গাজায় গুলেন-বেরি সিনড্রোম! ইজরায়েলি হানাদারির মধ্যেই হু হু করে বাড়ছে এই রোগ

Syndrome in Gaza: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তথ্য অনুযায়ী, গত জুন মাস থেকে গাজায় জিবিএস-এর ৮৫টি সন্দেহজনক কেস রিপোর্ট করা হয়েছে। এই রোগে আটটি মৃত্যুর ঘটনাও জানিয়েছে ডব্লিউএইচও।

গাজায় সম্প্রতি গুলেন-বেরি সিনড্রোম (জিবিএস) নামক রোগের প্রকোপ বাড়েছে, এই রোগ যে কোনো মানুষকে পক্ষাঘাতগ্রস্ত বা প্যারালাইজড করতে পারে।

ইজরায়েলি হামলায় প্যালেস্টাইনের মানুষ রোজ আহত হচ্ছেন বা বদ্ধ অবস্থায় অসুস্থ হয়ে পড়ছেন, গাজার হাসপাতালগুলো ধারণক্ষমতার বাইরে চলছে। টানা অবরোধের কারণে ওষুধ ও খাদ্য সরবরাহ বন্ধ থাকায় গাজায় এই পক্ষাঘাতজনিত রোগ ছড়িয়ে পড়ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তথ্য অনুযায়ী, গত জুন মাস থেকে গাজায় জিবিএস-এর ৮৫টি সন্দেহজনক কেস রিপোর্ট করা হয়েছে। এই রোগে আটটি মৃত্যুর ঘটনাও জানিয়েছে ডব্লিউএইচও।

গুলেন-বেরি সিনড্রোম কী?

জিবিএস এমন একটি রোগ, যেখানে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা পেরিফেরাল স্নায়ুকে রক্ষাকারী মাইলিন শিথ নামক আবরণের উপর আক্রমণ করে। এর ফলে স্নায়ুতন্ত্রের আবরণ ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং স্নায়ুর ক্ষতি হয়। পেরিফেরাল স্নায়ুগুলো মস্তিষ্ক এবং মেরুদণ্ড থেকে শরীরের বিভিন্ন অংশে, যেমন ত্বক, পেশি এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে ছড়িয়ে থাকে।

ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিকের ওয়েবসাইট অনুযায়ী, জিবিএস একটি অত্যন্ত বিরল রোগ, যা বিশ্বব্যাপী প্রতি বছর প্রায় এক লাখ মানুষকে আক্রান্ত করে।

আরও পড়ুন- গাজা প্রসঙ্গে ১০০-রও বেশি অবসরপ্রাপ্ত আমলার খোল চিঠি! ইজরায়েল প্রশ্নে ‘পক্ষপাতদুষ্ট’ অবস্থানের নিন্দা যে ভাষায়

জিবিএস-এর কারণ কী?

জিবিএস-এর সঠিক কারণ এখনও জানা যায়নি। তবে সাধারণত যারা ফ্লু, এপস্টাইন-বার ভাইরাস বা জিকা ভাইরাসের মতো ভাইরাল বা ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রমণে আক্রান্ত হন, তাদের এই রোগ হওয়ার ঝুঁকি থাকে। ডব্লিউএইচও জানিয়েছে, ক্যাম্পাইলোব্যাকটার জেজুনি নামক ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সৃষ্ট পেটের সংক্রমণ জিবিএস-এর অন্যতম প্রধান ঝুঁকি। এই ব্যাকটেরিয়া সাধারণত পশুর মলের মাধ্যমে ছড়ায়।

খান ইউনিসের নাসের মেডিকেল কমপ্লেক্সের শিশু বিভাগের প্রধান ড. আহমেদ আল-ফাররা জানিয়েছেন, গাজায় সংগৃহীত বেশিরভাগ পরীক্ষার নমুনায় ক্যাম্পাইলোব্যাকটার জেজুনি ধরা পড়েছে। তিনি আরও বলেছেন, নমুনাগুলোতে এন্টারোভাইরাসের উপস্থিতিও পাওয়া গেছে। এই ভাইরাস সাধারণত দূষিত জলের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে ছড়ায় এবং জ্বর, শরীরে ব্যথা, গলা ব্যথা ও ত্বকে ফুসকুড়ির মতো উপসর্গ সৃষ্টি করে।

