ওষুধ নেই, কেমোথেরাপি নেই! যেভাবে ধীরে ধীরে মৃত্যুর পথে এগোচ্ছেন গাজার ক্যান্সার আক্রান্তরা
Gaza Cancer Patients : লিউকেমিয়া রোগী সালেম খরেইস জানাচ্ছেন, কোন ওষুধ নেই, চিকিত্সা নেই। যন্ত্রণা কতটা ভয়াবহ তা বলে বোঝাতে পারার অবস্থাতেও নেই তিনি।
হুইলচেয়ারে বসে সাইদা বারবাখ দেখছেন খান ইউনিসের রাষ্ট্রসঙ্ঘ পরিচালিত একটি স্কুলের দিকে, বারবার তাকাচ্ছেন ভিড়ে ঠাসা তাঁর ক্লাসরুমের দিকে। স্কুল তো নয়, এখন তাঁর বাড়ি। একমাসের উপর ধরে ইজরায়েলি বোমাবর্ষণে বাসা হারানো মানুষদের ঠিকানা তো এখন এই সব স্কুল অথবা হাসপাতালগুলিই। সাইদার বয়স ৬২। হাড়ের ক্যান্সারে আক্রান্ত তিনি। ওষুধ ফুরিয়ে গেছে কয়েক দিন আগেই। ইজরায়েলের এই হামলার আগে জেরুজালেমের আল মাকাসেদ হাসপাতালে তাঁর চিকিৎসা চলছিল। সফল এবং জটিল অস্ত্রোপচারের পর, যুদ্ধ শুরুর দুই দিন আগেই, ৫ অক্টোবর গাজা উপত্যকায় ফিরে আসেন সাইদা।
মেডিকেল চেক-আপের জন্য দুই সপ্তাহ পরে ফের ফিরে যাওয়ার কথা ছিল তাঁর। অথচ আর সম্ভবই না। সাইদা আশাও করেননি দু'দিনের মধ্যে চারপাশে এই বিপদ ঘনিয়ে আসবে। রাষ্ট্রসঙ্ঘ পরিচালিত ওই স্কুলে ৭২৫,০০০ বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনি এক মাসেরও বেশি সময় ধরে আশ্রয় নিয়েছেন নিরবচ্ছিন্ন ইজরায়েলি বোমাবর্ষণ থেকে বাঁচতে। অসুস্থ রোগী, ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীদের জন্য আদর্শ পরিবেশ এই যুদ্ধে আশা করাও বিলাসিতা যেন।। বিদ্যুতের অভাব, বিশুদ্ধ জল, খাবার এবং শয্যা এবং পর্যাপ্ত শৌচাগারের অভাবে স্কুলগুলি ধীরে ধীরে হয়ে উঠছে রোগের আস্তাকুঁড়। এক জায়গায় গাদাগাদি করে এত মানুষ থাকার ফলে ফুসফুসের সংক্রমণ, ডায়রিয়া এবং ত্বকে ফুসকুড়ির মতো সমস্যা বাড়ছে।
সাইদা বলছেন, তাঁর যত্ন এবং ঘুম দরকার। এই হুইলচেয়ারে খুব বেশি নড়াচড়া করতেও পারছেন না তিনি। সুস্থ মানুষের যন্ত্রণা অন্য, আর ক্যান্সারের মতো রোগ নিয়ে এই নৃশংস যুদ্ধে বেঁচে থাকা আরেক ভয়ানক যন্ত্রণা। সাইদা বারবাখ খান ইউনিসের পূর্বের বানি সুহাইলা শহরের বাসিন্দা। গাজা উপত্যকায় ক্যান্সারের চিকিৎসার একমাত্র তুর্কি-ফিলিস্তিনি ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালেই সুস্থ হয়ে ওঠেন তিনি। কিন্তু গাজা উপত্যকায় ইজরায়েল সমস্ত প্রয়োজনীয় রসদ সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়ার কারণে জ্বালানি ফুরিয়ে গিয়েছে। ফলে ১ নভেম্বর থেকে এই হাসপাতালটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। আশেপাশের এলাকায় ইজরায়েলি হামলার ফলে হাসপাতালটিরও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রক জানাচ্ছে, ৭ অক্টোবর থেকে গাজায় ইজরায়েলের বোমা হামলায় ১২ হাজারের কাছাকাছি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে।
আরও পড়ুন- মেরুদণ্ড টুকরো টুকরো করে দিয়েছে ইজরায়েলি বোমা! যেভাবে অথর্ব হচ্ছে গাজার শিশুরা
গাজার উত্তর অংশ থেকে সরিয়ে দক্ষিণে যাওয়ার জন্য হাসপাতাল থেকে ৭০ জন ক্যান্সার রোগীকে সরিয়ে নেওয়া হয়। সাইদা বারবাখও ছিলেন তাঁদেরই মধ্যে। কিন্তু ইজরায়েলি বোমা হামলায় তাঁর বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পরে ওই স্কুলের আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা ছাড়া কোনও উপায় ছিল না তাঁর ও তাঁর পরিবারের।
ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের স্বাস্থ্যমন্ত্রী, মাই আল-কাইলা জানাচ্ছেন, এই ৭০ জন ক্যান্সার রোগীর জীবন খুবই সঙ্কটে রয়েছে। প্রকৃত ও পর্যাপ্ত চিকিত্সা এবং যত্নের অভাবে অবস্থা প্রতিদিন খারাপ হচ্ছে। সামগ্রিকভাবে, গাজা উপত্যকায় ২,০০০ ক্যান্সার রোগী রয়েছে। ইজরায়েলের এই আগ্রাসন এবং ব্যাপক বাস্তুচ্যুতির ফলে ক্যান্সার রোগীদের স্বাস্থ্য পরিস্থিতি ভয়াবহ।
