ধর্ষকদের ছাড় দেওয়া, ব্রিজ দুর্ঘটনার পরেও কেন গেরুয়াতেই ঝুঁকে গুজরাট

Gujarat Elections 2022: গুজরাতে ক্ষমতা হারানোর ভয় কি আদৌ আছে বিজেপি-র?

‘বিবিধের মাঝে দেখ মিলন মহান’ দেশের কথা লিখে গিয়েছিলেন কবি। জনগণের মনের জাগরণ ঘটাতে গেয়েছিলেন গান। কিন্তু বাঙালি কবি গুজরাতের মন কতটা পড়তে পেরেছিলেন, এই প্রশ্ন অবান্তর নয়। কারণ ইতিহাস বলছে, স্বাধীনতার আগে হোক বা পরে, গুজরাতের রাজনীতি ও সমাজনীতি বরাবরই একমুখী। স্বাধীনতার ‘অমৃতকাল’-এও বিশেষ রদবদল ঘটেনি। নইলে ২০০২-এর গণহত্যা, বিলকিস বানোর প্রতি ঘোর অবিচার, মোরবিতে মানুষের ঘটানো সলিল-সমাধির পরেও ‘গুজরাত মডেল’-এর গুণকীর্তন শোনা যেত না। চোখের সামনে শিক্ষা, দীক্ষা, বীক্ষা ধূলিসাৎ হতে দেখেও গুজরাতে ভারতীয় জনতা পার্টি-র ভোটের ঝুলি উপচে পড়ার ভবিষ্যদ্বাণী শোনা যেত না দিকে দিকে।

‘এক দেশ এক নির্বাচন’ হোক বা ক্ষমতার একত্রীকরণ, অথবা ধর্মের নিরিখে নাগরিকত্ব প্রদানের নিদান, বিশেষ সম্প্রদায়কে দেশছাড়া করার আহ্বান, গত আট বছরে একটু একটু করে গণতান্ত্রিক পরিকাঠামোর পলেস্তরা ধসে গিয়েছে অনেকটাই। চুনকাম চাপিয়ে ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনে তার ওপর প্রলেপ দেওয়ার স্বপ্ন বুনছেন অনেকেই। ভারতীয় রাজনীতির এই সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে গুজরাতের দিকে তাই তাকিয়ে রয়েছেন অনেকেই। ঘরের মাঠে বিজেপি-র মোকাবিলা করতে পারলেই, বাকি পথ পেরনোর অক্সিজেন জোগাড় হয়ে যাবে বলে মনে করছেন তাঁরা। কিন্তু তাঁদের স্বপ্ন যে মাঠে মারা যেতে পারে, তার ইঙ্গিত মিলেছে ইতিমধ্যেই।

ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই বিধানসভা নির্বাচনের ভোটদান মিটে গিয়েছে গুজরাতে। দ্বিতীয় সপ্তাহে ফলাফল প্রকাশ। কিন্তু বুথফেরত সমীক্ষা অনুযায়ী, গুজরাতে আরও একবার প্রত্যাবর্তন ঘটতে চলেছে বিজেপি-র। আগাম পূর্বাভাস অনুযায়ী, ১৮২ আসনের গুজরাত বিধানসভায় অর্ধেকেরও বেশি, ১৩২ আসন বিজেপি-র দখলেই থাকবে। ২০১৭ সালে প্রত্যাশা জাগালেও, এবার আরও নেমে সাকুল্যে ৩৮ আসন পেতে পারে কংগ্রেস। বরং প্রথমবার গুজরাতে পা রেখে কংগ্রেসর ভোট কেটে নিয়ে যেতে পারে আম আদমি পার্টি। সেক্ষেত্রে গুজরাতের ভূমিপুত্র নরেন্দ্র মোদি আরও একবার অদম্য প্রমাণিত হবেন। ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনের আগে আরও ক্ষমতা বাড়বে তাঁর দল বিজেপি-র।

