বীভৎসতাকে এভাবেও আঁকা যায়! কেন আজও যুদ্ধবিরোধী সেরা শিল্প পিকাসোর 'গুয়ের্নিকা'
Guernica by Picasso:
কেউ কলম ধরেছেন, কেউ প্ল্যাকার্ড, কেউ তুলি ধরেছেন তো কেউ আবার গলা ছেড়ে হাঁক দিয়েছেন জোটবদ্ধতার। যুদ্ধের বিরুদ্ধে শিল্প চিরকাল ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। আন্তর্জাতিক স্তরে এমনই মান্যতা পেয়ে এসেছে এক শিল্পকর্ম। গুয়ের্নিকা, বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী যুদ্ধবিরোধী ছবি হিসেবে গণ্য করা একে। চিত্রকর পাবলো পিকাসোর আঁকা নীল, কালো, সাদা, ৩.৫ মিটার (১১ ফুট) লম্বা এবং ৭.৮ মিটার (২৫.৬ ফুট) চওড়া একটি ম্যুরাল ক্যানভাস। ক্যানভাসের ছত্রে ছত্রে ফুটে ওঠে স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধের সময় গুয়ের্নিকা শহরের উপর নিক্ষিপ্ত বোমার আঘাতে ছিন্নবিচ্ছিন্ন নাৎসি বর্বরতার ভয়াবহতা। ছবিটি পরবর্তীতে শান্তি আন্দোলন ও যুদ্ধবিরোধী প্রতীক হিসেবে জাতিসংঘ কর্তৃক স্বীকৃতি পায়।
গুয়ের্নিকা মূলত স্পেনের একটি শহর। স্পেনে গৃহযুদ্ধের সময় হিটলারের নির্দেশে জার্মানি স্প্যানিশ জাতীয়তাবাদীদের পক্ষ নেয়। জেনারেল ফ্র্যাঙ্কোর জাতীয়তাবাদী, ফ্যাসিবাদ বাহিনীর যুদ্ধ বিমান ১৯৩৭ সালের ২৬ এপ্রিল বিকেলে রিপাবলিকান শক্ত ঘাঁটি গুয়ের্নিকা শহর আক্রমণ করে। মৃত্যু হয় প্রচুর নারী, শিশুর, ধ্বংস হয় শহরের বহু অংশ। পিকাসোর জন্ম স্পেনে হলেও তিনি দীর্ঘ বছর ফ্রান্সে কাটিয়েছেন। তবু জনমভিটের উপর এই ভয়াবহ আক্রমণ, বিশেষ করে শয়ে শয়ে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন নারী-শিশু মৃতদেহ দেখে ক্ষোভে, প্রতিবাদে পাবলো পিকাসো যুদ্ধবিরোধী বিশ্ববিখ্যাত গুয়ের্নিকা ছবিটি আঁকেন। ১৯৪০ সাল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানদের প্যারিস দখলের পর একবার এক নাৎসি অফিসার স্টুডিওতে পিকাসোর এই ছবিটি দেখে জিজ্ঞাসা করেন “এটি কি আপনার কাজ?” উত্তরে সেদিন পিকাসো বলেছিলেন “না, এটি আপনাদের কাজ।”
আরও পড়ুন- মোরবি থেকে বিলকিস, দাগ কাটছে না কিছুই! আবারও গুজরাতের রং হবে গেরুয়া?
স্পেনের গৃহযুদ্ধের সময় ১৯৩৭ সালে ফ্রান্সের আন্তর্জাতিক শিল্প প্রদর্শনীতে অংশ নিয়ে স্পেনের পক্ষ থেকে একটি ম্যুরাল তৈরির দায়িত্ব পান পিকাসো। সেইমতোই প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তিনি। কিন্তু ২৬ এপ্রিল গুয়ের্নিকায় ঘটা ভয়াবহ বোমারু বিমান হামলা তাঁকে মারাত্মকভাবে আহত করে। প্যারিস প্রদর্শনীতে তিনি যে ম্যুরাল আঁকার কথা ভেবেছিলেন তা বাদ দেন। সেই জায়গায় জন্ম নেয় বিশ্বখ্যাত যুদ্ধ বিরোধী ছবি ‘গুয়ের্নিকা’। ছবিটি তৈরির সময় একজন ফটোগ্রাফারকে তিনি প্রতিটি ধাপ ক্যামেরাবন্দি করার অনুমতি দিয়েছিলেন। ছবিটিতে দেখা যায় চওড়া চোখ, অদ্ভুত আকৃতির একটি ষাঁড়ের দিকে মুখ করে আর্তনাদ করছেন একজন মহিলা যার হাতে মৃত বাচ্চা। একটি আহত ঘোড়া পড়ে আছে, ষাঁড়ের লেজ যেন আগুনের ধোয়া। ঘোড়ার মাথার নিচে এক সৈনিক, যার হাতে ভাঙা তলোয়ার ও একগুচ্ছ ফুল। সৈনিকের অন্য হাতে কিছু নকশা যা হয়তো শান্তির প্রতীক। ছবির উপর প্রান্তে একটি জ্বলন্ত বাল্ব। ঘোড়ার উপরের ডান দিকে এক মহিলা বাতি হাতে জানলা দিয়ে ঘরের ভিতর উঁকি মারছেন। মহিলার নিচে আরেকটি মহিলা যিনি জ্বলন্ত বাল্বটির দিকে তাকিয়ে আছেন। বাঁপাশে আরেক জন মহিলা, যিনি তাঁর দুই হাত উপরে তুলে কিছু বলার চেষ্টা করছেন।
