বদলে যাবে বৃদ্ধাশ্রমের মানে, রতন টাটা বুঝিয়ে দিলেন অন‍্য ধনকুবেরদের থেকে কতটা আলাদা তিনি

“যে একা থাকে সেই একাকীত্বের যন্ত্রনার বোঝে”
- রতন টাটা

শুধু মুখে বলা নয়, রতন টাটা মানে কাজে করে দেখানো সকলেই জানেন। এবারেও তেমনটাই হলো। সম্প্রতি মুম্বইতে অবস্থিত Goodfellow বলে এক স্টার্ট আপ কোম্পানিতে বড়সড় বিনিয়োগ করলেন রতন টাটা। এর আগেও বহু বার বহু স্টার্ট আপ কোম্পানিকে তাদের স্বপ্নপূরণের জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন তিনি। কিন্তু এবার ব্যাপারটা একটু অন্য। Goodfellow নামক এই কোম্পানি দশটা পাঁচটার অফিস নয়, তাহলে ?Goodfellow সম্পূর্ণ অন্য আদর্শে তৈরি সংস্থা যার  মূল লক্ষ্য হল বয়স্ক ব্যক্তিদের সাহায্য করা।  যে বয়স্ক ব্যক্তিরা বৃদ্ধাশ্রমে থাকেন বা একাকী জীবন কাটান সেই সকল ব্যক্তি সঙ্গএ আজকের তরুণ প্রজন্মের এক যোগসূত্র গড়ে তোলা। সহজ কথায় বলতে গেলে আজকের তরুণ প্রজন্ম যাতে সেই সকল বয়স্ক মানুষদের সাথে কিছুটা সময় কাটাতে পারে, তাদের আনন্দ দিতে পারে। এই Goodfellow স্টার্ট আপ কোম্পানি প্রথম শুরু হয় ৬ মাস আগে শান্তনু নায়াডুর হাত ধরে। শান্তনু টাটা গ্রুপের জেনারেল ম্যানেজার, সেই সঙ্গে রতন টাটার তরুণ বন্ধুও বলা চলে। আর দশটা ব্যবসায়ীর থেকে আলাদা রতন টাটা কিছুদিনের মধ্যেই এগিয়ে এলেন যাতে এই প্রতিষ্ঠানকেও বড় করে তোলা যায়।

বৃদ্ধাশ্রম শব্দটার সঙ্গে আমরা মোটামুটি পরিচিত। বুড়ো বয়সে বাবা মা, দাদু দিদা, ঠাম্মাকে নিজের বাড়ি ছেড়ে অন্য কোনও প্রবীণ আবাসনে প্রায়শই রেখে আসেন। অনেক সময় ছেলেমেয়ে প্রবাসে চলে গেলে বাবা-মাকে বৃদ্ধাশ্রমে রাখা ছাড়া কোনো বিকল্প থাকে না, হয়তো প্রবীণরা কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিজেরাও এই বিকল্প বেছে নেন। কিন্তু যে পরিবারের সঙ্গে তার নাড়ির সম্পর্ক, সেই পরিবার ভেঙে হঠাৎ করে অন্য একটি বাস্তুতন্ত্রে মানিয়ে নেওয়া খুব সহজ কথা নয়। তার উপর বহু বৃদ্ধাশ্রমেই পরিচ্ছন্নতার সমস্যা থাকে, ব্যবস্থাপনার মান ততটা ভালো থাকে না। ফলে দিন কাটে নাভিশ্বাস।

বৃদ্ধাশ্রম ধারণার জন্ম অবশ্য আজ নয়।  প্রথম বৃদ্ধাশ্রম তৈরি হয় চিনে। চিনের শান রাজবংশ গৃহহারা, অবহেলিত ও অসহায় বয়স্কদের জন্য আশ্রয় কেন্দ্র হিসেবে এই উদ্যোগ নিয়েছিল। খ্রিস্টপূর্ব ২২০০ শতকে পরিবার থেকে বিতাড়িত বয়স্ক মানুষদের জন্য এই আশ্রয়স্থল নির্মাণ করে ইতিহাসে এক আলাদা স্থান দখল করে নিয়েছিল শান রাজবংশ। এরপর প্রাচীন চিনের এই ধারণা আস্তে আস্তে সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল। তাছাড়া মহাভারত-রামায়ণেও বারবার বানপ্রস্থের কথা ফিরে আসে, সরাসরি তা বৃ্দ্ধাশ্রমের প্রসঙ্গ না হলেও, একটা বয়সে একা হয়ে যাওয়াকেই বোঝায়।