আরও পড়ুন: মোদি ম্যাজিক না কি শাহি-শ্রম? কোন মন্ত্রে গুজরাতে ফের পদ্ম-হাতছানি

রাজনীতির ময়দানে দুর্বল পক্ষ বরাবরই বুথফেরত সমীক্ষাকে খাটো করে দেখে। এবারও তার অন্যথা হচ্ছে না। রাহুল গান্ধী ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’ নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও, প্রচারে ন্যূনতম সময় ব্যয় না করলেও, এ‌বারে তাদের ক্ষমতায় আসা আটকানো যাবে না বলে দৃঢ় বিশ্বাস কংগ্রেসের। কিন্তু ২০১৭-য় বিজেপি-কে কড়া টক্কর দেওয়া কংগ্রেসে, গুজরাতের আহমেদ প্যাটেলের অভাব টের পাওয়া যাচ্ছে ভালোমতোই। দলবদলের হিড়িকে ২০১৭-য় পাওয়া জেতা আসনসংখ্যাও কমেছে। তার ওপর অরবিন্দ কেজরিওয়াল এবং তাঁর দল আপের ভোটে ভাগ বসানোর ঝুঁকিও রয়েছে। বুথফেরত সমীক্ষাতেও তাই ব্যাকফুটেই রয়েছে কংগ্রেস।

কংগ্রেসের কেউ কেউ বলছেন, বিলকিস বানোর ধর্ষকদের মুক্তি দেওয়ার মাসুল গুনতে হবে বিজেপি-কে। সংখ্যালঘু মুসলিম এবং মহিলারা কংগ্রেসের থেকে মুখ ফেরাবেন না। নির্বাচনী ইস্তেহারে বিলকিসের ধর্ষকদের ফের জেলে পাঠানোর প্রতিশ্রুতিও তাঁদের পক্ষেই যাবে বলে দাবি কংগ্রেস নেতাদের একাংশের। একই সঙ্গে মোরবিতে ঝুলন্ত সেতু বিপর্যয়ে শতাধিক প্রাণহানি, সেতুর টেন্ডার নিয়ে দুর্নীতি, কারচুপির সুফলও ভোটবাক্সে প্রতিফলিত হবে বলে মনে করছেন তাঁরা। সর্বোপরি দলিত নেতা জিগনেশ মেভানি রয়েইছেন। পাটিদার নেতা হার্দিক প্যাটেলের দলবদলও প্যাটেলদের কংগ্রেসমুখী করবে বলে আশাবাদী কেউ কেউ।

কিন্তু গুজরাতের রাজনৈতিক ইতিসাহ সাক্ষী, দাঙ্গা, গণহত্যা, ধর্ষণ, ভুয়ো এনকাউন্টার, কোনও কিছুই গুজরাতকে টলায়নি। গুজরাত থেকেছে গুজরাতেই। মাঝে এদিক-ওদিক সামান্য টাল খেলেও, ফের ‘নিরাপদ’ আশ্রয়কেই ভরসা করেছে তারা। তার ইঙ্গিতও মিলেছে ইতিধ্যেই। কারাবাসের দীর্ঘ সময় প্যারোলে কাটিয়ে দেওয়া, তার পরেও শ্লীলতাহানিতে অভিযুক্ত হওয়া, বিলকিসের ১১ জন ধর্ষকের মুক্তিতে দেশজুড়ে সমালোচনা হলেও, মোমবাতি মিছিল তো দূর, সরকারি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে মুখ খোলার তাগিদও অনুভব করেননি গুজরাতের সিংহভাগ নাগরিক। জেলের বাইরে থেকে মিষ্টিমুখ করিয়ে, মালা পরিয়ে তাঁদের বীরের সম্মানে সমাজে জায়গা পেতে দেখেও, তেমন ওজর-আপত্তি শোনা যায়নি রাজ্যবাসীর মুখে।

