অর্ধেক মাওনেতা নিকেশ! বাস্তারের মাওবাদী আন্দোলন শেষের মুখে?
Bastar Maoist: বাস্তার রেঞ্জের পুলিশ মহাপরিদর্শক সুন্দররাজ পি বলছেন, "আমরা সিপিআই-এর (মাওবাদী) শীর্ষ নেতৃত্বের ৫০ শতাংশেরও বেশি জনকে নিকেশ করেছি। আমরা আরও ১৫ জন শীর্ষ নেতার উপর নজর রাখছি।
ছত্তিশগড়ের জঙ্গল কি তবে মাওবাদী মুক্ত হওয়ার পথে? বিজেপি সরকার যে মাওবাদী নিকেশের পথে হেঁটেছে, তা বাস্তব হয়ে যাচ্ছে এবার? এই প্রশ্নগুলি বেশি করে ভাবাচ্ছে, গত ২১ মে আবুঝামাদের জঙ্গলের গভীরে মাওবাদী সুপ্রিমো বাসভরাজুর মৃত্যুর পর। মাওবাদীদের বিরুদ্ধে ভারত সরকারের দীর্ঘদিনের লড়াই, দীর্ঘদিনই জল-জঙ্গল-জমি বাঁচানোর লড়াইকে সামনে রেখে এই গহিন জঙ্গলকে রাষ্ট্রের মধ্যেই মুক্তাঞ্চল করে রাখা হয়েছে। তবে সেই যুদ্ধে কি ইতি পড়তে চলেছে এবার? রাষ্ট্রের নিরাপত্তাবাহিনী মনে করছে, কেবল একজন 'মোস্ট-ওয়ান্টেড বিদ্রোহীর' যাত্রার সমাপ্তি ঘটেনি বাসভরাজুর মৃত্যুতে। দেশে বহু দশক ধরে চলা মাওবাদী বিদ্রোহের 'অন্তিম অধ্যায়' রচিত হয়ে গেছে।
বাস্তার রেঞ্জের পুলিশ মহাপরিদর্শক সুন্দররাজ পি বলেছেন, "এটি কেবলমাত্র একটা এনকাউন্টার ছিল না। বছরের পর বছর ধরে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ, স্থল অভিযান এবং একাধিক সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ের চূড়ান্ত পরিণতি ছিল এটি। বাসভরাজুর পতন প্রতীকী। এটি আসলে মাওবাদী আন্দোলনের সর্বোচ্চ নেতৃত্ব কীভাবে ভেঙে পড়ছে তারই প্রতিফলনমাত্র।" শাসক বিজেপি সরকার বলেছিল, ৩১ মার্চের মধ্যে ভারতের মাটি থেকে মাওবাদ নির্মূল হয়ে যাবে। তবে সেই সময় সীমা পেরিয়ে গেলেও জঙ্গল কিন্তু এখনও শান্ত হয়নি। এখনও বাস্তারের জঙ্গলে বিপজ্জনক ডেরা আছে বলেই আশঙ্কা। তবে, সরকারের দাবি, ভারতের মোস্ট ওয়ান্টেড মাওবাদীদের যে তালিকা রয়েছে, তার মধ্যে সশস্ত্র বিদ্রোহের নেতৃত্বে থাকা সবচেয়ে বিপজ্জনক নেতাদের অনেকেই নিহত। কেউ কেউ জেলে বন্দি। কিন্তু কেউ কেউ এখনও লুকিয়ে আছেন, এখনও বন্দুক ছাড়েননি তাঁরা।
সম্পূর্ণ তালিকা প্রকাশও করেছে কেন্দ্র। তাতে এমন নামও আছে যা আগে কখনও প্রকাশ করা হয়নি। যাদের ছায়া এখনও বাস্তার এবং বাস্তারের অরণ্যের বাইরেও নিরাপত্তারক্ষীদের তাড়া করে বেড়াচ্ছে, সেই মাও নেতাদের নাম প্রকাশ করেছে রাষ্ট্র।
আরও পড়ুন- মাওবাদী দমনের একমাত্র পথ কি এনকাউন্টার?
