সেদিন সন্তানতুল্য বুদ্ধদেবের কটাক্ষে আহত হয়েছিলেন গীতা মুখোপাধ্যায়
লালুবাবুর মা মরা মেয়েটার উপর বাড়ির সকলেরই একটা অন্য রকম টান ছিল। দাদু রায়বাহাদুর অন্দরমহলে পাঠিয়েছেন তাঁতি-বউকে। বাড়ির অন্য মেয়েরা যা পছন্দ করবার করবে। রায়বাহাদুরের ইচ্ছে লালুর মা মরা মেয়েটা বেশ দামী একটা সিল্কের শাড়ি পছন্দ করুক। রায়বাহাদুরের নাতনি পছন্দ করে বসলে একটা অত্যন্ত সাধারণ তাঁতের শাড়ি। 'তখন আর দাম টাম কি জানি ছাই? রঙটাই টেনেছে সবথেকে বেশি। অদ্ভূত সুন্দর ময়ূরকন্ঠী রঙ'- নিজের ছোটবেলার কথা যে মানুষটি বলছিলেন, সেই মানুষটিই প্রৌঢ়ত্বে যেমন তেমন করে শাড়ি পরে কর্মক্ষেত্রে গেলে সংসদের সেন্ট্রাল হলে দল, রাজনীতি ভুলে তাঁর গীতাদির শাড়ি ঠিক করে দিতেন রামানন্দ সাগরের টেলি-রামায়ণ খ্যাত বিজেপির সাংসদ দীপিকা চিখলিয়া।
গীতা মুখোপাধ্যায়। চলে গিয়েছেন বিশ বছরেরও বেশি সময় হয়ে গেল। বছর তিনেক আগে সংসদ ভবনের বাইরে গাড়ির জন্যে অপেক্ষা করছেন তৃণমূলের তৎকালীন সাংসদ ডাক্তার মমতাজ সংঘমিতা। সংসদের এক প্রবীণ নিরাপত্তা কর্মী তাঁর দিকে এগিয়ে এসে বললেন; "আপনাকে দেখে গীতাদির কথা মনে পড়ে গেল।"
যশোহর শহরের মেয়ে গীতা। পড়েন শহরেরই মধুসূদন তারাপ্রসন্ন গার্লস হাই স্কুলে। তাঁরা যেবার ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেবেন, সেইবারই স্কুলের বড়দিদিমনি বিটি পড়তে গেলেন। ডেপুটেশনে এলেন কোচবিহারের সুনীতি আকাদেমি থেকে পারুল নন্দী। জনা চার পাঁচেক মেয়ে সেবার ম্যাট্রিক দেবে। আর তাদের রেজাল্টের উপরই নির্ভর করছে স্কুলের সরকারি অনুমোদন। ওই ইস্কুল থেকেই আগে পাশ করেছেন কণক দাশগুপ্ত,পরবর্তীতে যিনি রাজনীতির অঙ্গনে কণক মুখোপাধ্যায় নামে সুপরিচিতা ছিলেন।
গীতার সঙ্গে এক ক্লাসেই পড়েন উসষী। পরবর্তী কালে যিনি সাহিত্যিক মনোজ বসুর ঘরণী হয়েছিলেন। পারুল নন্দী যেদিন প্রথম ক্লাসে আসবেন, সেদিন গীতাদের ব্যস্ততা তুঙ্গে। কোথা থেকে একটা ভাঙা চেয়ার, টেবিল জোগাড় করে এনেছেন তাঁরা।দরজার সামনে একটা নারকোল কাঠির ঝাঁটা আড় করে রেখে দিয়েছেন। পরিস্কার পরিচ্ছন্ন ঘরটা রাজ্যের ধুলো দিয়ে ভর্তি।
পারুল নন্দী ক্লাস ঘরে ঢুকেই এক লহমায় সবটা দেখে বিষয়টা আন্দাজ করে নিলেন। শিক্ষিকার চেয়ারে না বসেই ছাত্রীদের উদ্দেশে বললেন; "কী খবর সব? কেমন আছ তোমরা? তা গাছেটাছে ওঠা ঠিক মতো হচ্ছে তো?" ওই যে গাছে ওঠার কথা দিয়ে আলাপ জমাতে শুরু করলেন, প্রথম দিনই মন জয় করে ফেললেন ছাত্রীদের। ওদিকে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে ছাত্র ফেডারেশন ধর্মঘট ডেকেছে। ম্যাট্রিক পরীক্ষার্থী গীতাই নেতৃত্ব দিলেন সেই বিক্ষোভের। ক্লাসে ক্লাসে গিয়ে ব্রিটিশের ছাত্রদমন নীতির বিরুদ্ধে বললেন। ছাত্রীরা সব দলে দলে ক্লাস ছেড়ে বের হয়ে এসে শামিল হলো ধর্মঘটে।তার আগে ওই স্কুলে কখনো ছাত্র ধর্মঘট হয়নি।
পরীক্ষা এগিয়ে আসছে কিন্তু প্রিপারেশন ঠিক মতো হচ্ছে না গীতার। কখনই বা প্রস্তুতি নেবেন পরীক্ষার? পুরোদমেই যে চলছে ছাত্র ফেডারেশন করা।পারুল নন্দীই একদিন গীতাকে বললেন; "আমি কোয়ার্টারে একা একা থাকি। বিকেলের দিকে একটু আমার সঙ্গে গল্পটল্প করতেও তো আসতে পারো?"