কিন্তু শুধু কী অবহেলিত মানুষই এই বৃদ্ধাশ্রমে আসেন ? না তা কিন্তু জোর দিয়ে বলা যাবে না। এমন অনেক মানুষ আছেন যারা নিজের ইচ্ছেয় এসেছেন বা কেউ এমনও আছেন যাদের ইচ্ছে না থাকলেও আসতে হয়েছে। অবহেলায় নয়, বৃদ্ধাশ্রমে প্রবীণরা আসছেন একাকিত্ব ঘোচাতে। তাই অনেকেই বৃদ্ধাশ্রম বেছে নিয়েছেন স্বেচ্ছায়৷ আবার ইলেকট্রিক বিল জমা দেওয়া, কলমিস্ত্রিকে খবর দেওয়া – এসব গেরস্থালির কাজে জেরবার হয়ে যাচ্ছিলেন মধুজা সরকার৷ অবিবাহিতা, বছর পঁচাত্তরের এই বৃদ্ধা নির্ঝঞ্ঝাটে থাকতেই বেছে নিয়েছেন বৃদ্ধাশ্রম৷

অন্য ভাবে ভাবলে, চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতির ফলে মানুষের আয়ু বাড়ছে৷ বাড়ছে বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের সংখ্যা৷ বাড়ছে তাঁদের সমস্যাও৷ সমাজের পরিবর্তিত মূল্যবোধ, পারিবারিক অবহেলা, কোনও কোনও ক্ষেত্রে সাংসারিক অশান্তিও হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রবীণ-প্রবীণাদের বাড়িতে থাকার পথে বাধা৷ হাসনাবাদের মাতঙ্গিনী বৈদ্য থাকছেন চেতলার একটি বৃদ্ধাশ্রমে৷ ছেলেকে বাড়ি লিখে দেওয়ার পর ছেলে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে তাঁকে৷ কিংবা হাতিবাগানের একটি বৃদ্ধাশ্রমের আবাসিক ঋতা দত্ত ছেলের মৃত্যুর পর নাগের বাজারে ছেলের ফ্ল্যাটে কিছুতেই থাকতে রাজি ছিলেন না৷ প্রতিনিয়ত মৃত ছেলের স্মৃতি যেন তাঁকে তাড়া করে বেড়াতো৷ তাই দু ক্ষেত্রেই বৃদ্ধাশ্রমের ঠিকানাটা তাঁদের বেঁচে থাকার সহায়ক হয়ে উঠেছিল৷

স্যাঁতসেঁতে, আলো-বাতাসহীন ঝুপসি ঘরে চট গায়ে বৃদ্ধার পড়ে থাকার দৃশ্য আজ চলচ্চিত্রে পাওয়া গেলেও বাস্তবে পাওয়া যায় না৷ নিপীড়িত নির্যাতিত হয়ে বাড়িছাড়া নন আজ শহরের অধিকাংশ বৃদ্ধ-বৃদ্ধা৷ বরং এসবের থেকেও আজ শহরের বৃদ্ধাশ্রম গুলোতে প্রবীণ-প্রবীণাদের সংখ্যা বাড়ছে স্রেফ নিজের মতো করে থাকার প্রবল ইচ্ছে থেকে৷ তুলনা টানা যেতে পারে প্রয়াত পরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষ পরিচালিত ‘দহন’ ছবিতে সুচিত্রা মিত্র অভিনীত চরিত্রটির সঙ্গে৷ সংসারে অবাঞ্ছিত না হয়েও তিনি নিজের মতো করে বাঁচতে চেয়েছিলেন বলে বেছে নিয়েছিলেন বৃদ্ধাশ্রম৷ বাস্তবেও এমন সংখ্যাটাই বেশি৷

দমদম ক্যান্টনমেন্টের ‘স্বপ্ননীড়’ বৃদ্ধাশ্রমের পরিচালক সঞ্জয় সুরের কন্ঠেও একই সুর শোনা গেল৷ তিনি বললেন, ‘‘বৃদ্ধাশ্রম মানেই পারিবারিক অশান্তিতে সবাই বাড়ি ছেড়ে আসেন, এমনটা নয়৷ মাত্র ২০ থেকে ২৫ শতাংশ লোক পারিবারিক অশান্তিতে আসেন৷ বাকিরা একাকিত্ব দূর করতেই আসেন”৷ স্বপ্ননীড়ে ৪৮ জন বৃদ্ধ-বৃদ্ধা আছেন৷ ৮৪ বছরের গীতা গুপ্ত এখানকার সবচেয়ে পুরোনো আবাসিক৷ দশ বছরেরও বেশি সময় ধরে তিনি এই বৃদ্ধাশ্রমে৷ ‘কেমন আছেন’? জিজ্ঞেস করলে কোনও কান্নাকাটি নয়, বরং বেশ ঝরঝরে গলায় বললেন, ‘ভালোই আছি আমরা’৷ জানা গেল, একসঙ্গে বসে টিভি দেখা, গীতা পাঠ বা রেডিও শোনাতেই তাঁর দিন কাটে৷ মাঝে মাঝে মেয়ের বাড়ি থেকে ঘুরেও আসেন৷ স্বপ্ননীড়ে পিঠের সময় পিঠেপুলি পাওয়া বা তালের বড়ার মতো বাঙালি খাবার পাওয়াটা দারুণ প্রাপ্তি বলে জানান তিনি। তাঁরা সবাই আশির উর্দ্ধে, বৃদ্ধাশ্রমে ৪-৫ বছরের বেশি রয়েছেন৷ অবসর কাটানোর জন্য একটু গল্প করা, সিনেমা দেখাতেই তাঁরা খুশি৷ কেউ লাঠি ছাড়া হাঁটতে পারেন না, কেউ বা চোখে ভালো দেখতে পান না৷