১. মোপাল্লা লক্ষ্মণ রাও ওরফে গণপতি
মাওবাদী আন্দোলনের অন্যতম স্তম্ভ। গণপতি এখনও আত্মগোপন করে থাকা সবচেয়ে সিনিয়র বিদ্রোহীদের একজন।
২. মল্লোজুলা ভেনুগোপাল ওরফে ভূপতি
কৌশলী এবং শক্তিশালী। মনে করা হয়। ভূপতি বিক্ষিপ্ত ক্যাডারদের পুনর্গঠন করতে সক্ষম কয়েকজন নেতার মধ্যে অন্যতম।
৩. থিপ্পারি তিরুপতি ওরফে দেবজি / সঞ্জীব / রমেশ
সবচেয়ে মারাত্মক আক্রমণগুলির নেপথ্যে এই নেতা রয়েছেন বলে অভিযোগ। নিরাপত্তা বাহিনীর কাছে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার এখন দেবজিকে ধরা।
৪. মিশির বেসরা ওরফে ভাস্কর
তিনি মূলত যোগাযোগ এবং প্রচারের দিকটি দেখেন।
৫. কাদ্রি সত্য নারায়ণ রেড্ডি ওরফে কোসা
তিনি দলের সবচেয়ে অভিজ্ঞ কৌশলবিদদের একজন। বিভিন্ন অঞ্চলে কাজ করছেন কোসা।
৬. পুল্লারি প্রসাদ রাও ওরফে চন্দনা
৭. মডেম বালকৃষ্ণ ওরফে বালান্না
৮. গণেশ উইকে ওরফে রাজেশ তিওয়ারি
৯. অনল দা ওরফে তুফান/পতিরাম মাঞ্জি
১০. গজরালা রবি ওরফে উদয়
১১. সব্যসাচী গোস্বামী ওরফে অজয় দা
১২. রাজচন্দ্র রেড্ডি ওরফে কাত্তা রামচন্দ্র
১৩. সুজাতা ওরফে কল্পনা
১৪. ঠেন্টু লক্ষ্মী ওরফে নরসিংহ চালাম
১৫. মাদভি হিদমা ওরফে হিদমান্না
২০২১ সালের সুকমা হামলা সহ একাধিক মারাত্মক অতর্কিত হামলায় অভিযুক্ত হিদমান্না সম্ভবত বাস্তারে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর মাওবাদী নেতা।
এনডিটিভির এক প্রতিবেদনে জানা যাচ্ছে, বাস্তার রেঞ্জের পুলিশ মহাপরিদর্শক সুন্দররাজ পি বলছেন, "আমরা সিপিআই-এর (মাওবাদী) শীর্ষ নেতৃত্বের ৫০ শতাংশেরও বেশি জনকে নিকেশ করেছি। আমরা আরও ১৫ জন শীর্ষ নেতার উপর নজর রাখছি। তাদের অনেকেই বৃদ্ধ, ক্লান্ত এবং কেউ কেউ আত্মসমর্পণের কথা ভাবছেন... তাদের প্রতি আমাদের স্পষ্ট আবেদন — মূলধারায় ফিরে আসুন। এই যুদ্ধ মৃত্যু দিয়ে শেষ নাও হতে পারে।"
আরও পড়ুন-বিপ্লবী ছাত্র থেকে সশস্ত্র মাওবাদী কমান্ডো! কেন কেশব রাওয়ের মৃত্যু মাওবাদীদের জন্যে বড় ধাক্কা?
সত্যিই কি মাওবাদী আন্দোলন পতনের মুখে?
