যে হাতের প্যাঁচে সাহেব কুপোকাত, সে হাতই সুর তুলত সেতারে, গোবর গুহকে ভুলেছে বাঙালি

মেকলের শিক্ষানীতির ছাঁচে গড়ে ওঠা মধ্যবিত্ত বাঙালির জীবনে মানে তো কেবলই দশটা পাঁচটার কেরানির স্বপ্ন। তবু উপকথারা থাকেই গড্ডালিকাপ্রবাহের মধ্যেই কেউ কেউ ঘুরে দাঁড়ান, তেড়েফুঁরে দাগ রেখে যান সময়ের সিঁথিতে। এমন উপকথাতেই বাসা বাঁধে কোনও কোনও জাতির স্বপ্নসাধ।আমাদের আজকের গল্পের কুশীলব এমনই এক জলজ্যান্ত মানুষ, যার বৃষস্কন্ধে আজও বাঙালি ভর করতে পারে। তাঁর ছাতি প্রকৃতই ৫৬ ইঞ্চি, হাতের পাঞ্জা যেন বিরাশি সিক্কার হাতছানি। আজ থেকে ঠিক পঞ্চাশ বছর আগে ১৯৭২ সালের এই দিনটিতে জীবনাবসান ঘটেছিল তাঁর। কীভাবে কিংবদন্তি হয়ে উঠেছিলেন বাংলাদেশের সুপারম্যান গোবর গুহ?

ঊনবিংশ শতাব্দীতে আখড়া সংস্কৃতি ছিল বাঙালিয়ানার পরিচায়ক। বাঙালিকে বলশালী করে তোলার প্রকল্প নিয়ে কলকাতার দর্জিপাড়া অঞ্চলে কুস্তির আখড়া তৈরি করলেন অম্বিকাচরণ গুহ, ওরফে 'অম্বুবাবু'। শিষ্যদের প্রতি যত্নশীল অম্বিকাচরণ আখড়ার শিক্ষার্থীদের জন্য নিজের দায়িত্বে বরাদ্দ করলেন বড় গ্লাসের এক গ্লাস করে দুধ। মনে করা হয়, তাঁর হাত ধরেই গুহবংশে কুস্তিপ্রীতির গোড়াপত্তন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অম্বিকাচরণের আখড়া হয়ে উঠল 'ধন ধান্যে পুষ্পে ভরা'। শোনা যায়, সেখানে শরীরচর্চার তালিম নিতে আসতেন খোদ নরেন্দ্রনাথ দত্ত, যিনি কিছুদিনের মধ্যেই স্বামী বিবেকানন্দ নামে পৃথিবী বিখ্যাত হয়েছিলেন। এভাবেই শুরুয়াত। তারপর অম্বিকাচরণের অবর্তমানে আখড়ার দায়িত্বে এলেন তাঁর পুত্র, প্রখ্যাত কুস্তিগীর রামচরণ গুহ। রামচরণের কৃতি সন্তানের নামই যতীন্দ্রচরণ, জগৎসভায় যিনি শ্রেষ্ঠ আসন পেয়েছিলেন গোবর গুহ নামে।

প্রথম দিন তাঁকে আখড়ায় দেখেই সমঝদাররা ধরে ফেলেছিলেন, এ ছেলে তো যে সে ছেলে নয়। গোবরের তখন শৈশবকাল। চেহারার গড়ন ছিল খানিক বাড়তির দিকে, তাই দাদু ঠাট্টা করে নাম দিয়েছিলেন 'গোবরের ড্যালা'। তারপর কয়েকদিনের মধ্যেই  নাদুসনুদুস সেই গোবর গড়ন পরিণত হল মুগুর ডাম্বেল ভাজা বৃষস্কন্ধ, বৃকোদরে। তখন ১৯১০ সাল। মেট্রোপলিটন স্কুল থেকে সবে এন্ট্রান্স পাশ করে বেড়িয়েছেন গোবর। বয়স তাঁর আঠেরো। অথচ উচ্চতায় তিনি ছয় ফুট এক ইঞ্চি, ছাতির মাপ আটচল্লিশ। এর ঠিক তিন বছরের মাথায় ১৯১৩ সালে বিলেত পাড়ি দিলেন তিনি। খাস গোড়া সাহেবদের দেশ স্কটল্যান্ডের মল্লভূমিতে দাঁড়িয়ে নিপুণ প্যাঁচে ধরাশায়ী করলেন স্কটিশ জায়েন্ট জিমি এসনকে। আন্তর্জাতিক স্তরে বাংলাকে খ্যাতির যে পর্যায়ে পৌঁছে দিয়েছিলেন গোবরবাবু, একে বলা চলে তার সূচনাপর্ব। এর আগের বছর, অর্থাৎ ১৯১২ সালে লন্ডনের জন বুল সোসাইটি আয়োজিত কুস্তির চ্যাম্পিয়নশিপে গামা পালোয়ানের সঙ্গে ভারতের প্রতিনিধিত্বও করেছিলেন তিনি। কুপোকাত করেছিলেন ক্যাম্পবেলের মতো নামজাদা কুস্তিগীরকে।

