles