২২ জানুয়ারিই বজরং দলের হাতে হত্যা হয় পাদ্রীর! প্রাণ প্রতিষ্ঠার আড়ালে হারাচ্ছে যে ঘটনার স্মৃতি
Babri Masjid and Ram Mandir : ২০০৩ সালের ২২ জানুয়ারির ভোর রাতে এই অস্ট্রেলিয়ান পাদ্রী, যিনি ১৯৬৫ সাল থেকে ওড়িশার কুষ্ঠরোগীদের জন্য কাজ করতেন, তাঁকে পুড়িয়ে মেরেছিল বজরং দল।
ইনস্টিটিউট অফ ডিফেন্স স্টাডিজের প্রাক্তন প্রধান ছিলেন কে সুব্রমানিয়ান, এখন আমাদের যিনি বিদেশ মন্ত্রী এস জয়শঙ্কর তাঁর বাবা। ২০১১ সালে
মারা যান তিনি। ২০০১ সালের গুজরাত দাঙ্গার পরে তিনি লিখেছিলেন একটি সর্বভারতীয় সংবাদপত্রে, "...যে মানুষ তাঁর নিজের প্রতিবেশীদের খুন করতে পারেন, পুড়িয়ে মারতে পারেন, তিনি আর যাই হন কিছুতেই হিন্দু হতে পারেন না।" ২০০২ সালের ৪ এপ্রিল এই লেখাটিতে তিনি লিখেছিলেন যে বেশ কিছু বছর পরে যদি রাম মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়েও যায় তাহলেও যারা আজ এই অপরাধ করেছেন, তাঁরা নিজেদের হিন্দু বলতে পারেন না কারণ হিন্দু ধর্ম এই অধিকার দেয় না। ২০০২ সালের পরে ২১ বছর কেটে গেছে। রামের প্রাণ প্রতিষ্ঠা হচ্ছে ২২ জানুয়ারি ২০২৪। চারিদিকে সাজ সাজ রব। এই রাম মন্দির এবং হিন্দুত্বের ভরসাতেই আগামী লোকসভা নির্বাচন লড়তে চলেছে বিজেপি এবং নরেন্দ্র মোদি।
আমরা যখন স্কুলে পড়ি তখন ২৩ জানুয়ারি, ২৬ জানুয়ারি বা ১৫ অগাস্ট দিনগুলো ছিল খুব আনন্দের। সুভাষ ছিলেন আমাদের হিরো। তাঁর নেতৃত্বে স্বাধীনতা সংগ্রাম, ব্রিটিশ বিরোধী লড়াই, আজাদ হিন্দ বাহিনী গঠন দেশের পড়ুয়াদের অনুপ্রেরণা জোগাত। তখনও আমাদের কাছে সঙ্ঘ পরিবার বা বিজেপি এই শব্দগুলো এতও প্রবল হয়ে ওঠেনি ফলত স্বাধীনতা সংগ্রামে তাঁদের সংগঠনের বা তাঁদের নেতাদের কী ভূমিকা ছিল, জানাও হয়নি। এর কিছুকাল পরে একদিন শোনা গেল অযোধ্যার ৪৫০ বছরের পুরনো একটি সৌধ, বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলা হচ্ছে। ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর, দেশ জুড়ে চূড়ান্ত উন্মাদনা। বাবরি মসজিদ ধ্বংস হওয়ার পরে যে দাঙ্গা শুরু হয়েছিল, তার আঁচ কলকাতায় পড়ে কিঞ্চিৎ। কার্ফিউ জারি হয়েছিল কলকাতাতেও। রাস্তায় তখন মিলিটারি টহল। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পরে সারা দেশে বহু মানুষ মারা গিয়েছিলেন সাম্প্রদায়িক হিংসায়। ‘কালা দিবস’ হিসেবে যে দিনটিকে পালন করে এসেছি, জাতীয় লজ্জার সেই দিনই আজ ‘শৌর্য দিবস’!
আরও পড়ুন- রাম মন্দির: বিরোধী দলগুলিকে নগ্ন করে দিল নতুন ভারত
সুমন, নচিকেতা, অঞ্জন দত্তদের জীবনমুখী গান ঠিক এই সময়েই আমাদের বড় হওয়ার সঙ্গে জড়িয়ে গেছে। হঠাৎ একদিন খবর পাওয়া গেল, ওড়িশার কেওনঝাড় অঞ্চলে এক খ্রিস্টান পাদ্রী ও তাঁর পরিবারকে পুড়িয়ে মেরে ফেলেছে বজরং দল। বজরং দল, রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘ সংগঠনগুলোর নাম প্রথম শুনি সুমনের গানেই।
“ঐ তো মানুষ ধর্মের কথা বলছে
আগুনে তিনটি মানুষের দেহ জ্বলছে
ঐ তো মানুষ ধর্মের কথা বলছে
আগুনে তিনটি মানুষের দেহ জ্বলছে
কেওনঝাড়ের আদিবাসীদের গ্রামে
বজরং দল মানুষ পোড়াতে নামে
বজরং দল মানুষ পোড়াতে নামেঐ তো কেমন ধর্মের ধ্বজা ওড়ে
আগুনে তিনটি মানুষের দেহ পোড়ে
ঐ তো কেমন ধর্মের ধ্বজা ওড়ে
আগুনে তিনটি মানুষের দেহ পোড়ে
হাতের সঙ্গে দুই নাবালক-ছেলে
বজরং দল দিয়েছে আগুন জ্বেলে
বজরং দল দিয়েছে আগুন জ্বেলেঐ তো কেমন ধর্মের ভগ্নাংশ
গন্ধ ছড়ায় মানুষের পোড়া মাংস
ঐ তো কেমন ধর্মের ভগ্নাংশ
গন্ধ ছড়ায় মানুষের পোড়া মাংস
পুড়ছে ছেলেরা, পুড়ছে তাদের বাপ