ড. আল-ফাররা ব্যাখ্যা করেছেন, ইজরায়েল গাজার মলমূত্র নিষ্কাষণ ব্যবস্থা ধ্বংস করে দেওয়ায় মানুষ দূষিত জল পান করতে বাধ্য হচ্ছে, যার ফলে এই রোগগুলো ছড়িয়ে পড়ছে। গ্লোবাল অ্যাডভোকেসি গ্রুপ অক্সফামের জুলাই ২০২৪-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইজরায়েলি বোমা হামলায় গাজার ৭০ শতাংশ মলমূত্র নিষ্কাশন পাম্প এবং জল শোধনাগার ধ্বংস হয়ে গেছে। অক্সফাম আরও অভিযোগ করেছে যে ইজরায়েল তাদের জল পরীক্ষার সরঞ্জাম প্রবেশে বাধা দিচ্ছে।

কখনো কখনো অস্ত্রোপচারের কারণেও জিবিএস হতে পারে।

জিবিএস-এর উপসর্গ কী কী?

জিবিএস-এর উপসর্গ রোগের তীব্রতার ওপর নির্ভর করে ভিন্ন হতে পারে। সাধারণত এটি পা ও পায়ের আঙ্গুলে ঝিনঝিন, অসাড়তা বা পেশির দুর্বলতা দিয়ে শুরু হয়, যা পরে শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়তে পারে।

অন্যান্য উপসর্গের মধ্যে রয়েছে পিঠে বা পায়ে পেশির ব্যথা, বুকের পেশির দুর্বলতার কারণে শ্বাসকষ্ট, চোখের নড়াচড়া বা কথা বলা ও গিলতে অসুবিধা। চরম ক্ষেত্রে পা বা পুরো শরীরে পক্ষাঘাত হতে পারে। এছাড়া প্যারাস্থেসিয়া অর্থাৎ ত্বকে অসাড়তা, খোঁচা, জ্বালা বা ঠান্ডা অনুভূতি হতে পারে।

ডব্লিউএইচও-এর মতে, উপসর্গগুলো কয়েক সপ্তাহ স্থায়ী হতে পারে এবং বেশিরভাগ মানুষ দীর্ঘস্থায়ী স্নায়বিক জটিলতা ছাড়াই সুস্থ হয়ে ওঠে। তবে কিছু মানুষের দুর্বলতা থেকে যায়। জিবিএস প্রাণঘাতী হতে পারে, কারণ কিছু ক্ষেত্রে শ্বাসযন্ত্রের পেশির পক্ষাঘাত, রক্তে সংক্রমণ, ফুসফুসে রক্ত জমাট বাঁধা বা হৃদরোগের কারণে মৃত্যু হতে পারে।

জিবিএস-এর একটি পরীক্ষা হলো লাম্বার পাংচার, যেখানে মেরুদণ্ডের নিচের অংশ থেকে অল্প পরিমাণ তরল সংগ্রহ করা হয়। এই তরল জিবিএস-এর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ পরিবর্তনের জন্য পরীক্ষা করা হয়। আরেকটি পরীক্ষা হলো ইলেক্ট্রোমায়োগ্রাফি, যেখানে পেশিতে পাতলা সুচের ইলেক্ট্রোড ঢুকিয়ে স্নায়ুর কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করা হয়।

জিবিএস-এর চিকিৎসা?

জিবিএস-এর কোনো নির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই, তবে উপসর্গ কমাতে বিভিন্ন চিকিৎসা ব্যবহার করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, শ্বাসকষ্ট হলে রোগীকে ভেন্টিলেটরে রাখা হয়। পেশির দুর্বলতার ক্ষেত্রে ব্যায়াম সাহায্য করতে পারে।

জিবিএস একটি অটোইমিউন রোগ, প্রাথমিক উপসর্গ নিয়ন্ত্রণে ইমিউনোথেরাপি ব্যবহৃত হয়। এর মধ্যে রয়েছে প্লাজমা এক্সচেঞ্জ, যা রক্ত থেকে অ্যান্টিবডি অপসারণ করে। উপসর্গ শুরু হওয়ার দুই সপ্তাহের মধ্যে এই চিকিৎসা শুরু করলে সবচেয়ে কার্যকর হয়। জিবিএস প্রাণঘাতী হওয়ায় রোগীদের হাসপাতালে ভর্তি করে নিবিড় পর্যবেক্ষণ করা হয়।

গাজায় আর কোন রোগ পক্ষাঘাত সৃষ্টি করছে?