গত তিন বছরে, সিপিআই-এর (মাওবাদী) শীর্ষ নেতৃত্বের উপর ধারাবাহিক হামলা হয়েছে। পুলিশের দাবি, মাওবাদী কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের ৫০ শতাংশেরও বেশি নেতা হয় নিহত হয়েছেন অথবা বন্দি হয়েছেন। গত ১৭ মাসে, ছত্তিশগড় এবং পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলিতে মাওবাদী বিরোধী অভিযানে ৪০০ জনেরও বেশি মাওবাদী নিহত হয়েছেন। কিন্তু মাওবাদীদের মাথাদের নিকেশ করা এক বড় আঘাত এই মাও-বিদ্রোহের উপর।
বাস্তারে মাওবাদী বিরোধী অভিযানের নেতৃত্বে থাকা সুন্দররাজ পি ওই প্রতিবেদনে আরও বলেছেন যে, "সাম্প্রতিক বছরগুলিতে, মহারাষ্ট্রের গডচিরোলিতে সিপিআই (মাওবাদী) কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য দীপক তেলতুম্বদেকে হত্যা করা হয়েছিল। ছত্তিশগড়ের গড়িয়াবন্দে, আমরা চালাপথীর মৃতদেহ উদ্ধার করেছি। ২১ মে, আবুঝামাদে একটি ঐতিহাসিক অভিযান চালানো হয়েছিল, যেখানে আমরা শীর্ষ মাওবাদী কমান্ডার বাসভরাজুকে হত্যা করেছি। ঝাড়খণ্ডে, পলিটব্যুরো সদস্য প্রশান্তকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাঁর স্ত্রী শীলা, যিনি নিজেও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন, তিনিও কিছুক্ষণ পরেই ধরা পড়েন। কেন্দ্রীয় কমিটির চারজন সদস্য - রামান্না, রামকৃষ্ণ, হরিভূষণ এবং সুদর্শন - দক্ষিণ বাস্তারে বিভিন্ন সময়ে মারা যান এবং ঝাড়খণ্ডে, আমরা অরবিন্দজির মৃতদেহ উদ্ধার করেছি, যিনি অসুস্থতার কারণে মারা গিয়েছিলেন।"
যাদের নাম সুন্দররাজ পি করেছেন, তাঁরা সকলেই একসময় সিপিআই (মাওবাদী) নেতৃত্বের মূল কাণ্ডারী ছিলেন। মাওবাদী অভিযানের ইতিহাসে প্রথমবার, নিরাপত্তা বাহিনী শীর্ষ ১০ মাওবাদী নেতার মধ্যে ৮ জনকে নিকেশ করেছে। আর বাকি দু'জন জীবিত অবস্থায় ধরা পড়েছেন। তবে যুদ্ধ এখনও শেষ হয়নি। ১৫ জনেরও বেশি উচ্চপদস্থ মাওবাদী নেতা এখনও পলাতক। তাঁরা বনে লুকিয়ে আছেন
এবং যেকোনও মুহূর্তে বেরিয়ে আসতে পারেন, হামলা চালাতে পারেন, এই গল্পের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারেন। কারণ মাওবাদীদের রণকৌশল সর্বদাই গোপন, স্থানীয় সমর্থনের উপর নির্ভরশীল।
আবুঝমাদের ভেতরে যেখানে মাওবাদী নেতা বাসভরাজুকে হত্যা করা হয়, সেই জায়গাটি আবুঝমাদের একটি প্রত্যন্ত গ্রাম গুন্ডে কোট — ভারতের সবচেয়ে দুর্ভেদ্য এবং মানচিত্রহীন বনাঞ্চলগুলির মধ্যে একটি। এই অঞ্চলে, রাষ্ট্রের উপস্থিতি ন্যূনতম। রাস্তা, স্কুল এবং স্বাস্থ্যকেন্দ্রের মতো মৌলিক পরিকাঠামো এখনও অনুপস্থিত। এই গ্রামের এক তরুণী একবার জানিয়েছিলেন, "দুই বছর আগে, মাওবাদীরা আমাদের বাড়িতে এসেছিল। তারা দেখেছিল আমাদের ছয়টি সন্তান আছে। তারা আমার বাবা-মাকে বলেছিল, 'আমাদের একজনকে দাও।' ওরা আমার বড় বোন মাদকোকে নিয়ে গেছে। ওরা বলেছিল, বাচ্চা না দিলে পুরো গ্রামকে ওরা শাস্তি দেবে।" এই ধরনের গল্প বাস্তার জুড়ে খুবই সাধারণ। উল্টোদিকে সরকার সমস্ত ব্যবস্থাপনা নিয়ে উন্নয়নের প্রচারকে হাতিয়ার করে গ্রামে গ্রামে প্রবেশ করছে। ছত্তিশগড় সরকার মাওবাদীদের প্রভাবে থাকা অঞ্চলগুলিতে উন্নয়ন আনার প্রচেষ্টাও করছে। অর্থাৎ মাওবাদীদের থেকে গ্রামবাসীদের দূরত্ব বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। সচেতনতা এবং উন্নয়ন বৃদ্ধির মাধ্যমে কি স্থানীয় যুবক-যুবতীদের মাওবাদী হয়ে যাওয়া সরকার আটকাতে পারবে? মাঠেঘাটে কাজ করে যাওয়া কর্মীরা বলছেন— এমন ধাক্কার পর কিছুকাল নীরব থাকা, দল পুনর্গঠন করা এবং শক্তি বাড়িয়ে আবার ফিরে আসার ইতিহাস মাওবাদীদের আছে। আপাতত তাই, বাস্তারের জঙ্গলে নজরদারি চলছে।