এটাই ঘটনা৷ আজকালকার ইঁদুরদৌড়ের জীবনে আর নিউক্লিয়াস পরিবারে সুপ্রতিষ্ঠিত চাকুরে সন্তান থাকা সত্বেও বৃদ্ধ বাবা-মাকে দেখার মতো কেউ থাকে না, কেননা, বেশিরভাগ সন্তানকে চাকরির জন্য শহরের বাইরে থাকতে হয়৷ এই ধরনের নিঃসঙ্গ বাবা-মায়েদের পরিষেবা দেওয়ার জন্য বৃদ্ধাশ্রম দরকার৷

বিশিষ্ট সমাজকর্মী হিসেবে সঞ্জয় সুরের এলাকায় পরিচিতি আছে৷ বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের নিয়ে সমাজসেবামূলক কাজে তাঁর অবদান লক্ষ্যণীয়৷ তাঁর মতে, আগের কনসেপ্ট এখন মিলবে না৷ আগে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসা মানেই আমরা আমাদের মা বাবাকে ফেলে রেখে এসেছি - এই ভাবনা ছিল৷ কিন্তু এখন বৃদ্ধাশ্রম একটা স্ট্যান্ডার্ড হোটেলের মতো৷ একটা অ্যাসোসিয়েশন পাওয়া যায় এখানে৷ পারস্পরিক ভাবের আদান প্রদানের জন্য মানসিক শান্তি বা নিরাপত্তার জন্য বৃদ্ধাশ্রমে থাকাই শ্রেয়৷ নিঃসন্তান দম্পতিরা অবসরের পরে বৃদ্ধাশ্রমে থাকবেন বলে খোঁজ নিয়ে যান আগেই৷

এইভাবেই কেউ অবহেলায় কেউ স্বেচ্ছায় বেছে নেন বৃদ্ধাশ্রমের জীবন। বৃদ্ধাশ্রম এখন আর আগের মতো নেই, বয়স্ক মানুষ যাতে সম্মানের সাথে, আনন্দে তাদের বাকি জীবন কাটাতে পারে সেইদিকে তাদের নজর থাকে। প্রয়োজনে অনেক বৃদ্ধাশ্রম সুন্দর চিকিৎসা ব্যবস্থারও আয়োজন করে। কিন্তু এত কিছুর পরেও যেটা তারা পান না তা হল আত্মীয় পরিবার পরিজনের সান্নিধ্য। আর ঠিক এই কাজটাই করতে আসছে Goodfellow স্টার্ট আপ। এই কোম্পানির মূল কাজ হল যেসব বৃদ্ধ বা বৃদ্ধা একাকী থাকেন তাদের সঙ্গ দেওয়া অর্থাৎ যেমন ভাবে একজন নাতি নাতনি তাদের দাদু দিদার সাথে সময় কাটায় ঠিক এই ভাবেই কিছু তরুণ যুবক যুবতী ওইসব একাকী বয়স্ক মানুষদের সাথে সময় কাটাবে, খুনসুটি করবে, সিনেমা দেখবে, গল্প করবে। আপাতত সপ্তাহে তিনদিন ওই সংস্থার কর্মীরা সঙ্গ দেবেন যে কোনো গ্রাহককে। মাসিক চুক্তির ভিত্তিতে কাজ করবেন তারা। এই স্টার্ট আপ কোম্পানির উদ্বোধনে এসে নিজের একাকী থাকা নিয়ে মতামত শেয়ার করেছেন টাটা গ্রুপের কর্ণধার নিজে। রতন টাটার কথায়, ‘আপনারা জানেন না যে একা থাকতে কেমন লাগে ! বাধ্য হয়ে একা থাকতে না হলে, একাকীত্বের যন্ত্রণা আপনারা বুঝতে পারবেন না’। তিনি আরও বলেছেন, ‘কেউ বুড়ো হতে চায় না’।

নিজের স্টার্ট আপ সম্বন্ধে শান্তনু নাইডু বললেন, শুধুমাত্র মুম্বই না, তিনি এই স্টার্ট আপের মাধ্যমে সারা প্রবীণদের জন্য সেবা করতে চান। আপাতত মুম্বাইতে শুরু হলেও ধীরে ধীরে এই স্টার্ট আপ সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে চান যাতে কোনও প্রবীণ মানুষ একা থাকার যন্ত্রণা অনুভব করতে না পারেন। তারা যেন পরিবারের থেকে দূরে থেকেও এক অন্য পরিবারের সাথে কিছু সময়ের জন্য হলেও একটু আনন্দ উপভোগ করতে পারেন।

More Articles