ছবিটি দেখলে আর্তনাদ করা নারী, মৃত শিশু, ষাঁড়, ঘোড়া, মৃত যোদ্ধা, ভাঙা তলোয়ার, বাল্ব, বাতি, ফুল, ছেঁড়া সংবাদপত্র— নানা কিছু চোখে পড়ে। সমালোচকরা নানা ভাবে একে ব্যাখ্যা করেছেন, বেরিয়েছে বহু গবেষণাধর্মী লেখা, বই। আলেহান্দ্রা এসক্যালোনা ছবিটি সম্পর্কে সৃষ্টির ৭৫তম বর্ষে এক আলোচনায় বিথোফেনের নবম সিম্ফোনির প্রসঙ্গ এনে বলেছেন, এটি একটি সাংস্কৃতিক প্রতীক যা শুধু যুদ্ধের বিরুদ্ধেই নয়, শান্তি এবং আশার কথাও বলে। এল সালভাদর থেকে বসনিয়া পর্যন্ত গণহত্যা নিয়ে কথা বলার সময় এটিকে গুরুত্বপূর্ণ একটি রেফারেন্স হিসেবে তিনি দেখেছেন।
ছবিটির অন্তর্নিহিত অর্থ ও ব্যাখ্যা জানতে আজও মানুষের চূড়ান্ত আগ্রহ। পিকাসো তাঁর জীবদ্দশায় যদিও খুব বেশি বিস্তারিতভাবে কিছু বলেননি। ম্যুরালের দু’টি প্রভাবশালী চরিত্র: ষাঁড় এবং ঘোড়া। শিল্প ইতিহাসবিদ প্যাট্রিসিয়া ফেইলিংয়ের মতে, “ষাঁড় এবং ঘোড়া স্প্যানিশ সংস্কৃতিতে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। পিকাসো নিজেও এই চরিত্রগুলিকে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন ভূমিকায় ব্যবহার করেছেন। ষাঁড় এবং ঘোড়ার নির্দিষ্ট অর্থ কাজটিকে আরও আকর্ষণীয় করেছে।” ষাঁড়কে অনেকে ফ্যাসিবাদী আক্রমণের প্রতিনিধিত্বকারী রূপক মনে করেন। পিকাসো বলেছিলেন, এর অর্থ বর্বরতা ও অন্ধকার। তিনি আরও বলেছিলেন, ঘোড়াটি গুয়ের্নিকা জনগণের প্রতিনিধিত্ব করছে। অনেকে মনে করেন, যেহেতু সংবাদপত্রে নিবন্ধ পড়ে পিকাসো গুয়ের্নিকা বোমা হামলা ও তার ভয়াবহতার কথা জানতে পারেন তাই চিত্রকর্মে ছেঁড়া সংবাদপত্র দেখা যায়। ম্যুরালে কিছু লুকানো ছবিও রয়েছে। যেমন একটি মাথার খুলি, যেটি ঘোড়ার শরীরের উপর। আরেকটি হল ঘোড়ার বাঁকানো পা থেকে তৈরি একটি ষাঁড়। ঘোড়া, ষাঁড় এবং আর্তনাদ করা মহিলার মুখে জিভের বদলে তিনটি ছোরা।
পিকাসো অনড় ছিলেন, স্পেন গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র রূপে প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত গুয়ের্নিকা ছবিটি স্পেনে ফিরবে না। ১৯৮১ সালে, ফ্রাঙ্কো এবং পিকাসোর মৃত্যুর পর অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে অবশেষে পিকাসোর জন্মশতবার্ষিকীতে ‘গুয়ের্নিকা’ ছবিটি নিয়ে আসা হয় স্পেনে। পিকাসোর জন্মবার্ষিকীতে ওইবছর প্রায় ১০ লক্ষ দর্শক ছবিটি দেখতে আসেন। ১৯৯২ সাল থেকে ছবিটি মাদ্রিদের রেইনা সোফিয়া মিউজিয়ামে রয়েছে।
আরও পড়ুন- ‘ভাবা প্র্যাকটিস’ নয়, আজ ঋত্বিককে ভুলতে পারলেই কেন সুবিধা বাঙালির?
ল্য মুঁল্যা দ্য লা গালেৎ, দ্য ব্লু রুম, ওল্ড গিটারিস্ট, সেল্ফ-পোর্ট্রেট, টু নুডস, থ্রি মুজিশিয়ানস, মডেল অ্যান্ড ফিশবৌল, আভাগঁর রমণীবৃন্দ, থ্রি ড্যান্সার্স, গিটার, গ্লাস অব আবস্যাঁৎ, সিটেড বাথার, পালোমা, লেই দেমোয়াজেল দে'ভিনিয়োঁ-র মতো এক একটি বিশ্বখ্যাত ছবির চিত্রকার পিকাসো বলেছিলেন, “ক্লান্ত হলে তো অনেক আগেই মারা যেতাম। ক্লান্তি নেই বলেই তো একজন শিল্পী এতদিন বেঁচে থাকে।” তিনি বেঁচে আছেন, তাঁর গুয়ের্নিকার মতো ছবি আজও ক্লান্তিহীন ভাবে পক্ষ নিচ্ছে জালিমের বিরুদ্ধে মজলুমের পক্ষে। পক্ষ নিচ্ছে মুক্তিকামী জনতার, গুয়ের্নিকা থেকে প্যালেস্তাইন, কাশ্মীর থেকে মণিপুরের। ফ্যাসিবাদ ও যুদ্ধবিরোধী এক মূর্ত প্রতীক হিসেবে।