তুর্কি-ফিলিস্তিনি ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালের পরিচালক সুবি সুকেক বলছেন, যুদ্ধ শুরুর এক মাসেরও বেশি কেটে গেছে। হাসপাতালে যা ওষুধ মজুত ছিল সবই ফুরিয়ে গেছে। ক্যান্সার রোগীদের জন্য বিশেষ কিছু চিকিত্সা, যেমন কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপি এবং সাধারণ চিকিত্সায় বেশ কয়েকটি ওষুধকে একত্রিত করে দেওয়া হয়, সেসব আর দেওয়া যাচ্ছে না। কিছু রোগীকে খান ইউনিসের দার এসসালাম হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল নিরাপদ জায়গা বলে। কিন্তু আসলে এই মুহূর্তে গাজায় মোটেও কোনও নিরাপদ জায়গা নেই।
দার এসসালাম হাসপাতাল ওষুধ বা ক্যান্সারের চিকিৎসা করতে পারে না, তবে রোগীদের প্রাথমিক যত্ন সেখানে সম্ভব। কিন্তু কিছু ক্যান্সার রোগী পরিবারের সঙ্গে স্কুলের শরণার্থী শিবিরে থাকতে বাধ্য। তারা জানেন, হাসপাতালে আর তাঁদের চিকিৎসা সম্ভব নয়।
প্রতিদিন দুই থেকে তিনজন ক্যান্সার রোগী মারা যাচ্ছেন। যে রোগীদের তুর্কি ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতাল থেকে স্থানান্তর করা হয়েছিল তাদের মধ্যে চারজন মারা গেছেন ইতিমধ্যেই। তুর্কি ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালে এখন মাত্র কয়েকজন রোগীই রয়ে গেছেন। তাদের মধ্যে ৪০ বছর বয়সি লিউকেমিয়া রোগী সালেম খরেইস জানাচ্ছেন, কোন ওষুধ নেই, চিকিত্সা নেই। যন্ত্রণা কতটা ভয়াবহ তা বলে বোঝাতে পারার অবস্থাতেও নেই তিনি। ডাক্তাররা পাশে আছেন সবসময় কিন্তু ওষুধই নেই। চিকিৎসকরা নিজের চোখের সামনে মারা যেতে দেখছেন রোগীদের।
গত সপ্তাহে, তুরস্কের স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, তাঁর দেশ এবং মিশর ১,০০০ জন ক্যান্সার রোগী এবং অন্যান্য আহত নাগরিকদের চিকিৎসার জন্য গাজার জরুরি ওষুধ ও যত্ন পাঠাতে সম্মত হয়েছে। তবে আর কোনও তথ্যই মেলেনি তারপর।
আরও পড়ুন- সন্তানের মৃতদেহও আসবে যে কোনওদিন! রোজ ২০০ লাশকে কাফন পরাচ্ছেন গাজার এই বৃদ্ধ
চিকিৎসার জন্য গাজা ছাড়তে হলে রোগী এবং তাদের আত্মীয়দের অবশ্যই একটি মেডিকেল পারমিটের আবেদন জমা দিতে হবে। এই অনুমতি কেবল ইজরায়েলি প্রশাসনই দিতে পারে। প্রতি বছর প্রায় ২০,০০০ রোগী চিকিৎসার উদ্দেশ্যে গাজা উপত্যকা ছেড়ে যাওয়ার জন্য ইজরায়েলের কাছ থেকে অনুমতি চায়। এই ক্যান্সার রোগীদের প্রায় এক তৃতীয়াংশই শিশু। ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন জানাচ্ছে, ২০২২ সালে ইজরায়েল এই মেডিকেল এক্সিট আবেদনগুলির প্রায় ৬৩ শতাংশর অনুমোদন দেয়।
এই যুদ্ধে ইজরায়েলি হামলায় ব্যাপক হারে ফিলিস্তিনিরা আহত হওয়ার কারণে হাসপাতালগুলি উপচে পড়ছে। আহতদের জায়গা দিতে গিয়ে ক্যান্সার রোগীদের আর ঠাঁই নেই। চিকিৎসা অনুমতির জন্য অপেক্ষা করছিলেন এমন ক্যান্সার রোগীদের মধ্যে কয়েকজন মারা গেছেন। চিকিৎসা না হলে বাকিদেরও খেয়ে ফেলবে এই মারণরোগ।
থাইরয়েড ক্যান্সারে আক্রান্ত রিম আসরাফের ওষুধও শেষ হয়ে গেছে। পূর্ব জেরুজালেমের আল মাকাসেদ হাসপাতালে তাঁর চিকিৎসা হওয়ার কথা ছিল। আসরাফের ঘাড়ের টিউমার সরাতে দু'টি অস্ত্রোপচার করা হয়েছে। আরও চিকিত্সা এবং চেক-আপ প্রয়োজন। অথচ স্বাস্থ্যের দিন দিন অবনতি হচ্ছে। ব্যথানাশক ওষুধের অভাবের কারণে নড়াচড়া করতেও পারছেন না তিনি। মৃত্যু এবং ধ্বংসের মুখে এই কী চরম অসহায় এই ক্যান্সার রোগীরা! অথচ যুদ্ধে চলবে, ইজরায়েল না জেতা অবধি যুদ্ধ চালিয়ে যাবে তারা।