বিমলাকে 'শিক্ষা' দিলেন না নিখিলেশ, পদাবলির বিরহকে ঘরে-বাইরে মিশিয়ে দিলেন রবীন্দ্রনাথ
Ghare Baire and Padabali: বিমলা নামের মেয়েটি যে স্বামী নিখিলেশকে ফেলে বরণ করতে চাইছে সন্দীপকে সেই মেয়েটিকে কেন কিছু বলছে না তার স্বামী! কোথায় গেল তার পৌরুষ!
বড়ু চণ্ডীদাস খুব মন দিয়ে পড়েছিলেন জয়দেবের গীতগোবিন্দ কাব্যখানি। পড়েছিলেন নাকি শুনেছিলেন? আচ্ছা ধরে নেওয়া গেল শুনছিলেন। তখন তো ছাপা বই ছিল না, পদাবলি কানে কানে পথ চলত। জয়দেবের কান্তকোমল পদাবলিও এভাবেই শ্রোতা থেকে এগিয়ে গিয়েছিল শ্রোতান্তরে। জয়দেব জানিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর কাব্যের শুরুতে যদি হরিস্মরণে মন সরস হয়, যদি বিলাস-কলায় কৌতূহল থাকে তবেই যেন শ্রোতারা জয়দেবের এই শ্রুতি-সুভগ কান্তকোমল পদাবলি শোনেন। এই যে হরির বিলাসকলা তাই জয়দেবের কাব্যের ছত্রে ছত্রে বর্ণিত। বড়ুর কাব্যেও তো কৃষ্ণের সম্ভোগলীলার বিবরণ। কৃষ্ণ কংস বধ করতে পৃথিবীতে অবতীর্ণ হচ্ছেন বটে, কিন্তু সেই বধ করতে যাওয়ার আগে কৃষ্ণের ‘সম্ভোগ কারণে’ লক্ষ্মীর রাধা রূপ ধারণ করে পৃথিবীতে আসা। এই রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলার কথা লিখতে বসে বড়ু তাঁর কাব্যের বৃন্দাবনখণ্ডে ও অন্যত্র জয়দেবের গীতগোবিন্দের পদ বাংলায় অনুবাদ করেছেন। এই অভ্যন্তরীণ প্রমাণ থেকে বলাই যায় বড়ু জয়দেবের কাব্যের সঙ্গে পরিচিত।
বড়ুর কাব্যটি যখন কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো শুরু হল তখন থেকেই কাব্যটি পড়ানো নিয়ে নানা অসুবিধে ও আপত্তি। ‘বংশী খণ্ড’ ও ‘রাধা বিরহ’ বড়ুর কাব্যের এই শেষ দু'টি খণ্ড নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের আপত্তি ছিল না। এই অংশ দু'টিতে কৃষ্ণ-বিরহে কাতরা রাধার প্রণয়বাচন হৃদয়স্পর্শী। রাধা বিরহবেদনায় অস্থির হয়ে ভাবছেন পাখির মতো কৃষ্ণের কাছে উড়ে যাবেন, কখনও বিরহবেদনা সইতে না পেরে ভাবছেন শরীরের মাংস কেটে কুমীরকে খাইয়ে দেবেন। বিরহ যে কত অসহ হতে পারে! এই দুই খণ্ডে রাধার যে বিরহবৃতান্ত প্রকাশিত, তার মধ্যে যে তীব্র আকুলতা তাতে কিন্তু কোথাও কখনও কৃষ্ণকে আঘাত করতে চাওয়া হয়নি। পরুষবাক্যে সুস্পষ্ট ভাষায় প্রত্যাখ্যাতা বিরহ-কাতরা নারীটি কৃষ্ণের প্রতি বলপ্রয়োগ করতে চায়নি কখনও। অথচ এই দুই খণ্ড বাদ দিলে তার আগে কৃষ্ণ যেখানে রাধাবিরহে জর্জর, যেখানে কৃষ্ণকে আইহনের পত্নী হিসেবে প্রত্যাখ্যান করেছেন রাধা, সেখানে প্রত্যাখ্যাত কৃষ্ণ যে ভাষায় কথা বলেছেন তা শরীরী বলের ভাষা। এমনকী কৃষ্ণ এমন স্পষ্ট শারীরিকতায় নিবেদন করেছে যৌন আকুতি তা অনেক সময় কটু লাগে। এজন্যই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসঘরে বড়ুর কাব্যের পুরোটা পড়ানো হত না। এই না পড়াতে চাওয়া অবশ্য একরকম শুচিবায়ুগ্রস্ততা। বড়ু প্রাগাধুনিক পর্বে যখন তাঁর কাব্য লিখছেন তখন যৌন-বিষয়ে শুচিবায়ুগ্রস্ততা বঙ্গভাষীদের গ্রাস করেনি। তবে বড়ুর কাব্যের ‘বংশী খণ্ড’ ও ‘রাধাবিরহ’-র প্রণয়-বিরহের ভাষা যে অন্যান্য খণ্ডের প্রণয়-বিরহের ভাষার থেকে আলাদা তা বুঝতে পারা যায়।