একই কথা প্রযোজ‍্য মোরবি বিপর্যয়ের ক্ষেত্রেও। দুর্নীতি, কারচুপির জলজ্যান্ত প্রমাণ হাতের কাছে থাকলেও, শিশু-সহ শতাধিক মানুষের সলিল সমাধিতে দেশে, এমনকী, বিদেশে সমালোচনা হলেও, গুজরাত মোটামুটি নীরবই থেকেছে। ঘড়ি তৈরির সংস্থা সেতু মেরামতির বরাত পেল কেন, সামান্য টাকা মাইনের টিকিট বিক্রেতা, নিরাপত্তারক্ষী গ্রেফতার হলেও, সংস্থার মালিক কীভাবে অধরা থেকে যান, আদ্যোপান্ত দুর্নীতির প্রমাণকে কীভাবে দৈব ঘটনা বলে তুলে ধরা হয় আদালতে, প্রশ্ন তোলেননি গুজরাতে। বরং মানুষ সেতুতে উঠতে গেলেন কেন, চায়ের দোকানে, রাস্তার মোড়ে, যুক্তি হয়ে উঠে এসেছে পাল্টা প্রশ্ন, যাতে বিজেপি সরকারের প্রতি নিষ্ঠা এবং আনুগত্যই প্রতিফলিত হয়েছে।

আর বিজেপি-র কথা! নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহ ভূমিপুত্র হওয়ার দরুণ, গুজরাত তাদের কাছে মর্যাদার লড়াই। কিন্তু গুজরাতে ক্ষমতা হারানোর ভয় কি আদৌ আছে বিজেপি-র? থাকার কোনও কারণও নেই। কারণ ২০০২ সালের দাঙ্গার পর আরও ফুলেফেঁপে ওঠে তাদের ভোটবাক্স। কচ্ছে লবণ-শ্রমিকরা ৩০ দিনে একবার পানীয় জল পেলেও, ‘গুজরাত মডেল’-এর স্বপ্ন হইহই করে বিকিয়েছে গোটা দেশে। মোষের শিংয়ের গুঁতোয় ট্রেনের গতি থামলেও, গুজরাতবাসীর স্বয়নে-স্বপনে বুলেট ট্রেন ছোটাতে পেরেছে তারা। আর রইল সংখ্যালঘু ভোট, ছ’কোটির জনসংখ্যায় মুসলিম মাত্র সাড়ে ৪৫ লক্ষ। তাদের ভোট না পেলেও, ক্ষমতায় আসা আটকাবে না বিজেপি-র।

তাই বিলকিসের ‘ব্রাহ্মণ সন্তান’ ধর্ষকদের দরাজ সার্টিফিকেট দেওয়া নেতা সিকে রাহুলজি-কে গোধরায় প্রার্থী করার আগে দ্বিতীয় বার ভাবতে হয় না বিজেপি-কে। গুজরাত দাঙ্গায় দোষী সাব্যস্ত, জামিনে ঘুরে বেড়ানো মনোজ কুলকার্নির ৩০ বছরের মেয়ে পায়েল প্রার্থী হন নারোদায়, ২০০২ সালে যেখানে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় ৯৭ জন মুসলিম নাগরিককে, মুসলিম মেয়েদের ধরে ধরে নিগ্রহ, গণধর্ষণ করা হয়। তাই কংগ্রেস বিজেপি-কে হারানোর দিবাস্বপ্নে মশগুল থাকলেও, দলের তরুণ নেতা, গুজরাতের ভূমিপুত্র জিগনেশ স্বীকার করে নেন যে, বিলকিসের প্রতি হওয়া অবিচার কংগ্রেসকে ভোট বাড়াতে সাহায্য করবে না কোনও ভাবেই। বিজেপি সরকারের বিরোধিতা করার উদ্যমই নেই মানুষের মধ্যে। আর যদিও বা ঘটে যায় কোনও মিরাকল, চার্টার্ড বিমান, নিরাপদ রাজ্য, বিলাসবহুল গেস্ট হাউস রয়েইছে। দান উল্টে দিতে বেশি সময় লাগার কথা নয়।

More Articles