১৯২১ সালে সানফ্রান্সিসকোয় ওয়ার্ল্ড হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়নের খেতাব পেলেন গোবরবাবু। জার্মানির আড স্যালটারকে পরাস্ত করে সাহেবদের সেবার তিনি 'হিড়িমিড়িকিড়ি বাঁধন' দেখিয়ে দিয়েছিলেন । তাঁকে নিয়ে ক্যান্সাস সিটি পোস্ট পত্রিকায় হেডলাইন বেরোয়, 'Invasion of 'Hindu Menace's breeds fear among matmen' । বেপরোয়া এই বীরুপুরুষের দিনযাপন কেমন ছিল? গলায় ১৬০ পাউন্ডের পাথর ঝুলিয়ে শরীরচর্চার নিত্য রেওয়াজ তো তিনি করতেনই। এমন কী তাঁকে নিয়ে এ গুজবও রটে যে তাঁর খাবারে  নাকি মেশানো হত সোনা আর রুপোর গুঁড়ো।  যাঁরা তাঁকে দেখেছেন, তাঁদের মতে, ব্যক্তিগত জীবনে অসম্ভব বিনয়ী মানুষ ছিলেন গোবরবাবু।  সত্যেন্দ্রনাথ বসু ছিলেন তাঁর পরমবন্ধু। দুয়ে মিলে প্রায়ই বৈঠক বসাতেন মসজিদবাড়ি স্ট্রিটের আখড়ায়। তারপর নামত সন্ধে। পথচারীরা বিস্মিত হয়ে শুনতেন তাঁর বাড়ি থেকে ভেসে আসছে সেতারের ধুন। শুধু বলবান শরীর নয়, সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকে সুরও পেয়েছিলেন বাংলার লৌহভীম। যে হাত নাকি পৃথিবীর বাঘা বাঘা সব কুস্তিসম্রাটকে এক সুযোগেই ঘায়েল করেছে, তাতেই নাকি আবার গড়ে ওঠে ইমন, হামিরের মিঠে গত। ভাবা যায়?

আরও পড়ুন-মুগপুলি আর গোকুল পিঠে যেন সময়গাড়ি, কে বলে রান্নার ভূগোল নেই!

বঙ্গবাসীর জীবনে এক সময়ে সম্পৃক্তই ছিল কুস্তির আখড়া। এখন সেসব উঠে গিয়ে হয়েছে হাইটেক জিম। প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হয়, গোবর গুহর ছবি থাকে কি সেখানে? নাকি বাংলার দামাল ছেলেমেয়েদের ব্যায়ামকালের প্রেরণা যোগায় কেবলই বলিউডি নায়ক নায়িকার ঝাঁ চকচকে সিনে পোস্টার? প্রশ্ন বড় সহজ নয় আর উত্তরও অজানা। নীরবে, নিভৃতে গোবর গুহর মূর্তি দাঁড়িয়ে থাকে কলকাতার আজাদহিন্দ বাগে। তার চারপাশ দিয়ে বয়ে চলে বেহায়া সময়। টেকনোলজি শোভিত একুশ শতক এক ঝটকায়  বুড়িয়ে ফেলে সেকালের গুণময় বাগচীকে। বিশ্বশ্রী গুণময় বাগচী, 'জয় বাবা ফেলুনাথ'-এ যার মিকালেঞ্জেলো ডেভিড হয়ে ওঠার মধ্যে দিয়ে,  বিশ্ববাসী অবাক চোখে দেখেছিল বাঙালির 'এদিকে চারশো, ওদিকে চারশো'। আর আজ, তার 'শার্টের কলার ষোল ইঞ্চি'।

চিত্রঋণ: উইকিপিডিয়া

More Articles