সম্প্রতি গাজায় অ্যাকিউট ফ্ল্যাসিড প্যারালাইসিস (এএফপি) নামক একটি রোগের প্রকোপ বেড়েছে, যা পেশির দুর্বলতা বা পক্ষাঘাত সৃষ্টি করে।

গত ৪ আগস্ট প্যালেস্টাইনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তাদের টেলিগ্রাম চ্যানেলে এক বিবৃতিতে বলেছে, “অস্বাভাবিক সংক্রমণ এবং তীব্র অপুষ্টির কারণে গাজা স্ট্রিপে শিশুদের মধ্যে অ্যাকিউট ফ্ল্যাসিড প্যারালাইসিস এবং গুলেন-বেরি সিনড্রোমের কেস বিপজ্জনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।”

আরও পড়ুন- ১৯৬৭ থেকে ২০২৫! যেভাবে গাজায় বারবার নিশানা করা হচ্ছে সাংবাদিকদের

বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, “পরীক্ষায় পোলিও ছাড়া অন্যান্য অন্ত্রের ভাইরাসের উপস্থিতি পাওয়া গেছে।”

পোলিও ভাইরাস গাজায় ২৫ বছর ধরে ধাবা বসাতে পারেনি, ইজরায়েলের যুদ্ধ শুরুর ১১ মাস পর আবার ফিরে এসেছে। পোলিও প্রাথমিকভাবে পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশুদের আক্রান্ত করে।

গাজায় ওষুধের অভাব ও দুর্ভিক্ষ

গাজায় ওষুধের তীব্র সংকট চলছে। ইন্টিগ্রেটেড ফুড সিকিউরিটি ফেজ ক্লাসিফিকেশন (আইপিসি) সম্প্রতি নির্ধারণ করেছে যে গাজা ৫ম স্তরের বিপর্যয়ের মুখোমুখি, যেখানে “অনাহার, মৃত্যু, দারিদ্র্য এবং তীব্র অপুষ্টি স্পষ্ট।”

গত মার্চের মাঝামাঝি সময়ে ইজরায়েল খাদ্য, জল, ওষুধ ও জ্বালানিসহ অত্যাবশ্যকীয় সরবরাহের উপর সম্পূর্ণ অবরোধ আরোপ করে। অবরোধ আনুষ্ঠানিকভাবে তুলে নেওয়া হলেও সরবরাহের প্রবেশ অত্যন্ত সীমিত ও অনিয়মিত।

জাতিসংঘের ১৩ আগস্টের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গাজার হাসপাতালগুলো অতিরিক্ত চাপে রয়েছে। ডব্লিউএইচও-এর প্রতিনিধি ড. রিক পিপারকর্ন জানিয়েছেন, গাজার অর্ধেকেরও কম হাসপাতাল এবং ৩৮ শতাংশ প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র আংশিকভাবে বা ন্যূনতম পর্যায়ে কার্যকর।

জাতিসংঘ আরো জানিয়েছে, প্রধান হাসপাতালগুলোতে শয্যায় ধারণক্ষমতার অনেক বেশি রোগী রয়েছে। গাজা সিটির আল-শিফা হাসপাতাল ২৫০ শতাংশ, খান ইউনিসের নাসের মেডিকেল কমপ্লেক্স ১৮০ শতাংশ, গাজা সিটির আল-রান্তিসি শিশু হাসপাতাল ২১০ শতাংশ এবং গাজা সিটির দক্ষিণে আল-আহলি আরব হাসপাতালে ধারণক্ষমতার ৩০০ শতাংশেরও বেশি রোগী রয়েছে।

More Articles