গীতা প্রায় রোজই বিকেলে যান বড়দিদিমণির কোয়ার্টারে। ছাদে দিদিমণি তাঁকে নিয়ে পায়চারি করেন।এই পায়চারি করতে করতেই গীতা একদিন দেখলেন তাঁর কাছে সবথেকে কঠিন লাগা রাজনৈতিক ভূগোলটা তাঁর সম্পূর্ণ মুখস্থ হয়ে গিয়েছে। পারুল নন্দী রোজ বিকেলে ছিদে পায়চারির সাথে সাথে গীতাকে তাঁর সব থেকে কঠিন লাগা সাবজেক্টটি একদম জলের মতো সহজ করে বুঝিয়ে দিয়েছেন।
যশোহর শহরে তখন ছাত্র ফেডারেশনের গোপন সভা হওয়ার উপায় নেই।কলকাতা থেকে ছাত্র নেতা বিশ্বনাথ মুখোপাধ্যায় এসেছেন।তিনি স্থানীয় নেতৃত্বকে বলে দিয়েছেন মধুসূদন তারাপ্রসন্ন ইস্কুলে প্রথম সফল ছাত্র ধর্মঘট যে মেয়েটির নেতৃত্বে হয়েছে, সেই মেয়েটিকে কমিউনিস্ট পার্টির গোপন সভায় আনতেই হবে।গীতার নেতৃত্বে সফল ছাত্র ধর্মঘটের দরুণ ইস্কুলের নামটা তখন কলকাতাতেও পৌঁছে গিয়েছে।কণক দাশগুপ্ত যখন ওই স্কুলের ছাত্রী ছিলেন, তখন কণকের সঙ্গে ছাত্র রাজনীতির কোনো সংযোগ ছিল না।ফলে ব্রিটিশ বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কোনো ঢেউ ওই ইস্কুলে আগে পৌঁছয়নি।
কমিউনিস্ট পার্টির গোপন বৈঠক হবে শহর থেকে একটু দূরে ঝুমঝুমপুর শ্মশানে। গীতা গিয়েছেন সেই গোপন বৈঠকে।গিয়ে তো একেবারে অবাক সেখানে তাঁর দাদা শঙ্কর রায়চৌধুরীকে দেখে। শঙ্করও যে কলকাতায় ছাত্র ফেডারেশনের সূত্রে কমিউনিস্ট পারূটির সংস্পর্শে এসেছেন, সেটা গীতা জানেন না। আর গীতাও যে ছাত্র রাজনীতিতে সংযুক্ত হয়েছেন , সেটা শঙ্কর জানেন না। সেই মিটিংয়েই বিশ্বনাথ- গীতার প্রথম দেখা। তুখোড় ছাত্রনেতা বিশ্বনাথ, যাঁর , 'ছাত্র আন্দোলনকে বাঁচাতেই হবে' থিসিস ঘিরে তখন অবিভক্ত বাংলার ছাত্র রাজনীতি উত্তাল।সেই বিশ্বনাথ মুখোপাধ্যায় কিন্তু ঝুমঝুমপুর শ্মশানে প্রথম দেখেই গীতার প্রেমে পড়ে যান। বিশ্বনাথবাবু বলতেন; "ওঁর অসাধারণ দাঁতের পাটি দেখে আমি প্রথম প্রেমে পড়ি !"
বাড়ি ফিরে সেইদিন গীতার আর এক বিপত্তি। এত রাত পর্যন্ত কখনো তো তিনি একা বাইরে থাকেন না।বাবা প্রফুল্লকুমারের জেরার মুখে পড়তে হলো বাড়ি ঢুকেই। 'কোথায় ছিলে?', বাবার প্রশ্নের মুখে গীতা বললেন; 'সিনেমা দেখতে গেছিলাম।'
'মিথ্যে কথা', গর্জে উঠলেন লালুবাবু; আমি সিনেমা হলের সিটগুলো টর্চ দিয়ে তন্ন তন্ন করে খুঁজে এসেছি। এরপর আর সত্য গোপন করে থাকতে পারলেন না গীতা। কমিউনিস্ট পার্টির সভায় যাওয়ার জন্যে নয়, অসত্য বলবার জন্যে এরপর কয়েকমাস গীতার সঙ্গে কথা বলেননি তাঁর বাবা।
কলকাতায় প্রথম প্রথম কমিউনিস্ট পার্টির ক্যুরিয়ারের কাজ করতেন গীতা। পার্টির গোপন চিঠি পৌঁছে দিয়ে আসার জন্যে কিছুটা দেরি হয়েছে বাড়ি ফিরতে। পিসি অনিলা দেবীর জোর জেরা।অনিলা দেবী তখন কোনো রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না।গীতা অবলীলায় পিসীকে বলে দিলেন; 'টেনিস খেলতে গিয়েছিলাম।' অনিলার রুক্ষ জবাব; 'টেনিস মাঠে আজকাল চোরকাঁটা থাকে নাকি?' প্রায় জঙ্গলের ভিতরে পার্টির গোপন চিঠি পৌঁছে দেওয়ার ফলে গীতার শাড়ি তখন চোরকাঁটায় ভরে গিয়েছে!