আরও পড়ুন- বিরহ শুধুই বিলাপ নয়, বেদনায় যেভাবে শিউলির মতো হয়ে উঠেছেন রামচন্দ্র, যক্ষ
এই যে আলাদা দুই ভাষা এ কি নারী-পুরুষের সাধারণ প্রণয়-প্রবণতাগত পার্থক্য? বড়ুর কাব্যে কৃষ্ণ, রাধার কাছে আপাত ভাবে প্রত্যাখ্যাত কৃষ্ণ, কথায় কথায় বলপ্রয়োগ করতে চায়। এই বলপ্রয়োগের জন্য তার নানা ছলা-কলা আয়োজন। বিরহী, কামাসক্ত পুরুষের এই আচরণ সেকালের শ্রোতারা উপভোগ করতেন। তবে প্রেমের, পুরুষের প্রেমের, ভাষা যে কেবল এমন নয় সে উপলব্ধি তো সেকালেই হয়েছিল। চৈতন্যদেব তো কেবল পুরুষের প্রণয়ের ভাষাকেই বদলে দিলেন না, নারীর প্রণয়ের আকুলকরা ভাষাকে ধারণ করলেন। বিরহে প্রকৃতপ্রেমিক কামতাড়িত হয়ে প্রেমাস্পদের প্রতি বলপ্রয়োগে অভিলাষী হয় না, আশ্চর্য এক আকুলতায় ডুবে যায় তার শরীর ও মন। দু'চোখে জমে কান্নার মেঘ – শরীরে লাগে বেদনার কাঁপন। বড়ুর রাধা বলেছিলেন কৃষ্ণ বিহনে তিনি নালবিহীন নীলপদ্ম। এই যন্ত্রণাদীর্ণ শরীর ও মন বিরহে-বেদনায় নত হয়ে থাকে। প্রত্যাখ্যানে বা বিরহে তা ক্রোধদীপ্ত হয় না কখনও।
এই যে চৈতন্যদেবের কাছ থেকে প্রণয়ের নতুন ভাষা শিখল বাঙালি পুরুষ সে শিক্ষা কি কমশিক্ষা! ‘সবুজপত্র’-এ প্রকাশিত হচ্ছে রবীন্দ্রনাথের ‘ঘরে-বাইরে’। সমকালে নানা বিতর্কের মুখোমুখি সে লেখা। বাড়ির বউ স্বামীকে, গুণবান স্বামীকে, ভুলে তারই বন্ধুর সঙ্গে প্রণয়াসক্ত। এ সাংসারিক ব্যাভিচার রবীন্দ্র-উপন্যাসে ধরা পড়েছে। শুধু কি তাই? বিমলা নামের মেয়েটি যে স্বামী নিখিলেশকে ফেলে বরণ করতে চাইছে সন্দীপকে সেই মেয়েটিকে কেন কিছু বলছে না তার স্বামী! কোথায় গেল তার পৌরুষ! তারই তো উচিত চুল ধরে বউকে, স্বৈরিণী বউকে বাইরে থেকে ঘরে টেনে আনা। অথচ রবীন্দ্রনাথ তো করলেন না তা। নিখিলেশ এই উপন্যাসে যখন নিজের কথা বলে তখন পদাবলির ভাষা হয়ে ওঠে তার স্বভাষা। সেই ভাষায় কিন্তু বড়ুর প্রত্যাখ্যাত কৃষ্ণ উঁকি দেন না, সেই ভাষায় না আছে পারুষ্য না আছে পৌরুষ। তার আশ্রয় যে পদাবলি তাতে রাধার বিরহের ভাষা ধরা পড়েছে। কৃষ্ণ-বিরহে রাধার মন্দিরশূন্য। বিমলার বিরহে নিখিলেশের মন্দিরও যে শূন্য। বলে বিমলাকে ধরে রাখবে না সে, বলপ্রয়োগ করে ধরে রাখা যায় না। যে চলে যাওয়া বিরহ নয়, বিচ্ছেদের সুরবাহী সেই বিচ্ছেদকে মেনে নিতে হয়। আর সেই মেনে নেওয়া বিচ্ছেদের মধ্যে ধরে রাখতে হয় চিরবিরহের স্মৃতি। আজ পরস্পরের মন পরস্পরের থেকে চলে গেছে বিচ্ছেদে, কিন্তু একদিন তো ছিল তা মিলন-বিরহে আন্দোলিত – সেই তো শূন্যমন্দিরে চিরবিরহের স্মৃতি। বিচ্ছেদ সত্য – বিরহের স্মৃতিও অলীক নয়।
এই যে নতুন পুরুষের ভাষা তা রবীন্দ্রনাথ নির্মাণ করলেন চৈতন্যদেব আশ্রিত পদাবলির ভাবের সাহায্যে। পুরুষ নারীর মতো প্রণয়ের ভাষা অর্জন করুক – পৌরুষের লেলিহান শিখায় লাগুক নারীর বেদনার স্তিমিত একমুখী দীপ্তি।
হয়তো এভাবে উচিত নয় বলা, তবু মনে হয় বড়ু জানতেন দুই ভাষার পার্থক্য। পুরুষের ভাষার প্রত্যক্ষতা, শারীরিকতা, পারুষ্যের বিপরীতে তাই তিনি রেখেছিলেন তাঁর রাধাকে। সেই রাধার ভাষার খোঁজ শুধু সাধক চৈতন্য করেননি, রবীন্দ্রনাথও করেছিলেন। না-করলে আনত প্রেমের বিরহ-যাপনে যে অশিক্ষিত হয়ে থাকবেন আধুনিক পুরুষেরা।