ধর্ম নিচ্ছে বেধর্মীদের মাপঐ তো কেমন ধর্মের খাঁটি দর্শন
সহজেই হয় ধর্মযাজিকা ধর্ষণ
ঐ তো কেমন ধর্মের খাঁটি দর্শন
সহজেই হয় ধর্মযাজিকা ধর্ষণ
কে ছিল হিন্দু, কে হলো খ্রিষ্টান
কে হলো বৌদ্ধ, কে হলো মুসলমানঐ তো কেমন ঘৃণার ঘৃণ্য আইন
শহিদ হলেন গ্রাহাম স্টুয়ার্ট স্টাইন্স
ঐ তো কেমন ঘৃণার ঘৃণ্য আইন
শহিদ হলেন গ্রাহাম স্টুয়ার্ট স্টাইন্স
থেকেছেন তিনি কুষ্ঠ রোগীর পাশে
তাঁর ধর্মটা মানুষকে ভালোবাসেআমার ধর্ম তোমায় জানিয়ে যাই
গানের দিব্যি আমি প্রতিশোধ চাই
আমার ধর্ম তোমায় জানিয়ে যাই
গানের দিব্যি আমি প্রতিশোধ চাই
আমার বোধের হাতিয়ারে শান দিয়ে
পুড়ছি আমিও তোমায় সঙ্গে নিয়েপুড়ছি আমিও তোমায় সঙ্গে নিয়ে
পুড়ছি আমিও তোমায় সঙ্গে নিয়ে’’
আজ যখন খাতায় কলমে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ দেশের সরকারের প্রধানমন্ত্রী রামমন্দিরে একটি পৌরাণিক চরিত্রের প্রাণ প্রতিষ্ঠা করবেন, তখন এই তারিখটি কীভাবে যেন মনে করিয়ে দিল ২০০৩ সালের ২২ জানুয়ারির কথা। সেই দিন ভোর রাতে এই অস্ট্রেলিয়ান পাদ্রী, যিনি ১৯৬৫ সাল থেকে ওড়িশার কুষ্ঠরোগীদের জন্য কাজ করতেন, তাঁকে পুড়িয়ে মেরেছিল বজরং দল। সরকার চায়, আমরা বেশ কিছু সাল-তারিখ ভুলে যাই, আর বেশ কিছু সাল-তারিখ যেন কোনওদিন না ভুলি। মানুষ যদি ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর, বা গুজরাত গণহত্যা বা গ্রাহাম স্টুয়ার্ট স্টাইন্স এবং তাঁর মৃত্যুর দিনক্ষণ মনে না রাখে তাহলেই বিজেপি সরকারের সুবিধা। যে সঙ্ঘ পরিবারের ইতিহাসে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের কথার বদলে ব্রিটিশদের পদলেহন করার কথা আছে, সেই ইতিহাস মুছে দিয়ে নতুন ইতিহাস তো লিখতেই হবে সঙ্ঘ পরিবারকে।
আরও পড়ুন- রামরাজ্যই সুখরাজ্য? বঙ্কিম থেকে আম্বেদকর, কী বলছেন ওঁরা?
সঙ্ঘ পরিবার এবং প্রধানমন্ত্রী বলতেই পারেন অযোধ্যায় সরযূ নদীর তীরে একটি মন্দির প্রতিষ্ঠা নিয়ে এত কীসের সমস্যা? যে মন্দিরের গায়ে রক্ত লেগে রয়েছে, যে মন্দিরের সঙ্গে মিথ্যা জড়িত আছে, তা কি আদৌ কোনও মন্দির? বিজেপি তাঁদের অভীষ্ট হিন্দুরাষ্ট্রের দিকে আরও এক কদম এগোল ঠিকই কিন্তু যে রাজনীতির মানুষরা নিজেরাই দীর্ঘদিন ধরে আইন ভেঙেছেন, নৈতিকতাকে দুরমুশ করেছেন, মানুষে মানুষে ঘৃণা ও বিদ্বেষের বিষ ঢুকিয়েছেন, তাঁরা কি
দেবতার অধিষ্ঠান বানানোর অধিকার পাওয়ারও যোগ্য?
যে দিনটিতে প্রধানমন্ত্রী এই রামমন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন, অর্থাৎ ২০২০ সালের ৫ অগাস্ট সেই দিনটি বাঙলা তারিখ অনুযায়ী ছিল ২০ শ্রাবণ। আজ থেকে প্রায় একশো বছর আগে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন সেই বিখ্যাত কবিতা ‘দীন দান’ যেখানে সাধু রাজাকে বলেছিলেন,
"শূন্য নয়, রাজদম্ভে পূর্ণ
সাধু কহে, আপনায় স্থাপিয়াছ, জগতের দেবতারে নহে”
যে রামমন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের জন্য এবং প্রাণপ্রতিষ্ঠার জন্য ১৪০ কোটি মানুষকে গর্বিত হতে বলছেন প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর দল, সেই মন্দিরে কি সত্যিই দেবতার অধিষ্ঠান সম্ভব? রবীন্দ্রনাথ প্রায় ১০০ বছর আগে এই প্রশ্ন তুলে দিয়ে গেছেন। যত প্রচারই করা হোক না কেন, ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর দেশের কলঙ্কময় দিন হিসেবেই থেকে যাবে। ২০২৩ সালের ২২ জানুয়ারি রামমন্দিরে প্রাণ প্রতিষ্ঠার দিনে কবীর সুমনের “শোনো গ্রাহাম স্টুয়ার্ট স্টাইন্স, আমি সংখ্যালঘুর দলে”-ই মনে পড়বে।