প্রায় দুধের সন্তানকে নিয়ে পার্টির কাজেই বিশ্বনাথ- গীতা কাশ্মীর গিয়েছিলেন। দলীয় কাজের গোপনীতায় তাঁরা উঠেছিলেন হাউজবোটে। কাশ্মীরের সেই প্রবল ঠান্ডা সহ্য করতে না পেরে সেখানেই তাঁদের শিশু সন্তানটির অকাল মৃত্যু হয়। সেই সন্তানটি ছিলেন কমবেশি রাজীব গান্ধি, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যদের বয়সি। তাই রাজীব- বুদ্ধদেবদের প্রতি চিরকাল একটা অপত্য স্নেহ ছিল গীতার।
নয়ের দশকের গোড়ার দিক। বাবরি মসজিদ তখনও ধ্বংস হয়নি। হুগলির পুরশুড়া অঞ্চলে মুন্ডেশ্বরী নদীর বালি খাদ নিয়ে সিপিআই (এম), আরসিপিআই-এর সংঘাত। জয়নুল খান নামক এক স্থানীয় সিপিআই ( এম) নেতার সঙ্গে এই বালিখাদ ঘিরেই ওই দলের সংঘাত। গীতার আপত্তি থাকলেও সিপিআই-এর হুগলি জেলা পরিষদের (ওঁদের দলে ' জেলা পরিষদ ' বলা হয় জেলা কমিটিকে) সেই সময়ের সম্পাদক ধীরেন দাশগুপ্ত জয়নুলকে সিপিআই-তে নিয়েছেন। অনিল বসু তখন আরামবাগের দোর্দন্ডপ্রতাপ সাংসদ।বস্তুত তাঁরই অঙ্গুলিহেলনে গীতা মুখোপাধ্যায়ের মতো প্রবীণ সাংসদ ,যাঁকে খোদ দেশের প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত বিশেষ সম্মান করেন, হরিণখোলা থানায় ওই এলাকার এসডিপিও প্রচন্ড তর্কযুদ্ধে জড়িয়ে পড়লেন। থানার ভিতরে ক্ষুব্ধ গীতা এসডিপিও-কে বললেন; 'গলার জোরে আপনি আমাকে হারাতে পারবেন না।'
এই সিরিজের অন্য লেখা পড়ুন-বাঁধভাঙা আবেগে গৌরীপ্রসন্নকে জড়িয়ে ধরলেন বঙ্গবন্ধু, অদেখা আলোয় বাঙালির চেনা নেতা
হয়তো অনিল বসুর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে থাকতে পারেন, এই সময়ে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যও কলকাতায় তর্ক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লেন গীতার সঙ্গে। গীতার দল সিপিআই-এর একটা সময়ে কংগ্রেসে থাকা ঘিরে কটাক্ষ করলেন। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের এই আক্রমণে ব্যক্তিগত ভাবে অত্যন্ত আঘাত পেয়েছিলেন গীতা।কারণ, বুদ্ধদেবকে তিনি সন্তানবৎ স্নেহ করতেন।আর অনেকেরই হয়তো জানা নেই,জরুরি অবস্থাকে সমর্থন করবার প্রশ্নে সেই সময়ে সিপিআই-এর জাতীয় পরিষদে সব থেকে আপত্তি ছিল বিশ্বনাথ- গীতার, যেমন আপত্তি ছিল গীতার দেবগৌড়া মন্ত্রীসভায় প্রবেশের প্রশ্নে।
ফুলবাগান থানার ভিতরে নেহারবানু ধর্ষণের ঘটনায় ক্ষুব্ধ গীতা বলেছিলেন; 'ধর্ষণকারীকে ধরে চাবকানো উচিত।' জ্যোতি বসু মন্তব্য করেছিলেন, 'এখানে শরিয়তী আইন নেই'। ক্ষুব্ধ গীতার উত্তর ছিল; 'বুকের ভিতরটা যখন জ্বলে যায়, তখন তা নিয়ে উপহাস করা অন্তত আমি পছন্দ করি না।'